• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

কিডনি রোগের চ্যালেঞ্জ ও কিংবদন্তি ডা. হারুন

প্রকাশ:  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০১:২০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

বিদেশ থেকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কিডনির রোগে পিএইচডি করেছেন। দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনও তাঁর হাতেই শুরু। বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি ইউনিটের আধুনিকায়ন করেছেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি অ্যান্ড নিউরোলজি হাসপাতালটি তাঁরই গড়া। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের চিকিত্সার জন্য কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদের জীবনের গল্প পড়ুন।

মেডিক্যালে গেলেন কী করে?

সম্পর্কিত খবর

    ম্যাট্রিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট হিসাবে আমার জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৪ এপ্রিল পাবনার রাঘবপুরে। ১৯৬১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করি। পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় মেডিক্যালে পড়ব বলে ফিজিকস, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়েছি। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিভাগে মেধাতালিকায় ১৮তম হয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। এরপর মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার জন্য একাই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে চলে গেলাম। ছোটবেলায় স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল বলে রাজশাহী মেডিক্যালের অধ্যক্ষ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন আমাকে দেখেই বললেন, ‘তোমার যে স্বাস্থ্য, মেডিক্যালে পড়তে পারবে তো? বাবা তো স্কুলশিক্ষক, লেখাপড়ার এত খরচ জোগাড় করতে পারবে?’ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় মেডিক্যালে লেখাপড়ার খরচ অনেক। হোস্টেলে থাকতে হয়, দামি বই কিনতে হয়। আমি বললাম, ‘স্যার, আমি তো বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছি। ফলে ডিপিআই স্কলারশিপ পাব। বৃত্তি ও বাবা যেটুকু সাহায্য করবেন, তাতে হয়ে যাবে। ’ আমার আগ্রহ, খুব ভালো ছাত্র দেখে তাঁরা আমাকে ‘ফিট’ লিখে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিলেন।

    জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান ও অধ্যাপক ডা. এ কে খান আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের রোগীর সঙ্গে ব্যবহার, সময়ানুবর্তিতা, জীবনাচরণ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মেডিক্যালের ভাষায় ৮০ শতাংশের ওপরে নম্বর পেলে ‘অনার্স’ বলা হয়। এমবিবিএস পরীক্ষায় ‘মেডিসিনে’ অনার্সে ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়ে ছিলাম। গাইনি, সার্জারিতেও ৭০ শতাংশের বেশি পেয়েছি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়ায় আমাকে ‘ফাইজার গোল্ড মেডেল’ দেওয়া হয়েছে। মেডিসিনে প্রথম হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ‘চ্যান্সেলরস অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করেছে। ১৯৬৩ সালে পুরো রাজশাহী বিভাগে—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম।

    কর্মজীবনের শুরু? তখন এমবিবিএস পাসের পর ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার’ হিসেবে কাজ করার নিয়ম ছিল। পদটিকে ‘ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ বলা হতো। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দুই বছর অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করলাম। দুই বছর ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকার পর মেডিসিনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করারও নিয়ম ছিল। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য ঢাকায় এসে তত্কালীন আইপিজিএমআর (ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল রিসার্চ, এখন বিএসএমএমইউ) মেডিসিনে ‘এফসিপিএস’ করলাম। আইপিজিএমআরে ১৯৭৪-৭৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের অধীনে রেজিস্ট্রার ছিলাম। তাঁর অধীনে গবেষণা করতাম। তখন গরু-ছাগলের ‘একিনোকক্কাস’ রোগের জীবাণু যাতে মানুষের মধ্যে না ছড়ায় সেটি নিয়ে গবেষণা করেছি এবং সে ফলাফল লন্ডনের পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আমাকে তাঁর গবেষণাপত্রও লিখতে হতো, রোগী দেখতে হতো। তিনি প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত রোগীদের বাসায় দেখতে যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তখন অনেক বড় মানুষ—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুত্ফর রহমানের মতো রোগী দেখতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাবা আইপিজিএমআরের ভিআইপি কেবিনে অনেক দিন ভর্তি ছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েও তাঁকে চিকিত্সা দিয়েছি। ১৯৭৪ সালে এফসিপিএস পাস করলাম। পরে আমাকে কুষ্টিয়ার একটি সাব-সেন্টারে বদলি করে দেওয়া হলো; কিন্তু নুরুল ইসলাম সাহেব যেতে দেননি। নিজের কাছে রেখে দিলেন। তিনিই আমার ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছেন।

    কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ব্রিটেনে গেলেন কবে? আগের নিয়ম বাতিল করে তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুন নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন—কমনওয়েলথ স্কলারশিপে ছয় মাস, এক বছরের জন্য চিকিত্সকদের ব্রিটেনে প্রশিক্ষণের জন্য না পাঠিয়ে তিন বছরের জন্য পাঠানো হবে। তাঁরা পিএইচডি করে দেশে ফিরবেন। ফলে ১৯৭৭ সালের ৫ জানুয়ারি আমরা পিএইচডি করতে গেলাম। আমার সঙ্গে মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান বায়োকেমিস্ট্রিতে এমফিল করতে গেলেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। আমি নিউক্যাসেল আপ-অন-টাইনের ট্রেনে চলে গেলাম রয়াল ভিক্টোরিয়া ইনফার্মারিতে। নিউক্যাসেল আপ-অন-টাইন এনএইচএন ট্রাস্ট্রের অধীনে এই রেফারাল হাসপাতালটি আছে। সেখানে অধ্যাপক ডা. ডেভিড কার আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি হাসপাতালের ইন্টার্নাল মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। মেডিসিনের অধ্যাপক হলেও নেফ্রোলজি মানে কিডনি রোগের চিকিত্সা করতেন, নামকরা কিডনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর কাছেই আমার কিডনি রোগের চিকিত্সার হাতেখড়ি। তিনি আউটডোরে রোগী দেখছিলেন। এক রোগীকে দেখিয়ে বললেন, ‘ব্লাড প্রেসার মাপো। ’ চেক করলাম। রোগী দেখা সেরে তিনি নিজে মূত্র নমুনার টেস্টটিউবগুলো হাতে নিয়ে তাঁর ওয়ার্ডের দিকে রওনা করলেন। আমি পেছনে চললাম। সেগুলো রেখে তিনি বললেন, ‘তুমি বসো। ’ টিউবগুলো হাতে নিয়ে নিজেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করা শুরু করলেন। ১০-১২টি নমুনা পরীক্ষার পর দেড়টা সময় বললেন, ‘চলো মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে ফেলি। হাত পরিষ্কার করো। ’ খাওয়া শেষে বললেন, ‘কাল থেকে সকাল ৯টায় আসো। ওয়ার্ডে রাউন্ড দাও। আউটডোরে যাও। ’ মাস দুই-তিনেক কাজ করার পর বললেন, ‘এখন থেকে ইউরিনগুলো পরীক্ষা করো। ’ মূত্র নমুনা পরীক্ষা করা শুরু করলাম। দুই-তিন সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পর যখন বুঝলেন, ভালোভাবেই কাজ করছি, তিনি আমাকে তাঁর রোগী দেখার অনুমতি দিলেন। ফলে আউটডোরে স্বাধীনভাবে রোগী দেখা শুরু করলাম।

    পিএইচডিতে ভর্তি হলেন কিভাবে?

