• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

১৫ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় গাজীপুর

প্রকাশ:  ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৩২ | আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৪২
মাহমুদুল হাসান, গাজীপুর

আজ ১৫ ডিসেম্বর। গাজীপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন বিজয় লাভের ঠিক একদিন পূর্বে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজীপুরের (জয়দেবপুর) মাটিতেই সংঘটিত হয়েছিল হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সর্বশেষ বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ। এতে পাকবাহিনীর বিভিন্ন প্রকার ভারী অস্ত্র ও যানবাহন ধ্বংস এবং বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত ও আহত হয়।

একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে আমাদের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বেই ১৯ মার্চ গাজীপুরের মাটিতেই প্রথম সংঘটিত হয়েছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সে সময় সারা দেশে শ্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ২৯ মার্চ পাকবাহিনী জয়দেবপুর দখল করে নেয়। এরপর ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা করার পর এলাকার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও স্বাধীনতাকামী জনতা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তিতে তারা এলাকায় চলে আসেন পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে। মূলত নভেম্বর মাস থেকেই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধ আক্রমণ শুরু করে। তারা বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা, রাজেন্দ্রপুর অর্ডিন্যান্স ডিপোসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে তৎপরতা শুরু করেন।

সম্পর্কিত খবর

    ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে জেলা শহরের আশেপাশে এসে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি গ্রুপে জড়ো হন। কিন্তু অবস্থানগত কারণে গাজীপুরে পাকবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বহাল থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায় পর্যন্ত। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে সেনানিবাসে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেন। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে বিপর্যস্ত পাকবাহিনী টিকতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে ঢাকার দিকে চলে যাবার মনস্থ করে। তখন উত্তর রণাঙ্গন অর্থাৎ ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাঙ্গাইল থেকেও পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র ও মুক্তিবাহিনী এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর (কাদেরিয়া) বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হটে সড়কপথে ঢাকায় যাবার পথে জয়দেবপুরের চান্দনা-চৌরাস্তায় জড়ো হয়। আসার পথে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা ব্রিজটি ধ্বংস করে দিলে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী গতিপথ পরিবর্তন করে কাশিমপুর গিয়ে অবস্থান নেয়। সর্বশেষ জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা এবং অর্ডিন্যান্স ডিপো থেকেও পাকসেনারা ট্যাঙ্ক, অস্ত্রশস্ত্র সাজোয়া যানবাহনসহ ঢাকা যাওয়ার পথে পাকসেনারা জড়ো হয় চান্দনা চৌরাস্তায়।

    এদিকে পাকবাহিনী পিছু হটে ঢাকার দিকে চলে যাচ্ছে এমন খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ও মিত্রবাহিনী ছয়দানা মালেকের বাড়িসহ আশপাশ এলাকায় রাস্তার (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের) দু'পাশে বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ২৫-২৬টি গাড়িবহর নিয়ে একটি কনভয় চান্দনা-চৌরাস্তা থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়। ছয়দানা এলাকায় গাড়ি বহরটি ফাঁদ পাতা অ্যাম্বুসে ঢোকার পর কাশিমপুর থেকে মিত্র ও কাদেরিয়া বাহিনী তাদের উপর কামান ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ট্রেঞ্জে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও ছুড়তে থাকে গুলি। পাল্টা জবাব দেয় পাকবাহিনীও। কিন্তু মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর ভয়ংকর গোলাবর্ষণে পাকবাহিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ছয়দানায় পাকবাহিনীর বিরাট কনভয় একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। বহু পাকসেনা নিহত হয়। বিনষ্ট হয় ট্যাংক, কামান, মর্টারসহ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর জানতে পেরে ১৬ ডিসেম্বর খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা উল্লাস ভরে প্রবেশ করে গাজীপুর শহরে।

    এ যুদ্ধে পাক বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণেই পরদিন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণকে ত্বরান্বিত করে তেমনি আমাদের বিজয়কে করেছিল অনিবার্য।

    গাজীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মোজাম্মেল হকের ভাষ্যমতে, ১৫ ডিসেম্বর জানতে পারি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটা কনভয় ঢাকা যাবে। ছয়দানা, মালেকের বাড়ি এলাকায় মিত্রবাহিনী অবস্থান করছিল। খবর পেয়ে আমরাও তাদের সঙ্গে অবস্থান করি। মিত্রবাহিনী এবং আমরা এ সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এতে পাকিস্তান বাহিনীর সম্পূর্ণ কনভয় ধ্বংসসহ তাদের সৈন্যরা হতাহত হয় এবং আমাদের কাছে আটক হয়। এভাবেই তাদের বাহিনীকে ঢাকা যাওয়া প্রতিহত করে পরাজিত করতে পারি। এ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে গাজীপুর হানাদার মুক্ত হয়।

    মুক্ত হয় কালীগঞ্জ ও পূবাইল:

    এই দিনে পাক-হানাদার মুক্ত হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও পূবাইল এলাকা। টানা তিনদিন যুদ্ধ শেষে পাক-হানাদাররা মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর এতে নিহত হয় প্রায় শতাধিক পাকসেনা।

    বিজয়ের একদিন আগে ওই এলাকা হানাদার মুক্ত হলেও তারা ধ্বংস করে ও আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় বহু গ্রাম, নির্বিচারে হত্যা করে শত শত মানুষকে আর সম্ভ্রম হারায় অনেক মা-বোন। এ এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের স্মৃতিচারণ করেন এভাবেই।

    টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত তখন একমাত্র রেলপথ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম ছিল না। তাই পাকবাহিনী সর্বশেষ তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে পূবাইল রেলস্টেশন ও তার আশপাশসহ পূর্ব দিকে কালীগঞ্জের সীমানা বালু নদীর ব্রিজ পর্যন্ত এলাকা জুড়ে। ফলে ওই এলাকার বহু গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাকসেনারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কালীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকার বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামটি। পাক হানাদার বাহিনী এ দেশিয় দোসরদের সহযোগিতায় ওই গ্রামে ঢুকে শতাধিক নারী পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।

    এর প্রধান কারণ ছিল গ্রামটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল উল্লেখযোগ্য হারে। এছাড়াও ভাদুন, ছোট কয়ের, সোড়ল, নয়ানীপাড়া, সাপমাড়া, পূবাইল বাজারসহ কালীগঞ্জের কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। এভাবে বিজয়ের ২ মাস আগ থেকে শুরু হয় কালীগঞ্জ, পূবাইল এলাকায় পাক-হানাদারদের বর্বর অত্যাচার, হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও। এই সকল নির্যাতনের শেষ হিসেবে ১১ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় নরসিংদী থেকে রেলযোগে কালীগঞ্জে ঢুকতে শুরু করে।

    ১৩ ডিসেম্বর কালীগঞ্জের বান্দাখোলা এলাকা থেকে গ্রুপ কমান্ডার বদরুজ্জামান খসরু ও বাতেন মোল্লার গ্রুপ এবং রূপগঞ্জের একটি দল ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পূবাইলে অবস্থিত পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। পরে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী স্থায়ীভাবে পাক হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য অবস্থান নেয় কালীগঞ্জের নলছাটায়। এদিকে গ্রুপ কমান্ডার বাতেনের দল অবস্থান নেয় নলছাটা থেকে বাড়িয়া হয়ে তিতারকুল পর্যন্ত এলাকা জুড়ে। তারা জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্সে অবস্থানরত পাক সেনাদের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ওৎ পেতে থাকেন।

    ওই অবস্থায় একটানা ৩ দিন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর মর্টার শেল ও তোপ কামানের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় পাক সেনাদের পূবাইল ঘাঁটি। এতে নিহত হয় প্রায় শতাধিক পাকসেনা। পরে ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা প্রায় ২৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে বলে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধারা জানান।

    মিত্রবাহিনীর পক্ষে গ্রুপ কমান্ডার বদরুজ্জামান খসরু আহত হন এবং নিহত হন ৩ জন ভারতীয় সৈন্য। এদের দুজনকে নলছাটায় ও একজনকে পূবাইল স্টেশনে রেলের স্লিপার দিয়ে দাহ করা হয়। এ রকম অনেক বিয়োগ-বেদনার বিনিময়ে ১৫ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় কালীগঞ্জ ও পূবাইল।

    ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ ডিসেম্বরে গাজীপুরে নানা কর্মসূচী পালন করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close