• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ষোড়শ সংশোধনী: রিভিউ প্রক্রিয়া শুরু

পুরো রায় বাতিল চাইতে পারে সরকার

প্রকাশ:  ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১১:২৩ | আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১১:৩৮
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ে সরকার ও দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুরো রায়টি বাতিল চেয়ে রিভিউ আবেদন করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন না করে ‘মার্জনা’ আবেদনসহ পরে যে কোনো সময় এটি করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন সরকারদলীয় সিনিয়র আইনজীবীরা। যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলছেন, তিনি ৩০ দিনের মধ্যেই আবেদন করতে পারবেন। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় প্রকাশের ২ মাস ১০ দিন পর ১০ অক্টোবর সরকার রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এটা ৭৯৯ পৃষ্ঠার। রায়টা অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’। আমরা চেষ্টা করব ৩০ দিনের মধ্যেই রিভিউ পিটিশন দাখিল করার। কিন্তু সেটা যদি না পারি আমাদের ‘বিলম্ব মওকুফের’ আবেদন করতে হবে। তিনি যুগান্তরকে আরও বলেন, রিভিউ পিটিশনের বিষয়ে কাজ চলছে। আইনজীবীরা বিষয়টি দেখছেন। তারা এ নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। পুরো রায়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে রিভিউ আবেদন করা হবে।

রায় প্রকাশের পর জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রীকে এ রায়ের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা দিয়ে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস হয়। সে কারণে এ বিষয়ে তিনি আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চান বলে জানা গেছে। তবে রিভিউ আবেদনটি করবেন অ্যাটর্নি জেনারেল। ১০ অক্টোবর রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেয়েছে সরকার। রায়ের কপি পাওয়ার দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করার বিধান। সে হিসাবে ১০ নভেম্বরের মধ্যেই সরকারকে রিভিউ করতে হবে। তবে এ সময়ের মধ্যে রিভিউ করা হবে কিনা তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

সম্পর্কিত খবর

    সূত্র জানায়, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আইনমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে যোগ দিতে আজ শনিবার দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তিনি কবে ফিরবেন তা জানা যায়নি। তবে তিনি দেশে ফেরার আগে রিভিউ আবেদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত যে হবে না, তা জোর দিয়েই বলা যায়।

    রিভিউ কবে নাগাদ করা হতে পারে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আশা করি ৩০ দিনের মধ্যেই আমি রিভিউ আবেদন করতে পারব। এর জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কবে বা কোন তারিখে করব সেটা বলতে পারছি না।

    এদিকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে রিভিউয়ের বিষয়ে মতামত নিতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ের অন্তত ৭ জন আইনজীবীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা পুরো রায়টি পর্যালোচনার পর নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। তারা বলেছেন, রিভিউয়ের মাধ্যমে রায় বাতিলের দৃষ্টান্ত আছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাশের দেশ ভারতেও অনেক রায় রিভিউয়ের মাধ্যমে বাতিল হয়েছে। রিভিউ আবেদন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সময়ে করা হবে নাকি আগামী ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার পর করা হবে তা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিমত আছে। তবে রিভিউতে রায় বাতিলের আবেদন করার বিষয়ে প্রায় সবাই একমত পোষণ করেছেন।

    সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ বলেন, ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ পিটিশন করতে না পারলে বা ৩০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলে ‘দেরি মওকুফের’ আবেদনসহ রিভিউ করা যাবে। রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে রিভিউ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আবেদনে যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে হবে। রায়টা আইন অনুযায়ী হয়নি উল্লেখ করে রিভিউয়ের মাধ্যমে রায় বাতিল চাওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ।

    সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু জানান, ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করার নিয়ম। এ সময়ের মধ্যেই করতে হবে। তিনি বলেন, রায়ে এমন কিছু পর্যবেক্ষণ আছে যাতে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সংসদ এবং নির্বাচন কমিশনকে কটাক্ষ করা হয়েছে। এগুলো বিচার্য বিষয় ছিল না। বিচার্য বিষয় ছিল ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যতার জন্য বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের হাতে থাকা। সুপ্রিমকোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। আর এই রায় দিতে গিয়ে তিনি (প্রধান বিচারপতি) অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে এসেছেন পর্যবেক্ষণে। এখন এসব পর্যবেক্ষণ বাতিল চেয়ে রিভিউ করা হবে।

    সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, আমরা রায়ের রিভিউর বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য শিগগিরই বসব। রায়ে যেসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে টেনে আনা হয়েছে সেগুলো বাতিলের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে রায়ে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়েছে এবং সংসদকে ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে- তাই মূল রায়টার ব্যাপারে কি করা যায় তা নিয়ে আমরা ভাবছি। তিনি বলেন, আমি মনে করি শুধু পর্যবেক্ষণগুলো প্রত্যাহারই নয়, পুরো রায় বাতিল চেয়ে রিভিউ করা উচিত। প্রধান বিচারপতি ছুটিতে আছেন উল্লেখ করে আবদুল বাসেত মজুমদার আরো বলেন, তিনি (প্রধান বিচারপতি) এখনও পদে আছেন। নিয়ম অনুযায়ী যে কোর্ট রায় দেন সে কোর্টেই রিভিউ করতে হয়। আমি মনে করি, তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তার কোর্টে রিভিউ করা ঠিক হবে না।

    বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহবায়ক সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, আমরা রায়ের মধ্যে আপত্তিকর পর্যবেক্ষণগুলো বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি। রিভিউ আবেদনে রায় ও পর্যবেক্ষণ দুটোই বাতিল চাওয়া হতে পারে বলে আভাস দিয়ে তিনি বলেন, রিভিউ করার পর রায় বাতিলের অনেক নজির আছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতে এ নজির আছে। রিভিউ ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১০ নভেম্বর বা এরপর যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন তার কাছেই আবেদন করা যাবে।

    আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক স.ম রেজাউল করিম বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে রিভিউ ফাইল করা হবে। এতে যদি বিলম্ব হয় তবে ‘বিলম্ব ব্যাখ্যা’ দিয়ে মওকুফের আবেদন করা হবে। বর্তমান প্রধান বিচারপতির সময়ে রিভিউ করার বিষয়ে জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, উনার (এসকে সিনহা) কাছে রিভিউ করতে আপত্তি নেই। প্রথম অবস্থায় ভাবছি শুধু বিতর্কিত পর্যবেক্ষণগুলো বাতিলের আবেদন করব। তবে পুরো রায়টি নিয়ে রিভিউ করার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।

    প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে এক স্থানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।’

    ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। রায়ে কড়া সমালোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’র সংস্কৃতির। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরাও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তাদের অভিমত তুলে ধরেন রায়ে। এরপরই ওই রায় ও রায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা।

    এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। পাশাপাশি রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া পর্যবেক্ষণও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানান। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ১০ অক্টোবর রায়ের সার্টিফায়েড কপি পায় সরকার। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা প্রথমে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি নেন। পরে চিকিৎসার জন্য ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকবেন বলে আবারও আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি তাতে অনুমোদন দেন। সে হিসেবে তার বর্ধিত ছুটি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। ১১ নভেম্বর থেকে ফের কার্যভার গ্রহণ করার কথা।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close