    দেড় বছর পেরোনোর পর প্রফেসর ডেভিড কার বললেন, ‘তুমি একটি ডিগ্রি নাও। নিয়ম হলো, প্রথমে এমফিল, পরে পিএইচডি করতে হয়। তবে তিনি আমাকে সরাসরি তাঁর অধীনে পিএইচডিতে ভর্তি করে নিলেন। কমনওয়েলথ বৃত্তির সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে তিনি আমাকে পিএইচডি শেষ করার জন্য নিউক্যাসেল আপ-অন-টাইন হাসপাতালে একটি চাকরিও দিয়েছিলেন। আমার পিএইচডির বিষয় ছিল—‘ইটিওলজি অব নেফ্রাইটিজ (কিডনি রোগের কারণ)। ’ তিনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন। নিউক্যাসেল আপ-অন-টাইনে তিন বছরে নেফ্রোলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বাকি দুই বছর নেফ্রোলজিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। পিএইচডি শেষ করার সময় গ্রিসে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজির বৈজ্ঞানিক সভা ছিল। সেখানে চারটি গবেষণাপত্র জমা দিয়েছিলাম। সেগুলো উপস্থাপনের জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন এবং জীবনের প্রথম দুটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করলাম। রয়াল সোসাইটি অব মেডিসিনের বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সভায় তাঁদের আমন্ত্রণে ১৫ মিনিটের বক্তৃতাও দিয়েছি। এ ছাড়া ইউকে রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, রয়াল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অব এডিনবরায়ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি।

    ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে দেশে ফিরে আইপিজিএমআরে যোগ দিলাম। তখন অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মেডিসিনের অধ্যাপক হলেও নেফ্রোলজির রোগী বেশি দেখতেন। আইপিজিএমআরে তাঁর নেফ্রোলজি ইউনিটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলাম। এই ইউনিটের মাধ্যমেই এ দেশে কিডনি রোগের চিকিত্সা শুরু হয়েছে।

    এ দেশে আপনি কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোক্তা। হ্যাঁ। ১৯৮১ সালের অক্টোবরে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগী জোগাড় করলাম। এই রোগীর কিডনি অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। তিনি বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করতেন। তাঁর বোন চট্টগ্রামে থাকতেন। তিনিই ভাইকে কিডনি দান করেছিলেন। এখনকার মতো তখন মেশিনে কিডনি ডায়ালিসিস করা যেত না। আমরা পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের মাধ্যমে রোগী বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। এই রোগীকেও সেভাবে অপারেশনের উপযোগী করে তুললাম। তাঁদের দুজনের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হলো। এরপর টিস্যু টাইপ করা হলো। আমার সঙ্গে অধ্যাপক মতিউর রহমান ছাড়াও অধ্যাপক ডা. এম এ ওহাব, অধ্যাপক ডা. গোলাম রসুল ও মেজর জেনারেল ডা. সিরাজ জিন্নাত ছিলেন। আইপিজিএমআরে সেই রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন করা হলো। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং অপারেশনটি সফল হওয়ার পর খুব হৈচৈ পড়ে গেল। অনেক পত্রিকায় খবরটি ছাপা হলো। ১৯৮৮ সালে আইপিজিএমআরে নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের চিকিত্সা শুরু হলো। ১৯৯৪ সালে বারডেমে শুরু হলো। এরপর সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি, কিডনি ইনস্টিটিউট, কিডনি ফাউন্ডেশন, ইউনাইটেড, পপুলারসহ আরো অনেক হাসপাতাল চিকিত্সাসেবাটি শুরু করল। তারা সবাই প্রথম দিকে আমাদের পরামর্শ ও সাহায্য নিয়েছে।

