• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

জেনেশুনে নয়, জেনেবুঝে বিনিয়োগ করতে হবে

প্রকাশ:  ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

২০১০ সালের ধসের পর সংস্কার ও আস্থা ফেরানোর মিশন নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. খায়রুল হোসেন। অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষার পর তিনি ফিন্যান্সে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন, যার বিষয়বস্তু ছিল পুঁজিবাজারের রেগুলেটরি সংস্কার। বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ উপলক্ষে সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নিজের অভিজ্ঞতা, পরিকল্পনা ও দর্শন তুলে ধরেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহফুজ উল্লাহ বাবু

ধস-পরবর্তী বাজারে আস্থা ফেরানোর দায়িত্ব নিয়ে আপনি বিএসইসিতে কাজ শুরু করেছিলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করবেন...

সম্পর্কিত খবর

    আপনারা জানেন, ২০১০-১১ সালে পুঁজিবাজারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ উত্থান-পতনের পর সরকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে আমরা কমিশনের দায়িত্ব নিই। কাজ শুরুর পর প্রথমেই আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সমগ্র পুঁজিবাজারের দুর্বলতাগুলোর দিকে নজর দিলাম। প্রথমেই আসে আইন-কানুন। আমরা দেখলাম, অনেক নিয়ম-কানুন থাকলেও সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছিল না। আবার অনেক আইন, বিধিবিধানের কার্যকারিতা যথেষ্ট ছিল না। সেগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। আইনের অপ্রতুলতাও ছিল। কমিশন থেকে আমরা সেগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরলাম। কিছু বিষয় অর্থ মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি, আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পরিবর্তন বা সংযোজন করা হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিছু বিধি কমিশনের ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে জনমত যাচাইয়ের পর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরাই কার্যকর করেছি।

    নতুন বিধিবিধান ও আইন-কানুন পরিবর্তন ও প্রণয়নের ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ রেগুলেটরদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ISOCO-এর একটি পরোক্ষ রোল ছিল। ২০১২ সালে কমিশন চেয়ারম্যান হিসেবে আমি প্রথমবারের মতো চীনে ISOCO-এর বার্ষিক সভায় অংশ নিই। তখন তারা আমাকে বললেন, আপনাদের এখানে পঞ্চাশের দশক থেকে স্টক এক্সচেঞ্জ আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কমিশনেরও ১৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিএসইসি এখনো কেন ‘এ’ ক্যাটাগরির সদস্য হতে পারছে না। দেশে ফিরে আমি কমিশনার ও কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়গুলো চিহ্নিত করি। পরবর্তীতে সংসদের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অ্যাক্ট, ১৯৯৩-এ প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংযোজন করা হয়।

    আইনি কাঠামোর পর আমরা নজর দিলাম বাজারের অবকাঠামোগত বিষয়গুলোর দিকে। দেখা গেল, একটি আধুনিক পুঁজিবাজারের যে অবকাঠামোগত সক্ষমতা থাকা দরকার, আমাদের এখানে তা নেই। সে সময় বিএসইসির নিজস্ব সার্ভিল্যান্স সিস্টেম ছিল না। শেয়ার লেনদেনে ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কিনা, সার্কুলার ট্রেডিং করে কেউ দাম প্রভাবিত করছে কিনা, কেনাবেচায় কারসাজির প্রতিফলন কতটা— নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কমিশন প্রত্যক্ষভাবে এগুলো তদারক করতে পারছিল না। কমিশনকে স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের ওপর নির্ভর করতে হতো। তাদের সিস্টেমটিরও অনেক দুর্বলতা ছিল। তখন এডিবির সহযোগিতায় আমরা কমিশনে আধুনিক সার্ভিল্যান্স সিস্টেম চালু করতে সমর্থ হলাম। এখন সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০ ধরনের অ্যালার্ট আসে, যার ভিত্তিতে আমরা বাজারসংশ্লিষ্টদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি।

    আইনি ও অবকাঠামোগত সংস্কারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিচারে ISOCO বিএসইসিকে ‘এ’ ক্যাটাগরির সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আপনারা জানেন, এ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করেন ও ক্রেস্ট উপহার দেন। স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তখন আমাদের দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়। ধারাবাহিক অগ্রগতির একটি রোডম্যাপ নিয়ে কমিশন এখনো কাজ করে যাচ্ছে এবং এটি চলতেই থাকবে।

