• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বাংলাদেশী বই-বাজার: পেশাদার লেখকদের শ্মশান

প্রকাশ:  ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ২১:৪২ | আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:০১
সায়েম সোলায়মান
বাংলাদেশী বই-বাজার: পেশাদার লেখকদের শ্মশান

বাংলা সাহিত্যের কিছু হেভিওয়েট লেখক ছাড়া অন্য কেউ লেখক-হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখায়নি, দেখাচ্ছে না, এবং সম্ভবত দেখাবেও না। কেন?

বইমেলা ২০১৮ এর একটি হিসেব দেখুন:

প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা: ৪০০০ (প্রায়)।

অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থা: ৪০০ (প্রায়)।

মোট বিক্রির পরিমাণ: ৬০ কোটি টাকা (প্রায়)।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে উপার্জনক্ষম মানুষের সংখ্যা: ১ কোটি (অনুমিত)।

অর্থাৎ, আমরা যারা উপার্জন করছি তারা ২০১৮ সালের বইমেলা থেকে গড়ে ৬০ টাকার বই কিনেছি।

বইয়ের সবচেয়ে বড় মেলার মাসে বিক্রির অবস্থা যদি এ-রকম হয়, তা হলে বাকি ১১ মাসের খবর কী?

এ-দেশে বইয়ের বাজার যে ভালো না, অন্তত লেখকদের জন্য না, তা নতুন করে বলে দিতে হয় না। আমি নিজে লেখালেখি করছি ১৫-১৬ বছর ধরে। জীবিকা হিসেবে শুধু লেখক-সম্মানী ব্যবহার করছেন, এ-রকম যাঁদেরকে স্বচক্ষে দেখেছি, তাঁদের সংখ্যা কত শুনবেন?

মাত্র ২!

ইমরান খান বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি এককালে জাঁদরেল ক্রিকেটার ছিলেন। শুনেছি, তিনি নাকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো এক ম্যাচের পর দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলেছি, এ-ই তো বেশি!’

অবস্থাটা বদলে গেছে অনেক। এ-দেশের ক্রিকেটের পেছনে বিনিয়োগ হয়েছে, এ-দেশের ক্রিকেট পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। ফলে আমরা পেয়েছি মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল কিংবা মুশফিকুর রহিমকে। বাংলাদেশের প্রকাশনা-শিল্প কি সঠিক দিকনির্দেশনা পেয়েছে?

হুমায়ূন আহমেদ নাকি তাঁর প্রাপ্য সম্মানী নেয়ার আগে কোনো কোনো প্রকাশককে বাধ্য করতেন প্রচ্ছদশিল্পীর সম্মানী পরিশোধ করতে। ব্যাপারটা হুমায়ূন আহমেদ বলে সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন?

লেখক বলেন, প্রকাশক প্রাপ্য-টাকা দেন না। প্রকাশক বলেন, বই চলে না, তাই কারও পাওনা টাকাই দিতে পারি না। অথচ গণেশ উল্টিয়ে দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করেছেন, এ-রকম প্রকাশকের সংখ্যা কি ভূরি-ভূরি? ঢাকা শহরে বাংলাবাজার নামে যে-জায়গাটা আছে, সেখানে কি বইয়ের- দোকানগুলো সব উঠে গিয়ে লোহালক্কড় অথবা কাপড়ের দোকান বসেছে?

একই শিল্পের সঙ্গে জড়িত দু’রকম লোকের মুখে যেখানে দু’রকম বক্তব্য থাকে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দৃষ্টিকটু বৈপরীত্য থাকে, সেখানে কি আপনি নতুন কোনো মাশরাফি/সাকিব/তামিম/মুশফিক আশা করতে পারেন? ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা যদি আজ এই মুহূর্তে ঘোষণা দেয়, আমরা মেসিকে আর কোনো টাকা দেবো না, সে বিনা-টাকায় আমাদের ক্লাবে খেলতে চাইলে খেলতে পারে, তা হলে কি আমরা মেসিকে বার্সেলোনায় আর দেখতে পাবো?

গভীর দুঃখ এবং একবুক হতাশা নিয়ে একটা কথা বলি। (কথাটা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তা হলে, বিশ্বাস করুন, খুশিই হবো) বাংলাদেশে কখনও কোনো চার্লস ডিকেন্স জন্মাবে না। এ-দেশের কোনো লেখক কখনও ড্যান ব্রাউন, ডেভিড বালড্যাচি অথবা জে. কে. রওলিং-এর সমকক্ষ হতে পারবেন না। তাঁরা তাঁদের মেধা ব্যয় করেছেন সৃষ্টিশীলতার পেছনে, বিনিময় নিয়ে ভাবতে হয়নি তাঁদেরকে কখনও। সংসার চলবে না জেনে যে-লোক কাগজ-কলমকে বিদায় জানিয়ে কেরানিবৃত্তির গুণগান করেন, সৃষ্টিশীলতাও তাঁকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় বহু দূর।

বাংলাদেশের হালহকিকত বুঝতে পেরে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলে গেছেন, যে-দেশে গুণের সমাদর নেই, সে-দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।

জনাব আনিসুর রহমানের “আমাদের প্রকাশনা জগতের ভেতরে ও বাইরে” প্রবন্ধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখাটি লিখলাম। তিনি তাঁর সেই প্রবন্ধের শেষাংশে বলেছেন: সব অভিযোগ ও সঙ্কট উতরে আমাদের প্রকাশনা জাতীয় উন্নয়নের সমান্তরালে অগ্রসর হবে এবং লেখালেখি ও প্রকাশনা জগতে বই বাঁধাইয়ের কর্মীটি থেকে শুরু করে লেখক, অক্ষর বিন্যাসের কর্মীটি এবং প্রচ্ছদ শিল্পীদের কেউ ভাতে মারা যাবে না, একই সঙ্গে প্রকাশকের ব্যবসাও মাঠে মারা পড়বে না, এমন আশাবাদ রেখে লেখাটি শেষ করছি।

আমার এক সিনিয়র কলিগ প্রায়ই বলেন, আশা করতে দোষ কী? সত্যিই, আশা করায় দোষের কিছু নেই।

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)

সায়েম সোলায়মান : লেখক ও ব্যাংকার।

পিবিডি/ হাসনাত

সায়েম সোলায়মান,বই-বাজার,মেলা,লেখক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close