    কিডনি রোগের চিকিত্সার উন্নতি কিভাবে ঘটালেন? আগে আমাদের দেশে কিডনি অকার্যকর হলে রোগীরা মারা যেত। আমরা পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের মাধ্যমে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসে পেটে ক্যাথেটার দিয়ে দুই লিটার বিশুদ্ধ পানি (পেরিটোনিয়াল ফ্লুইড) ঢুকিয়ে প্রতি ১৫-২০ মিনিট পর পর সেই পানি বের করে আবার নতুন পানি ঢুকানো হয়। এভাবে ৪৮ ঘণ্টায় দুই লিটার পানি ঢুকানো ও বের করা হয়। ফলে রোগীর রক্তে জমে থাকা আবর্জনা পানির মাধ্যমে বেরিয়ে আসে এবং সে সুস্থ বোধ করে। তবে ৪৮ ঘণ্টা পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের পরও রোগী মাত্র তিন থেকে চার দিন সুস্থ থাকলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই পদ্ধতির আরো উন্নত ব্যবস্থা ‘কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিস (সিএপিডি)। এতে রোগী স্বাভাবিক কাজ এমনকি অফিসও করতে পারে। আমরা একে ‘হোম ডায়ালিসিস’ বলি। ছোট থেকে শুরু করে ৮০ বছরের রোগীও এই পদ্ধতিতে নিজে ডায়ালিসিস করতে পারেন এবং বছরের পর বছর সুস্থ জীবনযাপন করেন। হূদরোগ, ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটি নিরাপদ চিকিত্সাপদ্ধতি। ১৯৮২ সালেই আইপিজিএমআরে আমরা প্রথমবারের মতো সিএপিডি চালু করলেও সিএপিডি ফ্লুইডের অভাবে পদ্ধতিটি চালু রাখতে পারিনি। সেটি এখন আমাদের হাতপাতালে আবার শুরু করেছি এবং কয়েক হাজার রোগী বেঁচে আছে।

    ১৯৮৬ সালে আইপিজিএমআরে ‘হেমোডায়ালিসিস’ ইউনিট খোলা হলো। দুই বছর পর হেমোডায়ালিসিস করা শুরু হলো। ওখানে কিডনি রোগীদের জন্য ৯ শয্যার ইউনিট ছিল। ধীরে ধীরে সেটিকে ১৪ শয্যায় উন্নীত করা হলো। ১৯৮৬ সালে আমি ও অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মিলে কিডনি রোগে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ‘এমডি’ কোর্স চালু করলাম। আমাদের প্রথম ছাত্র অধ্যাপক ডা. ফিরোজ খান। আমরা দুজনে মিলে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিডিজ অ্যান্ড ইউরোলজি’র প্রজেক্ট পেপার তৈরি করলাম। তিনি অবসরের পর সরকার আমাকে এই প্রকল্পের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করল। ঢাকার শ্যামলীর এই হাসপাতালটি আমার হাতে গড়া।

    বাংলাদেশে প্রথম কিডনি রোগীদের বিশেষায়িত এই হাসপাতাল কিভাবে গড়ে তুলেছেন? ১৯৯১ সাল থেকে আমি অতিরিক্ত দায়িত্বে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিডিজ অ্যান্ড ইউরোলজির প্রকল্প পরিচালক ছিলাম। ১৯৯২ সালে অধ্যাপক হলাম। সাত বছরের মধ্যে আমরা ৩০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালটি তৈরি করেছি। সেখানে আউটডোর ডায়ালিসিস ইউনিট, সিএপিডি, হেমোডায়ালিসিস ইউনিট, ল্যাবরেটরি সার্ভিস, কিডনি প্রতিস্থাপনসহ কিডনি রোগীদের সব সুযোগ-সুবিধা চালু করে দিয়ে এসেছি। হাসপাতালের প্রথম পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। আমি থাকা অবস্থায়ই আউটডোরে রোগী দেখা শুরু হলো। তবে ইনডোর সার্ভিস চালু করার আগেই ১৯৯৮ সালে আমাকে পিজি হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করা হলো। এর পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর আমার সব মেধা ও শ্রম পিজি হাসপাতালের কিডনি বিভাগের উন্নতির পেছনে ব্যয় করেছি। নেফ্রোলজি ইউনিটকে প্রসারিত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। ১৫ শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিট চালু করেছি। প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজন রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা শুরু করেছি।