    আইনি দিকগুলোর পর আমরা স্টক এক্সচেঞ্জ, ইস্যুয়ার ও ইন্টারমিডিয়ারিগুলোর গভর্ন্যান্স ও শৃঙ্খলা উন্নয়নে নজর দিই। প্রথমেই আসে এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন। ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য অনেক দেশে মালিকানা থেকে এক্সচেঞ্জগুলোর ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে এক দশক পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যেখানে আমরা মাত্র দেড় বছরে তা সম্পন্ন করতে সক্ষম হই এবং সেটিও সবার সানন্দ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আমার পর্যবেক্ষণ, দেশের দুই এক্সচেঞ্জই এখন ডিমিউচুয়ালাইজেশনের স্পিরিটটি আত্মস্থ করতে পেরেছে। সেখানে কোনো ব্যত্যয় দেখলে কমিশন কোনো ছাড় দেয় না।

    ইস্যুয়ারদের মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে আপনার কমিশন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? এগুলোর সুফল কতটা?

    ইস্যুয়ার তথা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোয় সুশাসন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত হতে চান যে, একটি কোম্পানি তার ব্যবসায়িক অবস্থা সম্পর্কে যে তথ্য দিচ্ছে, সেটি নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য এবং সেখানে প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে।

    আমরা দায়িত্ব নেয়ার সময় দেখলাম, সুশাসন প্রশ্নে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে অনেক আপেক্ষিক ব্যাখ্যার সুযোগ ছিল। এটিকে আরো কাঠামোবদ্ধ করতে আমরা করপোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইন সংশোধন করেছি। কোনো অসঙ্গতির ক্ষেত্রে এখন ‘পরিপালন করুন অথবা ব্যাখ্যা করুন’-এর পরিবর্তে শুধু ‘পরিপালন করুন’ নীতি সন্নিবেশিত হয়েছে। এখন কোম্পানি সচিব, সিএফও, সিইও, পর্ষদ সবার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। পর্ষদে কমপক্ষে ২০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়। কারা এ দায়িত্ব নিতে পারবেন, সে যোগ্যতাও উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে একজন স্বতন্ত্র পরিচালককে অডিট কমিটির চেয়ারম্যান করার বিধান রাখা হয়েছে।

    কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে আমরা নিরীক্ষকদের একটি প্যানেল তৈরি করে দিয়েছি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো অডিট ফার্মগুলো এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর বাইরে কেউ আর তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা সিকিউরিটিজের হিসাব নিরীক্ষা করতে পারছে না। কোনো নিরীক্ষক পেশাদারিত্ব দেখাতে ব্যর্থ হলে তারা আমাদের প্যানেল থেকে বাদ পড়বে। আপনারা জানেন, দেশে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল হয়েছে। তারা রিপোর্টিং ও নিরীক্ষার মান এবং সংশ্লিষ্টদের পেশাদারিত্ব উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে। কিছু নিরীক্ষকের বিচ্যুতির বিষয়ে আমরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সংগঠন আইসিএবিকে অবহিত করেছি, যার ভিত্তিতে তারা সংশ্লিষ্ট সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। এগুলো অন্য নিরীক্ষকদের জন্য সতর্কবার্তা বয়ে এনেছে।

    স্বতন্ত্র পরিচালকদেরও একটি উপাত্তভাণ্ডার আমরা করে দিতে চাই। তবে এজন্য আরেকটু সময় নিলে ভালো হবে। কারণ আমি মনে করি, পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হলে যোগ্যতার পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও একটি বড় ফ্যাক্টর। দেশে সিএ, সিএমএ, সিএফএ ও সিএস সনদধারীদের সংখ্যা বাড়ছে। আরো কিছুটা সময় নিলে আজকের তরুণ প্রফেশনালরাও অভিজ্ঞ হওয়ার সুযোগ পাবেন এবং উপাত্তভাণ্ডারটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হবে।

    কোম্পানির অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন ও মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশেও শৃঙ্খলা এসেছে। পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বাধ্যবাধকতা এসেছে। কোম্পানিগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি ডিসক্লোজার দিচ্ছে। আর্থিক ফলাফলে অসঙ্গতি, অস্বাভাবিকতা ও বিচ্যুতি থাকলে বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে কোম্পানিকে এর ব্যাখ্যাও দিতে হচ্ছে।

