• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ভোটে ফ্যাক্টর এরশাদ, কৃষকের বন্ধু মঞ্জু ও ধর্মের নামে বিদ্বেষ

প্রকাশ:  ১৭ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:৪২ | আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:৫৩
পীর হাবিবুর রহমান

গেল বছর নববর্ষের আনন্দ স্পর্শ করেনি বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের কৃষকসহ মানুষকে। এক ফসলি বোরো ফসল বা একমাত্র অর্থনৈতিক উৎস বোরো ফসল অতিবৃষ্টি, অকাল বন্যা ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতির কারণে তলিয়ে যায়। এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল হারানোর ট্র্যাজেডি অতীতে কখনো ঘটেনি। তাই নববর্ষ মানুষের জীবনে এসেছিল বিষাদ হয়ে। হতাশার চাদরে ঢাকা পড়েছিল কৃষকের জীবন। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় চোখজুড়ে অসহায়ত্বের চাহনি। বুকজুড়ে ছিল রিক্ত-নিঃস্ব ফসল হারানো কৃষকের যন্ত্রণাবিদ্ধ কান্না। সেবার প্রশাসন, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি কেউ নববর্ষ উদযাপন করেনি। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের মানুষের বুকের তপ্ত নিঃশ্বাস আর্তনাদ গোটা দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। গণমাধ্যম রিক্ত-নিঃস্ব ও অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বয়ং হাওরে জন্ম নেয়া রাজনীতির দীর্ঘ পথ হেঁটে আসা রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ছুটে গিয়েছিলেন, ফসল হারা হাওর অঞ্চলের মানুষের পাশে। কথা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে।

সম্পর্কিত খবর

    বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কৃষক বাঁচাও দেশ বাঁচাও স্লোগান তুলে নরসিংদী থেকে কৃষক সমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের শুভ সূচনা ঘটিয়েছিলেন। ৯৬ ক্ষমতায় এসে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। লাখো কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ করেছিলেন। বিনিময়ে তাঁর মুখের হাঁসি ছড়িয়েছিল কৃষকের মাঝে। ঢেউ খেলানো সবুজ দিগন্ত বিস্তৃীত হাওরে ফসলের বাম্পার ফলন নিয়ে কৃষকের ঘর আলোই করেনি, দেশের খাদ্য চাহিদা পুরণ করেছিল।

    গেলোবার ফসলহানির মতো ভয়াবহ বিপর্যয় অতীত ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কেউ না খেয়ে মরবে না। একদিকে আইনের কঠোর খড়গ নেমেছিল, যারা অনিয়ম করেছিল তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ফসল হারা কৃষকের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন। কৃষককে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে দিয়েছিলেন সার্বিক সহায়তা। একই সঙ্গে এবার কৃষকের জমি চাষাবাদের আগেই মন্ত্রিসভার রদবদল ঘটিয়ে তাঁর প্রথম শাসনামলের সফল যোগাযোগমন্ত্রী ও এরশাদ সরকারের গুড মিনিস্টারখ্যাত বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে নিয়ে আসেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। কৃষক দরদী মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা জানতেন, কৃষকের ফসল বৈরী প্রকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে ঘরে তুলতে হলে, কৃষকের বন্ধু কার্যত কৃষিমন্ত্রী নয়, পানিসম্পদমন্ত্রীকেই হতে হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানের দিনই শেখ হাসিনা সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃত বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানিক ভাইয়ের ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে হাওরের কৃষকের ফসলের বিষয়টি স্মরণ করে দিয়েছিলেন।

    আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দীর্ঘ রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সংসদ ও মন্ত্রীত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে আত্মপোলব্ধি করেছেন। কৃষকের জন্য বুকভরা ভালবাসা আর কোমল হৃদয় নিয়ে তিন দফা ছুটে গেছেন কৃষকের মাঝে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা হাওর অঞ্চলের সহজ-সরল কৃষিবান্ধব মানুষের কথা মন দিয়ে শুনেছেন। মন খুলে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে কথা বলতে দিয়েছেন। প্রথমবার তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করতে প্রয়োজনে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে তিন মাসের জন্য সুনামগঞ্জ নিয়ে যাবেন। কৃষকের বন্ধু হয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সেই কথা রেখেছেন। প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাইরে ঠিকাদারী প্রথা নয়, স্থানীয় সরকার, মাঠ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পানি উন্নয় বোর্ডের তদারকির সমন্বয় ঘটিয়ে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। পলি পরে জলাবদ্ধতা যাতে অকাল বন্যার আগমনে ফসল তলিয়ে নিতে না পারে সে জন্য ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করে ভৈরবে পানি বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

    গেল বছর যেখানে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণে বরাদ্ধ হয়েছিল, সেখাবে এবার প্রধানমন্ত্রীর উদার মনোভাবের কারণে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হয়। যদিও অনেক জায়গায় ধানের চেয়ে বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকরা মুনাফা লুটেছেন। তবুও বাঁধ নির্মাণে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। সর্বশেষ হাওর অঞ্চল সফরকালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, আমরা সকল পর্যায়ের মানুষেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। মহান আল্লাহ তায়লা নিশ্চয়ই আমাদের সেই ফলাফল দেবেন। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পাগলের মতো হাওরে ছুটে যাওয়া, কৃষক ও মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, একজন মন্ত্রী আন্তরিক হলে, দক্ষ হলে আর যাই হোক মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সন্তুষ্ট করতে পারেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আশাবাদী কৃষকের চোখেমুখে স্বপ্ন জাগাতে পারেন। মঞ্জু সেই স্বপ্ন জাগিয়েছেন। কৃষকের মনোবল শক্ত করেছেন। হাওরের মানুষকে তার ফসল ঘরে তুলতে আশাবাদী ও উদ্যোমী করেছেন।