    কিডনি রোগীদের জন্য বাংলাদেশ সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লানটেশনসহ নানা সংগঠন গড়েছেন। যেহেতু আমাদের দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কোনো আইন ছিল না, ফলে আমরা কয়েকজন মিলে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে ‘অর্গান অ্যাক্ট ল’ তৈরিতে সাহায্য করেছি। ১৯৯১ সালে আইনটি সংসদে পাস হয়েছে। এর পর থেকে এ আইনটির অধীনে এই পর্যন্ত এক হাজার ৫০০-এরও বেশি রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন সফলভাবে করা সম্ভব হয়েছে। আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বিপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচানোর উদ্যোগও নিয়েছি। সে জন্য যাঁরা আইসিইউতে মারা যান, অন্য রোগীদের শরীরে তাঁদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য সরকারকে আইন তৈরির জন্য পরামর্শ দিয়েছি। সে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ সভায় পাস হয়েছে। সংসদে পাস হওয়ার মাধ্যমে সেটি আইনে পরিণত হবে। ২০০৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি ‘বাংলাদেশ সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লানটেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এখনো এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এটির মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীদের সচল হূিপণ্ড, কিডনি, লিভার ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অচল রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপন করে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ঢাকা মেডিক্যাল ও বিএসএমএমইউর আইসিইউতে গবেষণায় আমরা দেখেছি, ২৫ শতাংশ মৃত রোগীর আত্মীয় অনুরোধ করলে কিডনি দান করতে রাজি হন। এ ছাড়া আমার উদ্যোগে ১৯৮১ সাল থেকে ‘বাংলাদেশ রেনাল জার্নাল’ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। নেফ্রোলজির উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে ছাত্র-ছাত্রীদের এমডি ডিগ্রি অর্জনের সময় থিসিস পেপার লিখতে হয়। সেখানে তারা কী গবেষণা করেছে, সেটিই এই প্রকাশনায় ছাপা হয়। এ দেশে কিডনি রোগের চিকিত্সা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধগুলোও জার্নালটিতে প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি এটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম। বাংলাদেশ রেনাল জার্নালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে আমার লেখা ১৫৫টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। আমার লেখা পাঁচটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ রেনাল জার্নালের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছি। তবে বেশির ভাগ কাজ সম্পাদকরাই করেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। এটির মাধ্যমে আমি ইউনাইটেড স্টেটস রেনাল ডাটা সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। এরপর এক যুগ ধরে আমার দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে তারা এ দেশে বছরে কত রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন, ডায়ালিসিস, সিএপিডি করা হচ্ছে সে হিসাব প্রকাশ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেরই এই রোগের চিকিত্সার তথ্য ইউনাইটেড স্টেটসে রেনাল ডাটা সিস্টেমে আছে।