    এসবের সুফল অবশ্যই আছে, বিনিয়োগকারীরাও সেটি অনুভব করছেন বলে আমার বিশ্বাস। তার পরও অন্য সবার মতো আমিও আশঙ্কা করি, কিছু কোম্পানির ডিসক্লোজারে প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে না। এগুলো অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তবে প্রমাণসাপেক্ষে। এর বাইরে হিসাব মানদণ্ডের মধ্যে থেকেও আয় বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর কিছু সুযোগ সারা পৃথিবীতেই থেকে যায়। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কম থাকায় আমাদের সিংহভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারীই সেগুলো ধরতে পারেন না। তবে পেশাদার বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে সক্ষম।

    বিএসইসি কতটা রেগুলেটর, কতটা ফ্যাসিলিটেটর?

    ভালো প্রশ্ন। বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক দেশের বাজারসংশ্লিষ্টরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এত অল্প সময়ে এত সুন্দর ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কাজটি আপনারা কীভাবে সম্পন্ন করলেন? আমি দেখেছি, অনেক উন্নয়নশীল দেশ প্রক্রিয়াটি রেপ্লিকেট করতে চাইছে। উত্তরে আমি তাদের এটুকুই বলি, আমরা রেগুলেটর এবং একই সঙ্গে ফ্যাসিলিটেটরও। একটি পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে নিযুক্ত করতে পারলেই উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হয়।

    উন্নত বিশ্বে আমি দেখেছি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা শুধু নিয়ন্ত্রণই করে না, তারা ধারাবাহিক উন্নয়নের পরিবেশটিও নিশ্চিত করে। সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলো যাতে ভালোভাবে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে এবং এগিয়ে যায়, নিয়ন্ত্রকদের পক্ষ থেকে এজন্য সুচিন্তিত সহযোগিতাও প্রদান করতে হয়। কমিশনের দায়িত্ব নেয়ার পর শুরু থেকেই আমরা বিষয়টি মাথায় রেখেছি।

    দেখুন, প্রথমে আমরা কিছু প্রমাণিত অপরাধের শাস্তি দিয়েছি। অনেককে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু ব্যক্তিকে পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ করার উদাহরণও আমরা সৃষ্টি করেছি। ইন্টারমিডিয়ারিগুলোকেও নানা বিচ্যুতির কারণে যথাযথ মাত্রায় শাস্তি দেয়া হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অর্থাত্ আমরা সবার কাছেই একটি বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি, আইন-কানুন আর শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

    এখনো সার্ভিল্যান্সে প্রতিদিনই কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি উঠে আসে। দৈনন্দিন পরিচালন কর্মকাণ্ডে অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির জন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দেয় কমিশন। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তীতে নিজেদের শুধরে নেয়। বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়লে তদন্ত শেষে বিষয়গুলোকে এনফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠানো হয় এবং রেগুলেটরি পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তি দেয়ার আগে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেয়া হয়।

    সর্বোপরি বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষই যাতে ক্রমাগত উন্নতিসাধন করে যেতে পারে, সেজন্য আইনের আওতার মধ্যে সব ধরনের উত্সাহ ও প্রেরণা দেয়ার কাজটি কমিশন করে থাকে। কারণ আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন একটি পুঁজিবাজার গড়ে তোলা, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ ও অনবদ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

    কমিশনে আপনি ছয় বছরের বেশি সময় ধরে আছেন। প্রধান সিকিউরিটিজ রেগুলেটর হিসেবে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

    আমার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং একটি জবাবদিহিমূলক স্থিতিশীল বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া। আমাদের গৃহীত সংস্কার ও নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বাজারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই অংশগ্রহণ বেড়েছে। স্টেকহোল্ডাররা ঘোষিত বিধিবিধানের আলোকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করায় বাজারে একটি শৃঙ্খলা এসেছে। ফিরে এসেছে গতিশীলতাও। গত পাঁচ বছরের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সূচক ও গড় লেনদেন ঊর্ধ্বমুখী ধারায় আছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি ৪ হাজার থেকে ৬ হাজারের ঘরে উন্নীত হয়েছে। দৈনিক গড় লেনদেন ৪০০ কোটি থেকে বেড়ে এখন প্রায় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এখন আমরা একটি স্থিতিশীল বাজার দেখতে পাচ্ছি। এ সময় বিদেশী বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

    সরকারের কাছ থেকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছেন?

    পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়, প্রতিমন্ত্রী, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অর্থমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পুঁজিবাজারের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নিয়মিত খবর রাখছেন। আইন-কানুন সংশোধন ও প্রণয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রতিটি আয়োজনে আমাদের সঙ্গে থেকে উত্সাহ দিয়েছেন এবং তার মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে পুঁজিবাজার বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

    আমি দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি অত্যন্ত দরদি। প্রতিবারই তাদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পুঁজিবাজার উন্নয়নে আমাদের সব উদ্যোগে তিনি সমর্থন দিয়েছেন। আমাদের প্রতিটি বড় আয়োজনে পাশে থেকে উত্সাহ জুগিয়েছেন। প্রতিবার সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী সেশনে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব ও অর্জন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তার পরামর্শ, নির্দেশনা ও উত্সাহ নিজ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আমাদের আরো নিবেদিত করেছে।

    প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিতে বলে আসছেন, সেটি হলো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা। তা না হলে তাদের যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ সূচক বা শেয়ারের দাম এর মৌলভিত্তির বিপরীতে বেশি বেড়ে গেলে একসময় তা সংশোধন হবেই। দাম বাড়লে মুনাফাটা যেমন বিনিয়োগকারীর, কমলে লোকসানটিও তারই। সুতরাং কখন কোন শেয়ার কিনতে হবে, ছেড়ে দিতে হবে বা ধরে রাখতে হবে— এগুলো সম্পর্কে বিনিয়োগকারীকেই জানতে হবে। এজন্য যথাযথ জ্ঞানার্জন ও সচেতনতা প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমরা কাউকে কখনই বলব না, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন। তবে এটি বলতেই হবে, বিনিয়োগ করলে জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করুন।

    এ বছরের শুরুতে দেশব্যাপী ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আওতায় আমরা বাজারসংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আর্থিক বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। পরিকল্পনা অনুসারে, বিনিয়োগের মৌলিক ধারণার পাশাপাশি করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কমিশনের পাশাপাশি বিআইসিএম, স্টক এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও নিয়মিত বিভিন্ন সার্টিফিকেট কোর্স আয়োজন করছে। একপর্যায়ে আমরা সবার মধ্যে আরো অ্যাডভান্সড লেভেলের লিটারেসি নিয়ে এগোতে চাই। সেটি নির্ভর করবে বেসিক লিটারেসি কর্মসূচির সাফল্যের ওপর।

    দেশব্যাপী চলমান ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কর্মসূচির স্লোগান— ‘সচেতন বিনিয়োগ, সমৃদ্ধ আগামী’। প্রধানমন্ত্রীর একটি উপদেশ আবারো সবার কাছে তুলে ধরছি, ‘জেনেশুনে নয়, জেনেবুঝে বিনিয়োগ করুন।’ অর্থাত্ জানুন, বিশ্লেষণ করুন আর বুঝুন। একজন বিনিয়োগকারী জানলেন, শিখলেন কিন্তু পরিস্থিতি না বুঝে শুধু অন্যের কথা শুনে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিলেন— তাহলে অনুকূল বাজারেও তিনি যথেষ্ট মুনাফা করতে পারবেন না, আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার ঝুঁকিই থাকবে সবচেয়ে বেশি।

    আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য রেগুলেটরের সঙ্গে আমাদের সমন্বয়ও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো।

    বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে আপনি এমন কোনো সংস্কার বা পরিবর্তনের কথা উপলব্ধি করেন কি, যেগুলো এরই মধ্যে হয়ে যাওয়া দরকার ছিল কিংবা নিকটভবিষ্যতে সম্পন্ন হওয়া দরকার?

