• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সবাইকে দেশপ্রেমিক হতে হবে কেন?

প্রকাশ:  ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:০১ | আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:৪৪
তসলিমা নাসরিন
ফাইল ছবি

বছরখানিক আগে ভারতের সিনেমা হলগুলোতে জাতীয় সংগীত বাজানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট এখন বাধ্যতামূলক ব্যাপারটি বাতিল করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সুপ্রিম কোর্ট বেশ ভালো রায় দেয় বিভিন্ন বিষয়ে। আমি মনে করি, কে দেশপ্রেমিক, কে নয়— তা জাতীয় সংগীত বাজালে এবং জাতীয় সংগীত বাজার সময় দাঁড়ালেই প্রমাণ হয় না।

জাতীয়তাবাদের একটি সমস্যা হলো, এটি বাড়লে উগ্র জাতীয়তাবাদ বাড়ে। ঠিক যেমন ধর্ম বাড়লে ধর্মীয় মৌলবাদ বা ধর্মান্ধতা বাড়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আজকাল কার কতটা দেশপ্রেম তা মাপতে মাঠে ঘাটে হাটে বেরিয়ে পড়েছে। আমি বুঝি না, সবাইকে দেশপ্রেমিক হতে হবে কেন?

সম্পর্কিত খবর

    উগ্র জাতীয়তাবাদ শুধু ভারতে নয়, অন্যান্য দেশেও বাড়ছে। ইউরোপে যখন এটি বাড়ে, নয়া নাৎসিদের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ইউরোপের চেয়ে বেশি কে জানে উগ্র জাতীয়তাবাদ কী ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে! ওদের কারণেই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলো। মনে আছে প্রথম যখন সুইডেনে গিয়েছি, সেই নব্বই দশকের শুরুর দিকে, রাস্তায় হাঁটতে গেলে কিছু কিছু বাড়িতে দেখতাম টাঙ্গানো আছে সুইডেনের পতাকা। ভাবতাম কোনও জাতীয় দিবস টিবস বোধহয় সেদিন। পরে জানতে পারলাম, কোনও বিশেষ দিন বলে নয়, প্রতিদিনই ওরা পতাকা টাঙ্গায়। কারণ, ওরা জাতীয়তাবাদী, নাৎসি আদর্শে বিশ্বাসী। ওই বাড়িগুলো থেকে যারা বেরোতো, তারা, লক্ষ করেছি, আমার দিকে বড় ঘৃণার চোখে তাকাতো।

    তার একটিই কারণ, আমার ত্বকের রঙ সাদা নয়, আমার চোখের রঙ নীল নয়, আমার চুলের রঙ সোনালি নয়। আমি না হয় নিরাপত্তা রক্ষী বেষ্টিত ছিলাম, আমার গায়ে কোনও আঁচড় পড়েনি, কিন্তু অন্য কালো বা বাদামি মানুষের ওপর ওরা, ওই জাতীয়তাবাদীরা, সুযোগ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়তো, পেটাতো, ভয় দেখাতো, নিজের দেশে ফিরে যেতে বলতো। কোনও কোনও সময় রাগ এত প্রচণ্ড হতো যে কালো বাদামি মানুষদের ওরা মেরেও ফেলতো।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই উগ্র জাতীয়বাদীদের নিরস্ত করতে ইউরোপের দেশগুলো নাৎসিবাদ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এতে দমন করা যায়নি জাত্যাভিমান। সংযত করা যায়নি ঘৃণা আর বিদ্বেষ। ওরাই ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে চরম দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী। এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীই আজ বিকট আকার ধারণ করেছে, ইউরোপে ওদের জয়ও হচ্ছে। ভারতে বসে যদি কোনও নারীবিরোধিতা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করি, যদি কোনও অন্যায় বা অনাচারের সমালোচনা করি, নব্বই দশকে কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখলেও আজকাল দেখছি। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অথবা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দিব্যি বলছে ‘ওরে রিফিউজি, নিজের দেশে ফিরে যা, ফিরে গিয়ে তোর দেশে ঘটা অন্যায়ের সমালোচনা কর।’ আমার দেশ ভালো, আমার দেশ শ্রেষ্ঠ, কোনও বহিরাগতর মুখে কোনও সমালোচনা শুনতে চাই না, এই হলো মোদ্দা কথা। উদার ইউরোপ বদলে যাচ্ছে, উদার ভারতবর্ষ বদলে যাচ্ছে। জানি এ ধরনের অসহিষ্ণু লোক সব দেশেই আছে, তবে সংখ্যাটা অনেক কম ছিল আগে।

