বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগগুলো প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। পদ্মা সেতুসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের নির্মাণকারী (ঠিকাদার) হিসেবেও রয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগগুলো আটকে যাচ্ছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের আলোচনা অনেকদূর এগোলেও এখন তা এক প্রকার বন্ধ। বাংলাদেশে শেভরনের ব্যবসা কিনতে চেয়েও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায়নি চীনা প্রতিষ্ঠান। একই পথে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) চীনা কনসোর্টিয়ামের কৌশলগত বিনিয়োগ প্রস্তাবটিও।
ভূ-রাজনীতিকেই এর বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিনিয়োগ প্রস্তাব গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রক্রিয়াগত জটিলতাও আছে। প্রক্রিয়াগত এ জটিলতার নেপথ্যেও রয়েছে ভূ-রাজনীতি।
সম্পর্কিত খবর
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, যে বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো মূলত প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেই। এর সঙ্গে আছে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাও। তবে যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার থাকা দরকার। কারণ আমরা যদি দ্বিধা বা ইতস্তত বোধ করি, তাহলে বড় ধরনের বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা দুরূহ হবে। অনেক দেশই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এসব বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরো বলিষ্ঠ হতে হবে। তা না হলে শুধু চীন নয়, যেকোনো দেশই বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হবে।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঘোষণা আসে ২০০৯ সালে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়। দেশটি আগ্রহ প্রকাশ করলে একই বছর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আর্থিক সহায়তা চেয়ে চীন সরকারকে পত্র দেয়। এরপর ২০১২ সালে চীন সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশে চীনা দূতাবাস ও চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিং কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের স্থান পরিদর্শন করেন।
প্রতিনিধি দল পরিদর্শন শেষে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর ও আশপাশের এলাকায় শিল্পপার্ক স্থাপন নিয়ে একটি খসড়া পরিকল্পনাও তৈরি করে। দুই দেশের আলোচনা ও চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে বিনিয়োগ প্রস্তাবটি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জেনারেল সেক্রেটারি মো. শাহজাহান মৃধা বলেন, বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে চীনের সহযোগিতা আমরা নিয়েছি। বাংলাদেশের অনেকগুলো বড় প্রকল্প নির্মাণে চীনা কোম্পানি কাজ করছে। তবে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে কোনো বিশেষ দেশকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা একদমই নতুন। সেক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা বহু বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চান। ফলে অনেক প্রস্তাবই বাস্তব রূপ নিতে পারছে না।
বাংলাদেশে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের ২০০ কোটি ডলারের সম্পদ চীনের হিমালয় এনার্জির কাছে বিক্রয়ে চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছিল সরকার। উত্পাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) অনুযায়ী বাংলাদেশের ব্যবসা হস্তান্তর করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হলেও তা না নিয়েই চুক্তিটি করে শেভরন। চীনা প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা নিয়ে সংশয়ের কারণেও গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটিকে দিতে চায়নি সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলার মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠানটি যে গ্রহণযোগ্য নয়, শেভরনকে তা জানিয়ে দেয়া হয়। এরপরই শেভরন বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়ে দেন, শেভরন বাংলাদেশ ছাড়ছে না।
ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) নির্বাহী পরিচালক জামিল ওসমান বলেন, চীনের ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যানে বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হবে, বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পেই চীনের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগগুলোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিনিয়োগ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে কোনো ধরনের বাধা থাকলে আলোচনাসাপেক্ষে তা দূর করতে হবে। আসলে চীন হোক বা অন্য কোনো দেশ, সবার ক্ষেত্রেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারণ কোনো একটি দেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলে বিশ্বের যেকোনো দেশই বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে নিরুত্সাহিত হবে।
সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বেছে নেয়ার লিখিত প্রস্তাব বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জমা দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনা কনসোর্টিয়ামকে বাছাইসংক্রান্ত প্রস্তাবকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করছে বিএসইসির আহ্বায়ক কমিটি।
জানা গেছে, প্রস্তাবের কতিপয় ধারা ডিএসইর শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ও সংশ্লিষ্ট আইনবিরোধী বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। ডিএসইর পক্ষ থেকে সব ধরনের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও কমিটির পর্যবেক্ষণে প্রস্তাবটিতে সিকিউরিটিজ আইন, কোম্পানি আইন ও ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনবিরোধী বেশকিছু ধারা চিহ্নিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসইতে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগের ভবিষ্যত্ নেতিবাচক হতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
কৌশলগত বিনিয়োগকারী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে অর্থনৈতিক বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এগুলো না দেখে যদি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তবে তা ভুল হবে। কোনটা করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবো, সেটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। আজকে চীনের সঙ্গে যে সম্পর্ক তা একদিনে হয়নি, এ সম্পর্ক স্থাপন করতেও অনেক সময় লেগেছে। সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা সজাগ, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও কারো সঙ্গে বৈরিতার নয়। এটিকেও কাজে লাগাতে হবে। তবে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হবে এমন বিবেচনাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। চীনের বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলোয় এক ধরনের সমস্যা হচ্ছে। তবে আমি মনে করি, সবগুলোরই সমাধান দরকার। এক্ষেত্রে নিজের হোমওয়ার্কটা নিজেদেরই করতে হবে। অন্য কেউ বললে সেটাকে গ্রহণ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে নিজেদের হোমওয়ার্ক শক্তিশালী করতে হবে। এভাবে না এগোলে শুধু চীন নয়, যেকোনো দেশই বলবে, এ দেশে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক বিবেচনায় নয়, অন্য কিছু বিবেচনায় হয়। বিদেশী বিনিয়োগ এতে নিরুত্সাহিত হবে।
সূত্র: বণিক বার্তা