    কিডনি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা কেন করলেন? সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আমার মনে হলো, দেশের হাজার হাজার গরিব কিডনি রোগীর জন্য একটি অলাভজনক হাসপাতাল করা প্রয়োজন। এ দেশে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোগীর কিডনি অকার্যকর হয়। তাদের মধ্যে মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশকে কিডনি ডায়ালিসিসের মাধ্যমে চিকিত্সা দেওয়া সম্ভব হয়। বাকিরা চিকিত্সার অভাবে মারা যায়। এসব রোগীর বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ। এদের জন্য অলাভজনক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ভাবনা থেকে ২০০৩ সালে ঢাকার ধানমণ্ডির ৯ নম্বর সড়কে আমরা একটি বাসা ভাড়া নিলাম। তখন আমাদের সম্বল মোট ৭৫ হাজার টাকা। তিন বন্ধু ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে অধ্যাপক ডা. এম এ ওয়াহাব, অধ্যাপক ডা. মুহিবুর রহমান ও অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন ছিলেন। কর্মচারী ছিল ৯ জন। ছয় শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিট চালু করে মাত্র ৯০০ টাকায় ডায়ালিসিস করা হতো। আউটডোর পেশেন্ট সার্ভিসে ১৫০ টাকায় রোগী দেখতাম। ল্যাবরেটরি সার্ভিস ছিল। হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরি সার্ভিসে ৩০ শতাংশ ছাড় ছিল। হাসপাতালটির সুনাম ছড়িয়ে গেলে আমরা ধনাঢ্য ব্যক্তি, ব্যাংক, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুদান পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রায় এক কোটি টাকা ও রবিন ফাউন্ডেশন ৩৫ লাখ টাকা অনুদান দিল। সে টাকায় হাসপাতালকে বড় পরিসরে নিয়ে আসতে ২০০৬ সালে ধানমণ্ডির ৮ নম্বরে চলে গেলাম। ১৫ শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিট, ৩০ শয্যার হাসপাতাল চালু হলো। আউটডোর, ল্যাবরেটরি সার্ভিসও সম্প্রসারিত হলো। হাসপাতাল পরিচালনা করতেন টাইনি ফেরদৌস রশিদ। তিনি আমার স্ত্রী। তাঁকে খুব অনুরোধ করে বলেছিলাম, ‘আমাকে রোগী দেখতে হয়, অনুদান জোগাড় করতে হয় বলে প্রশাসনিক দিকটি দেখতে সময় পাই না। তুমি সাহায্য করো। ’ সে বিনা বেতনে প্রশাসনিক কাজগুলো করা শুরু করল। এখনো সে অবৈতনিক ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কিডনি ফাউন্ডেশনে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে আরো অনুদানের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে গেলাম এবং ভালো সাড়া পেলাম। তখন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১০টায় ফিরতাম। ঘুরে ঘুরে আমাকে ১০ থেকে ১১ কোটি টাকা অনুদান জোগাড় করতে হয়েছে। সরকার মিরপুরে দুই বিঘা জমি বরাদ্দ করল। ২০০৮ সালে কাজ শুরু করে তিন বছরের মধ্যে আমরা হাসপাতাল তৈরি করলাম। ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নিইনি। সরকার অনুদান হিসেবে ছয় কোটি টাকা দিল, বাকি ১০ কোটি টাকা বেসরকারি অনুদান পেলাম। ঢাকা ব্যাংক দুই কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ও ব্র্যাক ব্যাংক ৫০ লাখ টাকাসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আমাকে অনুদান দিয়েছে। সে টাকায় ভবন হলো। ভবন তৈরির টাকার জন্য লটারি চালু করে ৫০ লাখ টাকা পেয়েছি। ব্যক্তিগত অনুদান যেমন পেয়েছি, তেমনি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজসহ বহু প্রতিষ্ঠান ও গণ্যমান্য লোক ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছেন। কেউ আমাকে ফেরাননি।

    হাসপাতালে কী কী সেবা আছে? ‘কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এ এখন প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। নেফ্রোলজির তিনজন পূর্ণকালীন অধ্যাপক, সহযোগী, সহকারী মিলিয়ে ৩০-৪০ জন চিকিত্সক; ডায়ালিসিস নার্স, টেকনিশিয়ান তো আছেই। ৬০ শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিটে তিন শিফটে প্রতিদিন ১৮০ জন রোগীর ডায়ালিসিস করা হয়। কোনো একক প্রতিষ্ঠানে এত বড় ডায়ালিসিস ইউনিট বিশ্বে বিরল। ডায়ালিসিসে প্রথম দিকে দুই হাজার ৩০০ টাকা করে নেওয়া হলেও এখন এক হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। অন্য হাসপাতালগুলোতে এ জন্য তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। এখানে প্রায় ৫০০ রোগী নিয়মিত ডায়ালিসিস করান। প্রথম দুই বছর ডায়ালিসিস করার পর গরিব রোগীরা আজীবন বিনা খরচে হাসপাতালে ডায়ালিসিস করতে পারেন। আমরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করি। ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০০ কিডনি প্রতিস্থাপন আমরাই করেছি। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য রোগীপ্রতি দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা নিই। অন্য বেসরকারি হাসপাতালে এ জন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ খরচ হয়। বয়স্ক, কর্মজীবীদের হোমডায়ালিসিস সুবিধা দিই। স্পেশাল ক্যাথেটার ইমপ্ল্যান্ট করে সিএপিডি করি, যাতে তাঁরা বাড়িতেও ডায়ালিসিস করতে পারেন। এই সুবিধা বাংলাদেশে মাত্র দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত ৪০০টি সিএপিডি করেছি। প্রতিবছর আমরাই সবচেয়ে বেশি হোমডায়ালিসিস করি। আমাদের ৩০ শতাংশ শয্যায় গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিত্সা দেওয়া হয়। আমাদের আউটডোরে ডায়ালিসিস ও ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক ফি মাত্র ১০০ টাকা। তাদের জন্য ল্যাবরেটরি চার্জে ৫০ শতাংশ ছাড় আছে। এখানে অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে নতুন রোগীদের ৫০০ ও পুরনো রোগীদের মাত্র ৪০০ টাকা ফি দিতে হয়। সহযোগী অধ্যাপকের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিবছর আমরা কিডনির রোগ ও চিকিত্সার সাম্প্রতিক চিত্র নিয়ে বুকলেট প্রকাশ করি। এসব উদ্যোগের কারণে ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কিডনি ফাউন্ডেশনস বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘জোয়েল ডি ক্যাপল অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে। তারা আমাদের ‘রেফারেন্স হসপিটাল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

