• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে কী খাবেন, কী খাবেন না

প্রকাশ:  ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১০:৪৫
সোনিয়া শরমিন খান

বর্তমানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের কাণে পুষ্টিবিদ হিসাবে প্রায়শই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আর তা হলো, আমার রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে গেছে। আমি কি খাব?

কিভাবে এই মাত্রা স্বাভাবিক হবে? সারাজীবন কি ওষুধ খাব? অথবা আমি কি আর ডিম বা মাংস বা ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতে পারব না?

সম্পর্কিত খবর

    আমি হেসে উত্তর দেই, অবশ্যই পারবেন। কোলেস্টেরল এর মাত্রা স্বাভাবিক ও হবে। তবে তার আগে জানতে হবে আপনার জন্য ওইসব খাবারের চাহিদার পরিমাণ। আমাদের দেহে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিনের শোষণের জন্য ফ্যাট এর প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক।

    তাই রোজ আমাদের খাদ্যে দেহের চাহিদা অনুযায়ী কিছু ফ্যাট ও ফ্যাট জাতীয় খাবার থাকতেই হবে। মূল কথায় আসি। আমাদের দেহের চাহিদার বেশির ভাগ কোলেস্টেরল লিভারে তৈরি হয়।

    তাছাড়া ফ্যাট এর মধ্যে দু’টি প্রকার আছে যার একটি প্রকার (Saturated fat, Trans fat) আমাদের দেহেই পর্যাপ্ত পরিমানে তৈরি হয় যা আমাদের খাদ্য থেকে গ্রহণের প্রয়োজন হয় না বা খুবই সামান্য গ্রহণীয়।

    আবার অন্য প্রকার ফ্যাট (Polyunsaturated fat/PUFA, Monounsaturated fat) যা খাদ্য থেকে গ্রহণ করতে হয়।

    আমরা যা খাই তার ‘রকম বা প্রকার’ এবং ‘পরিমাণ’ এই দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন খাবার বেছে নিতে হবে যাতে Saturated fats, Trans fat এর পরিমান খুব নগন্য। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণ PUFA এবং Mono un saturated fat থাকে।

    এখানে লক্ষ্যনীয় যে, PUFA এর একটি গুরুত্বপূর্ন উপাদান ওমেগা-৩ ফ্যাট, যার DHA ও EPA একাধারে আমাদের দেহে মস্তিষ্কের ও হৃদপিন্ডের সুস্থতা, খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলকে বাড়ানো, শরীরের ইনফ্লামেশন কমানো, বিশেষ কিছু হরমোনের কার্যকারিতা ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি কাজ করে থাকে।

    এর উৎকৃষ্ট উৎস হলো মাছের তেল, শীতল পানির মাছ-কর্ড, স্যালমন, টুনা মাছ, বিভিন্ন ধরনের বাদাম বিশেষ করে কাঠবাদাম বা Almond nuts, আখরোট বা Walnuts, মিষ্টি কুমড়ার বীচি, Wheat germ ইত্যাদি।

    সুতরাং দেহের সর্বোচ্চ সুস্থতার জন্য আমাদের খাদ্যে অবশ্যই ভাল ফ্যাট বেছে নিতে হবে। এখন আসি ভালো ফ্যাট আর মন্দ ফ্যাট জাতীয় খাবার কি, কিভাবে বুঝব ?

    আমাদের নিত্যদিনের খাবারে চর্বিযুক্ত গরু/ খাসির মাংস, পায়া রান্না, মুরগীর চামড়া, মগজ, মাছের ডিম, বড় মাছের মাথা, ফুল ক্রিম দুধ বা দই, ডিমের কুসুম, ঘিয়ে ভাজা বা রান্না খাবার, চিংড়ি, কাকড়া, মাখন, মার্জারিন বিশেষ করে প্রানীজ খাবারের প্রাপ্ত ফ্যাট ইত্যাদি খাবার খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা বৃদ্ধি তে সহায়ক।

    তাই এসব খাবার গ্রহণে একটু সতর্কতা অনেক বড় ক্ষতির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। যেমন- মাংস রান্নার সময় যতটা সম্ভব চর্বি ছাড়িয়ে নেয়া, ডিমের কুসুম সাপ্তাহে ৩ টির বেশি না খাওয়া (প্রতিদিন ডিমের সাদা অংশ খাওয়া যাবে), মুরগির চামড়া না খাওয়া, ডুবো তেলে ভেজে না খেয়ে শ্যালো ফ্রাই, বেক, সেদ্ধ বা পাতলা ঝোল করে রান্না করা, মাখন, মার্জারিন, মেয়নিজ, সালাদ ড্রেসিং, ঘি ও চিজ যতটা সম্ভব বাদ দেয়া, চিংড়ি ও এই জাতীয় মাছ সাপ্তাহে একবারের বেশি না খাওয়া, ফুল ক্রিম দুধ পানি মিশিয়ে পাতলা করে খাওয়া বা পাতলা দুধের টক দই খাওয়া ইত্যাদি ব্যাপার গুলো মেনে চলা জরুরি।

    এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রান্নার তেল। সাধারণত আমরা উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত তেল যা সাধারণত ভালো ফ্যাট বা PUFA এর উৎস যেমন, সয়াবিন, সরিষা, নারকেল, অলিভ, সান ফ্লাওয়ার, রাইস ব্রয়ান, ক্যানোলা ইত্যাদি তেল রান্নার কাজে ব্যবহার করি যার মধ্যে অলিভ ও ক্যানোলা তেলকে হার্টের বন্ধুস্ব্ররুপ ভাবা হয়। কিন্তু কতটুকু পরিমান তেল আমাদের জন্য যথেষ্ট,তা সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে।

    আগেই বলেছি উদ্ভিজ্জ তেলে ভালো ফ্যাট থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহণে এই ভালো ফ্যাটই আমাদের দেহে খারাপ ফ্যাট অর্থাৎ চর্বিতে পরিণত হতে পারে। যা থেকে কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারাইড এর মাত্রা বৃদ্ধি এবং হার্টের অসুখ, ওজনাধিক্য, ডায়াবেটিস, ফ্যাটিলিভার, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ইত্যাদি সহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে।

    সহজ সমাধান হলো, পরিবারের সব সদস্যের ফ্যাটের চাহিদা জেনে নেয়া। ধরে নেই একটি পরিবারে ৫ জন সদস্য আছে। সবারই যার যার বয়স, ওজন, উচ্চতা ও পরিশ্রম অনুযায়ী ফ্যাট এর চাহিদা আছে।

    মধ্যবয়স্ক একজন স্বাভাবিক পরিশ্রমের পুরুষের ক্যালরি চাহিদা ২০০০ ক্যালরি হলে, তার ২০%-৩৫% ক্যালরি ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে আসতে হবে। এই হিসাবে তার ফ্যাট এর চাহিদা ৪৪.৪৪ গ্রামের মত পরিমান হবে।

    সারাদিনের খাবারে যেহেতু ব্যাক্তিটি কিছু প্রানীজ ফ্যাট / Saturated Fat নিচ্ছেন ( যেমন, ১০০গ্রামের এক পিস চামড়া ছাড়া মুরগির বুকের মাংসে ৩.৬ গ্রাম এবং রানের মাংসে ১০.৯ গ্রাম ফ্যাট থাকে) যা তার কিছুটা ফ্যাটের চাহিদা পূরন করে ফেলে।

    ধরে নিচ্ছি সারাদিনের প্রানীজ ফ্যাটের এই পরিমান ২৪ গ্রাম হবে। তাহলে ওই ব্যাক্তির জন্য রান্নার তেল বরাদ্দ হবে সারাদিনের জন্য মাত্র ২০.৪০ গ্রাম। সুতরাং ওই ৫ সদস্যের পরিবারে আনুমানিক সারাদিনের তেলের চাহিদা ৭০ গ্রাম থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হবে যা একটি কাপ বা বাটিতে আলাদা করে প্রতি দিন ঢেলে নিয়ে এই পরিমান ঠিক রাখা যায়।

    অর্থাৎ পুরো মাসে ওই পরিবারের সব ধরনের রান্নার জন্য তেলের পরিমাণ হওয়া উচিত ২ লিটার ১০০ গ্রাম থেকে ৩ লিটার ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত। অথচ বেশির ভাগ সময় আমি আমার রুগিদের যখন জিজ্ঞেস করি, বাসায় মাসে কত লিটার তেল খান, বেশির ভাগ উত্তর ই হয় ৫ লিটার থেকে ১৫ লিটার এমন কি বিশ লিটার পর্যন্ত।

    বাড়তি তেলের ব্যবহার কমিয়ে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো অভ্যাস করে নিলেই এবং খাদ্যে জটিল কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, পর্যাপ্ত ফল ও শাক-সব্জির সমন্বয় করে নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং সাধারণ কিছু শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম এবং হাটা, সারাদিনের পানি গ্রহণের পরিমান ঠিক রাখা ইত্যাদি মেনে চললেই কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেকাংশেই স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। সূত্র: একুশে টিভি


    লেখিকা: নিউট্রিশনিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান

    কার্বোহাইড্রেট,কোলেস্টেরল
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close