• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?

প্রকাশ:  ১০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:০০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

প্রবাহ বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালামের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৭ সালের ১০ জানুয়ারি ইতালীর রাজধানী রোমে নির্জন এক এপার্টমেন্টে জীবনাবসান ঘটে প্রচন্ড আত্ম-অভিমানী এই মেধাবী বাঙালির। ১৯৫৯ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন তিনি ইতালীতে। দেশটির ‘প্রথম বাংলাদেশী’ শামসুদ্দীন আবুল কালামের জন্ম ১৯২৬ সালে বরিশালে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইতালী থেকে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছিলেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৭ ইতালীতে সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের প্রবাস জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করলেও দেশটির কর্মক্ষেত্রে ছিল তাঁর সফল পদচারণা।

সত্তরের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম কর্মরত ছিলেন রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থ (ফাও) সদর দফতরে এবং স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসে। ইতালীয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ছিল তাঁর পদচারণা। ইতালীতে আসার আগেই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের বেশ ক’টি বিখ্যাত উপন্যাস। বিখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের সবচাইতে সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘কাশবনের কন্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। পরবর্তীতে পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাতে আসে উপন্যাস - দুই মহল (১৯৫৫), কাঞ্চনমালা (১৯৫৬), জীবন কান্ড (১৯৫৬), জাইজঙ্গল (১৯৭৮), মনের মতো স্থান (১৯৮৫), সমুদ্রবাসর (১৯৮৬), যার সাথে যার (১৯৮৬), নবান্ন (১৯৮৭) ও কাঞ্চনগ্রাম (১৯৮৭)। ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প সংগ্রহ ‘অনেক দিনের আশা’। পরের বছর ‘ঢেউ’ ও ‘পথ জানা নেই’। দুই হৃদয়ের তীর (১৯৫৫) এবং সাহের বানু (১৯৫৭) এই বাঙ্গালী গুণীজনেরই অমর সৃষ্টি।

সম্পর্কিত খবর

    ১৯৫৯ সালে ইতালী পাড়ি জমাবার আগে সংসার জীবনে অবশ্য সুখী হতে পারেননি শামসুদ্দীন আবুল কালাম। কন্যা ক্যামেলিয়ার জন্মের পর স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলে পরে ঐ ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মোস্তফা। নতুন সংসারে জন্ম হয় সুবর্ণার, যিনি পরবর্তিতে বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সুবর্ণা মোস্তফা নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সৎবোন ক্যামেলিয়া মোস্তফা কিছুদিন অভিনয় জগতে থাকলেও এক পর্যায়ে পাড়ি জমান বিদেশ বিভুঁইয়ে, বাবার পথ ধরে। তবে ইতালীতে আসেননি ক্যামেলিয়া, নিউইয়র্কের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ নেন জীবিকার তাগিদে।

    ১৯৯৭ সালে শামসুদ্দীন আবুল কালামের মৃত্যুর সময় নিউইয়র্কেই অবস্থান করছিলেন ক্যামেলিয়া মোস্তফা। বৈধ স্টে পারমিট না থাকার কারণে আমেরিকা থেকে বের হতে পারেননি তখন তিনি। অবশ্য মৃত্যুর পরপরই বাবার একাউন্টে থাকা প্রায় ১২ হাজার ডলারের সমপরিমাণ ইতালীয়ান লিরা আমেরিকাতে বসেই দ্রুত বুঝে নেন ক্যামেলিয়া। বেশ কয়েক বছর পর ক্যামেলিয়া বাংলাদেশ ফিরে গেলেও ইতালীতে বাবার সমাধি এক নজর দেখতে আসার প্রয়োজন মনে করেননি। তার উদাসীনতার কারণেই মূলতঃ শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমাধি বিগত ২১ বছরে রোমের খ্রিস্টান গোরস্থান থেকে পাশের মুসলিম গোরস্থানে স্থানান্তরিত হয়নি। সত্তর ও আশির দশকে ইতালীতে ছিল খুব স্বল্প সংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস। নব্বইর দশকে দেশটিতে বাংলাদেশীদের আগমন দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও স্বদেশীদের সাথে খুব একটা মেশা হয়ে ওঠেনি তাঁর। বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরীর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আরেক প্রবীন বাংলাদেশী লুৎফর রহমান যিনি এখনও জীবিত আছেন, মূলতঃ তাঁর সাথেই কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হতো শামসুদ্দীন আবুল কালামের।

    তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আত্ম-অভিমানী এই কথাসাহিত্যিক জীবনের শেষ দিনগুলোতে এতোটাই জীবনবিমূখ হয়ে উঠেছিলেন যে, ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্বেও বাজার করতেন না এমনকি প্রায়শই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে এবং জীবনরক্ষাকারী ঔষধ সেবন না করে স্বেচ্ছায় ধাবিত হন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। শামসুদ্দীন আবুল কালামের দুঃখজনক মৃত্যুর সময় ১৯৯৭ সালে আমি রাজধানী রোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুবাদে ঐ সময়কার ঢাকার একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের ইতালী প্রতিনিধির দায়িত্বে থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারিনি কিছুই। যৌক্তিক কারনে তখন জানার সুযোগও ছিলো না আমাদের। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমান সহ আমরা অবগত হই রোমে তাঁকে সমাহিত করার বেশ কিছুদিন পর লন্ডনের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হবার পর। রোম পৌর প্রশাসন কর্তৃক পরে আমাদের অবহিত করা হয়, শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর নির্জন এপার্টমেন্টে মারা যাবার বেশ কয়েক ঘন্টা পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল বহুতল ভবনের বাইরে থেকে জানালা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করে।

    শামসুদ্দীন আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধারের পর ডকুমেন্টে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় পরিচয় না থাকায় এবং আত্মীয় বা নিকটজন কারো কোন সন্ধান পুলিশ না পেয়ে মূলতঃ ‘বেওয়ারিশ’ লাশ হিসেবে তাঁকে রোমের এক প্রান্তে ‘প্রিমাপর্তা’ এরিয়াতে জানাজা ছাড়াই খ্রিস্টান গোরস্থানে সমাহিত করে। পাশেই মুসলিম গোরস্থান থাকলেও ‘রক্ত-সম্পর্কীয়’ নিকটজনের অনুমতি না পাওয়ায় আজো স্থানান্তর করা হয়ে ওঠেনি বাংলার এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের সমাধি। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমান গত ২১ বছর ধরে যখনই সময় পেয়েছেন ছুটে গেছেন ‘প্রিমাপর্তা’ সমাধিক্ষেত্রে, করেছেন পরিচর্চা। নিউ ইয়র্কে এবং ঢাকায় ক্যামেলিয়াকে এ বিষয়ে বহুবার জানানো হলেও জন্মদাতা পিতার সমাধি সঠিক স্থানে স্থানান্তরের সামান্য ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেবার তাগিদ অনুভব করেননি কন্যা। অসুস্থতা জণিত কারণে কয়েক বছর আগে ঢাকাতে ক্যামেলিয়াও চলে যান ‘না ফেরার দেশে’।

    শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রতি ‘যারপরনাই’ উদাসীন রোমের বিশাল বাংলাদেশ কমিউনিটিও। বাংলাদেশ ভিত্তিক নোংরা রাজনীতি এবং জেলা-থানা ভিত্তিক আঞ্চলিকতার ভিলেজ পলিটিক্স চর্চায় পুরোদমে ব্যস্ত থাকার পরিণতিতে এখানকার বাংলাদেশ কমিউনিটি আজ অবধি ন্যূনতম সম্মান দেখায়নি ‘প্রিমাপর্তা’ সমাধিক্ষেত্রে চিরনিদ্রায় শায়িত বাংলার এই সোনার সন্তানের প্রতি। যে দূতাবাসে একদা তিনি কর্মরত ছিলেন, রোমের সেই বাংলাদেশ দূতাবাসেরও তেমন কোন মাথাব্যথা নেই শামসুদ্দীন আবুল কালামের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভালো ও সৃষ্টিশীল কোন উদ্যোগ নেবার। ঘুমন্ত কমিউনিটি ও দূতাবাসকে তাই জাগাতে হবে, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close