    আর কোনো উদ্যোগ? যৌথ গবেষণার জন্য রয়াল লন্ডল হাসপাতাল, ইউকে আমাদের সঙ্গে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ওয়েন ইউনিভার্সিটির সঙ্গেও আমাদের এমওইউ আছে। তারা আমাদের ডায়াবেটিস, কিডনি ও ডায়ালিসিস রোগীদের নিয়ে গবেষণা করবে। এখানে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়েন ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক পিএইচডি করছেন। এ বছর ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজি আমাদের হাসপাতালকে ‘সিস্টার সেন্টার হসপিটাল’ হিসেবে মনোনীত করেছে। ফলে তাদের বিশেষজ্ঞরা এখানে এসে আমাদের ডাক্তার, নার্সদের প্রশিক্ষণ দেবেন, তাদের খরচে আমরা উন্নত বিশ্বে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারব। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় আমরা কিডনি ফাউন্ডেশনের শাখা খোলার উদ্যোগ নিয়েছি। পাবনার বনগ্রামে ৫০ শয্যার প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে আমাদের শাখা আছে। সেখানে ৫০ শয্যার হাসপাতাল হয়েছে। ১০ শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিটে প্রতিদিন ২০ জন রোগীর ডায়ালিসিস করা হয়। সেখানে ৫০-৬০ জন ডায়ালিসিস রোগী মূল শাখার মতোই কম টাকায় চিকিত্সা পান। স্থানীয় কমিটি এই হাসপাতাল পরিচালনা করে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ শহরে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে শাখা চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে সিলেটে ৫০ শয্যার হাসপাতাল চালু করতে ‘এমওইউ’ স্বাক্ষর করেছি। ঢাকার নবাবগঞ্জে ২৫ শয্যার হাসপাতাল করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করি, সরকার এতে আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবে। দেশের প্রধান প্রধান জেলায় কিডনি ফাউন্ডেশনের হাসপাতালের শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নেফ্রোলজি’তে গত বছর আমাদের হাসপাতালের পুরো কার্যক্রম প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য, সারা দেশের কিডনি রোগ নিয়ে গবেষণা করব, এ রোগের প্রতিকারের চিকিত্সা ছড়িয়ে দেব। ঢাকার ভবনটিকে আরো তিন তলা বর্ধিত করব। ১৫০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় নিয়ে যেতে চাই। ডায়ালিসিস ইউনিটে আরো ৬০ শয্যা সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