    কোথাও কোনও কিছুর হুজুগ শুরু হলে, অবাক কাণ্ড, সেটি বিশ্বজুড়ে সংক্রামিত হতে থাকে। নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মবাদ, মৌলবাদ, বৈষম্যবাদ, সন্ত্রাসবাদ— সব লুটোপুটি করে এক হয়ে যাচ্ছে। যত এক হচ্ছে, তত শক্তিমান হচ্ছে। অশুভশক্তি শক্তিমান হলে অমঙ্গল ছাড়া আর কিছু বয়ে আনে না। এই চরম দুঃসময়ে যখন বামপন্থিদের উচিত সবরকম মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, তখন তারা তা না করে পক্ষ নিচ্ছে মুসলিম মৌলবাদের। তাই মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমরা মানববাদীরা যারা প্রতিবাদ করছি, আমাদের ‘চরম দক্ষিণপন্থি’ বা তাদের দোসর বলে ভুল করছে সাধারণ মানুষ। আমরা চরম দক্ষিণপন্থিদের চরম শত্রু হলেও আমাদের চরম দক্ষিণপন্থিদের পরম বন্ধু হিসেবে পরিচিত করাতে উদগ্রীব বামপন্থিরা। চরম দক্ষিণপন্থিরা ধন্দে পড়ে যখন আমরা তাদের নিন্দে করি। বিশ্বজুড়ে আমাদের মতো সত্যিকার সেক্যুলার মানববাদীরা একা হয়ে পড়ছে, তাদের সত্যিকার সমর্থন করার জন্য দক্ষিণপন্থি বা বামপন্থি কেউই নেই।

    ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় কালো বাদামি মানুষ এত বেশি ভিড় করছে, ওই কালো বাদামি মানুষগুলোর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা এত বেশি, আর বিশ্বময় এত বেশি সন্ত্রাস ঘটাচ্ছে মুসলিম আতঙ্কবাদীরা, যে মুসলিমদের প্রতি, এমনকি শান্তিপ্রিয় মুসলিমদের প্রতিও সাদাদের ভয় এবং ঘৃণা দুটোই বাড়ছে। মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সব অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে এখন সব মুসলিমকে। এক ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আরেক ধর্মীয় সন্ত্রাস জন্ম নিচ্ছে। তারচেয়ে শুভবুদ্ধির মানুষেরা মিলে এক সন্ত্রাসকে নির্মূল করাই কি ভালো নয়? সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস রোধ করা যায় না। হিন্দুত্ববাদ দিয়ে বা ইহুদি মৌলবাদ দিয়ে বা খ্রিস্টীয় মৌলবাদ দিয়ে মুসলিম মৌলবাদ নির্মূল করা যায় না, যাবে না। মৌলবাদ এবং সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে সর্বত্র সুশিক্ষা আর সুবুদ্ধি ছড়িয়ে দিতে হয়।

    এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এক সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল, যখন ঔপনিবেশিক শক্তি এই দেশগুলোকে শোষণ করত। ঔপনিবেশিক মহাপ্রভুরা এখন আর নেই। তবে জাতীয়তাবাদীরা কেন শক্তিশালী হচ্ছে। এর প্রধান কারণ বাম রাজনীতির পতন, দ্বিতীয় কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও মুসলিম সন্ত্রাস, কোথাও অভিবাসীদের বসে বসে সরকারি ভাতা খাওয়া, কোথাও বহিরাগত বেকারদের অপরাধ প্রবণতা।

    ভারতে যারা আমার ভারতপ্রেম নিয়ে সন্দিহান, তারা জানে না, ভারতকে যারা সত্যিকার ভালোবাসে, তারাই ভারতের ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে। যারা ভালোবাসে না, তারাই তো ঢেকে রাখবে আর বলবে ভারতের সব ভালো। একই রকম অন্য দেশগুলোর ব্যাপারেও বলা যায়। আমরা যারা মৌলবাদ থেকে, জাতীয়তাবাদ থেকে, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত— তারা পৃথিবীর সব দেশের মঙ্গল চাই। ভুলত্রুটির সমালোচনা না করলে ভুলত্রুটি সংশোধন করা যায় না। কোনও ভুলই আপনা থেকে সংশোধিত হয়ে যায় না। সমাজকে শুদ্ধ এবং সুস্থ করতে হলে প্রতিনিয়ত এর ভিতরের অশুদ্ধতা আর অসুস্থতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়। যারা দেখায় না, তাদের দেশপ্রেম আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

    ভারতের সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজলে আমি উঠে দাঁড়াই, যেমন দাঁড়াতাম সত্তর দশকে বাংলাদেশের সিনেমা হলে। বাংলাদেশের সিনেমা হল অনেক কাল বন্ধ করে দিয়েছে জাতীয় সংগীত বাজানো। বাংলাদেশে যত না জাতীয়তাবাদী বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে ধর্মীয় মৌলবাদী আর ঘোর পুঁজিবাদী। যখন দেশে দেশে বাড়া উচিত নারীবাদী, মানববাদী, যুক্তিবাদী— তখন বাড়ছে ঠিক উল্টোপন্থিরা।

    দারিদ্র্য আগের চেয়ে কমেছে, শিক্ষা আগের চেয়ে বেড়েছে, বিশ্বায়ন সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বকে, একই সঙ্গে নানা রকম উৎপাত শুরু হয়েছে। সম্ভবত মানুষের চরিত্রে নেই সমস্যাহীন কোনও সমাজে বাস করা। কিন্তু তারপরও সমাজকে বাসযোগ্য করার দায়িত্ব আমাদের সবার। বিশ্বের দায়িত্ব বিশ্বের মানুষের। আমার বিশ্বপ্রেম বিশ্বের গুণকীর্তন করায় নয়, বরং অসহিষ্ণুতাকে অস্বীকার করায়, অন্যায়ে অনীহা প্রকাশ করায়, অরাজকতাকে অবিশ্বাস করায়। আমার মতো আরও অনেকে আছেন এই বিশ্বে, তারা যেন মুখ বুজে থাকার সংস্কৃতি মেনে না নিই।

    লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close