    আমরা ১০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় সংস্কার কর্মসূচি চলমান রেখেছি। যেসব পরিবর্তন এরই মধ্যে হয়ে গেছে, এর তালিকাটাও যথেষ্ট দীর্ঘ। সুশাসন, তথ্যপ্রবাহ, সার্ভিল্যান্স, ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা, সর্বোপরি আইপিও পদ্ধতি এখন অনেক যুগোপযোগী হয়েছে। সময়ে সময়ে অবশ্যই সেগুলোর আপগ্রেডেশন প্রয়োজন হবে।

    তার পরও আমি মনে করি, আমাদের পুঁজিবাজারে অনেক কিছুই হওয়ার বাকি। এর দুটি প্রধান দিক উল্লেখ করতে পারি— প্রথমত. পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, দ্বিতীয়ত. জ্ঞানভিত্তিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা।

    আমাদের পুঁজিবাজারটি এখনো ইকুইটিনির্ভর। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পোর্টফোলিওর জন্য ইকুইটির বাইরে ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজ, মিউচুয়াল ফান্ড, ডেরিভেটিভ, কমোডিটি সবই দরকার, যেমনটি আমরা অন্যান্য দেশে দেখি। বন্ড মার্কেটটা দ্রুত দাঁড় করানোর জন্য মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ সবাই একযোগে কাজ করছে। আমরা মেয়াদি-বেমেয়াদি সব ধরনের মিউচুয়াল ফান্ডের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ইটিএফ চালুর ব্যাপারেও কাজ চলছে। প্রশিক্ষিত ফান্ড ম্যানেজারদের হাত দিয়ে যত বেশি তহবিল বিনিয়োগ হবে, বাজার তত স্থিতিশীল হবে।

    ডেরিভেটিভ চালু করতে আমাদের আরো সময় লাগবে। কারণ এজন্য বিধি পরিবর্তন করে শর্টসেল বৈধ করতে হবে। তখন এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং প্লাটফরমেও আপগ্রেডেশন প্রয়োজন হবে। এছাড়া দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শর্টসেলের ট্রেড এক্সিকিউশন ও সেটলমেন্ট করার মতো দক্ষ লোকবলও প্রয়োজন হবে। পণ্যে বৈচিত্র্য এলে শেয়ারবাজারে একমুখী চাহিদার যে সমস্যাটি আমরা মাঝে মাঝে দেখি, তা অনেকটাই কমে আসবে।

    ইন্টারমিডিয়ারিগুলোর পেশাগত দক্ষতা আগের চেয়ে বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই এখনো তা অপ্রতুল। আমি বলব, এখন তাদের সবারই আধুনিক বাজারের জন্য যোগ্যতাগুলো নিশ্চিত করার সময় এসেছে।

    বাজারে নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট আনয়নে আমরা আমাদের সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব এবং সে চেষ্টার সাফল্য সম্পর্কে আমি আত্মবিশ্বাসী। শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা আর সচেতনতাটুকু নিশ্চিত করতে হবে। এটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।

    অদূরভবিষ্যতে আমাদের সংস্কার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত আছে—

    স্টক এক্সচেঞ্জে স্মল-ক্যাপ প্লাটফর্ম চালু করা, পৃথক ক্লিয়ারিং ও সেটলমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা, নতুন অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণ বিধিমালা প্রণয়ন, সংশোধিত করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড প্রণয়ন

    বন্ড মার্কেট উন্নয়ন এবং ইটিএফ ও ডেরিভেটিভ চালু করা।

    প্রথমবারের মতো সারা পৃথিবীতে বিনিয়োগকারী সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে...

    IOSCO-এর কমিটি অন রিটেইল ইনভেস্টরসের সুপারিশক্রমে বিশ্বের ৮২টি দেশে প্রথমবারের মতো একযোগে বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ ২০১৭ পালন করা হচ্ছে। এ কর্মসূচির প্রতিপাদ্য বিষয়, বিনিয়োগ শিক্ষা ও বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা। কর্মসূচির মাধ্যমে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া পদক্ষেপগুলোও তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিএসইসির নেতৃত্বে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাত দিনব্যাপী কর্মসূচিটি পালিত হচ্ছে। আজ কর্মসূচির শেষ দিন। আলোচনা অনুষ্ঠান, সেমিনার ও প্রবন্ধ উপস্থাপনা এবং কর্মশালার মাধ্যমে প্রতিদিনই বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানের ভিত্তি ও সচেতনতাকে শাণিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পালিত কর্মসূচির আলোকে আগামীতে আমাদের বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমেও নতুন উপাদান সংযোজন করা হবে।

    সূত্র: বণিক বার্তা

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close