    নিম্নবিত্ত রোগীদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেবেন? এ দেশে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী আছে। এ রোগের প্রধান কারণ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নেফ্রাইটিস। এসব রোগে ভুগে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোগীর কিডনি অকার্যকর হয়ে যায়। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন রোগীদের জন্য আমাদের হাসপাতালে ডায়ালিসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনসেবা পুরো বিনা মূল্যে দিতে চাই। সাধারণ মানুষ, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সাহায্য করলে সেটি সম্ভব হবে। গত বছর যাকাত হিসেবে ৩৫ লাখ টাকা পেয়েছি। তার আগের বছরও তেমন অঙ্ক পেয়েছি। কেউ পাঁচ টাকা দান করলেও আমি তা সানন্দে নিই। চেকের ওপর ‘কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, মিরপুর, ঢাকা’—এই ঠিকানা লিখলেই আমরা চেক পেয়ে যাব। সাধারণ মানুষের সহযোগিতাই আমার সম্বল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের সিন্ধ ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টেশন (এসআইইউটি) সবচেয়ে বেশি কিডনি ডায়ালিসিস ও প্রতিস্থাপন করে। তারা বড় বড় ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষের দানের টাকায় বিনা মূল্যে এই সেবা দেয়। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা লাভও করি না, লসও করি না। সর্বোচ্চ কম খরচে রোগীদের সেবা দিয়ে তাদের টাকায় আমাদের হাসপাতালটি চলে।

    বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তো জড়িয়ে আছেন। এই বয়সেও কাজ ছাড়া থাকতে পারি না। ফলে আমি বারডেমের ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের মেম্বার, বিআইএইচএস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজির সাউথ এশিয়ান রিজিয়নের কো-চেয়ার ছাড়াও ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল জার্নাল, সার্ক ইউরোলজি অ্যান্ড নেফ্রোলজি জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছি। ‘ওয়ার্ল্ড কিডনি ডে’র সাউথ এশিয়ান রিজিয়নের চ্যাম্পিয়নের কাজ করছি। এশিয়ান সোসাইটি অব ট্রান্সপ্লানটেশনের কাউন্সিলর, এশিয়ান সোসাইটি অব পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের কোর-বডি মেম্বারের দায়িত্ব পালন করছি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজির কাউন্সিলর থাকব। আমরা ১৯৮২ সালে ঢাকায় সভা করে ‘সার্ক অ্যাসোসিয়েশন অব নেফ্রোলজি অ্যান্ড কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সোসাইটি’ গঠনের প্রস্তাব পাস করেছিলাম। টানা পাঁচ বছর এটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এবং ২০০৭-০৮ সালে সভাপতি ছিলাম। সার্কের প্রতিটি দেশে আমরা নেফ্রোলজির সভা, সেমিনার, কনফারেন্স করেছি।

    জীবনের প্রান্তসীমায় এসে চাওয়া-পাওয়া? সম্পদশালী পরিবার থেকে আসিনি বলে ডাক্তারি পড়তে আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ডিপিআই স্কলারশিপের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়েছে। এত কষ্ট করার কারণ—ছোটবেলা থেকে আমার খুব ইচ্ছা ছিল, মানুষের উপকার করব। জীবন যেভাবে শুরু করেছিলাম, মানুষের ভালোবাসা আমাকে যা ফিরিয়ে দিয়েছে, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট। আমার জীবনে প্রত্যাশার চেয়েও প্রাপ্তি বেশি। বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি ও ট্রেনিং নিয়ে আসা প্রথম কিডনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে বিবেচনা করতে পারেন। এ দেশে কিডনি বিষয়ের প্রায় সব চিকিত্সকই আমার শিক্ষার্থী। ‘কিডনি রোগের চিকিত্সা ও প্রতিকার’ নামে সাধারণ মানুষের উপযোগী একটি বই লিখেছি। এ বিষয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে শতাধিক লেকচার দিয়েছি। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ান বাংলাদেশ’ এবং ‘নেফ্রোলজি, ইউরোলজি অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট সোসাইটি অব সার্ক কান্ট্রি’ ২০০৫ সালে কিডনি রোগের চিকিত্সায় অসামান্য অবদানের জন্য আমাকে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। ‘বিএমএ নর্থ আমেরিকা’ও বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছে। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজি এ বছর আমাকে ‘পাইওনিয়ার নেফ্রোলজিস্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করেছে।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close