    ইতিমধ্যে ধানের জাত বিআর-২৮ কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। হাওরের উঁচু জমিতে আবাদ করা এই ধান কাটার মধ্য দিয়ে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটেছে। আর সাত-দশ দিনের মধ্যে কৃষকের ঘরে বিআর-২৯ জাতের ধানও উঠে যাবে। কৃষকের চোখজুড়ে এখন আনন্দের দ্যুতি। কৃষকের চোখজুড়ে এখন ফসল তোলার স্বপ্নই নয়, বাম্পার ফলনের বিস্ময়কর সম্ভাবনার প্রাণ খোলা আনন্দের হাঁসি। কৃষকের মুখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দিয়ে হাঁসি ফুটিয়ে তুলেছেন। কৃষকের ঘরে ঘরে এখন নববর্ষের আনন্দ। বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে এখন ফসল তোলার আনন্দ। ধান কাটার মহানন্দে ভাসছে হাওরের লড়াকু কৃষকের মন।

    সুনামগঞ্জেই এবার দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলানো হয়েছে। সবুজ ধানখেত সোনার রঙ ধারণ করেছে। পক্ষকালের মধ্যে ১৩ লাখ মেট্রিক টন ধান কৃষকের ঘরে উঠবে। নবান্নের উৎসব এখন হাওরের মানুষের মাঝে। এক ফসলি বোরো ধান ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে, বাম্পার ফলনের সাফল্য ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে, কৃষকের চোখজুড়ে সারা বছরের অর্থনৈতিক শক্তি দৃঢ় করার স্বপ্ন খেলা করছে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তাঁর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়মিত সুনামগঞ্জ ও হাওরের উপকূলবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলের ভারতীয় আবহাওয়া বার্তা পর্যবেক্ষণ করছেন।

    পানিসম্পদমন্ত্রী মঞ্জু স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক একজন আদর্শিক চিরসংগ্রামী, রাজনৈতিক নেতার সন্তান সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব কৃষকের ফসলের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছেন। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, কৃষক ও হাওরের মানুষেরা ফসল ঘরে তোলার লড়াইয়ে এক গণজাগরণ ঘটিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রী চাইলে যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেটি করতে পারেন, তা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বুর্জোয়া রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব নিয়েও কৃষক বান্ধব হৃদয়ে গণমুখী চরিত্র নিয়ে সেটি ঘটিয়েছেন। স্থানীয় মানুষ তাঁর উপর খুশী। এখন প্রাকৃতিক নিয়তির কাছে মানুষের দৃষ্টি আর ঢেউ খেলানো বিস্তৃর্ণ ফসলের দিকে মন আকুল করা চোখ।

    শান্তিপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য উৎসব মুখর পরিবেশে এবার ১৪২৫ বাংলার পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ বর্ষবরণের মহোৎসব হয়ে গেল। সাতসকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরের ধারা, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, পথে পথে পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত শিশু-কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধদের আনন্দ-উচ্ছ্বল অংশগ্রহণ, লাল-সাদা শাড়ি পরিহিতা শিশু-কিশোরী, তরুণী ও রমণীগণের গলায় মালা, কানে দুল, কপালে লাল টিপ শোভিত সাজ-সজ্জার এই উৎসব নগর থেকে লোকালয়, শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে। বাউলের গানের আসর বসেছে। বসেছে মেলা। নাগরদোলা থেকে লাঠি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই কোনো আনন্দ আয়োজনই বাদ যায়নি। বিকেলে বৃষ্টি ও ঝড় নামলেও কালবোশেখির তা-ব সইতে হয়নি মানুষকে।

    বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক নবজাগরণে উদ্বেল-উত্তাল পহেলা বৈশাখ ঘিরে গোটা জাতি সব মত-পথ ভুলে গিয়ে এক মোহনায় মিলিত হয়েছিল। নির্বিগ্নে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ শেষ হওয়ায় বাইরে না বেরোলেও আনন্দ-তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি।

    আজকাল ইউটিউব খুললেই একদল ধর্মান্ধ তথাকথিত হুজুরের ওয়াজ শুনতে শুনতে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। পহেলা বৈশাখকে তারা হিন্দুদের পুজা বলে ধর্ম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। বুঝতে পারি না, গ্রামগঞ্জের এসব ওয়াজ করা হুজুরদের বেলায় তথ্যপ্রযুক্তি আইন ৫৭ ধারা বা ডিজিটাল অ্যাক্ট ৩২ কোথায় থাকে?

    ওপারে আনন্দবাজার পত্রিকা খবরে বাড়াবাড়ি রঙ মাখিয়ে উস্কানি দেয়। এপারে একদল মূর্খ ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ান। কার স্বার্থে কেনো তারা এমনটি করেন বুঝতে পারি না। ধর্মান্ধ বিদ্বেষ ও নাস্তিকতার নামে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কার্যত বাংলাদেশের উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে শিথিল করে।

    মুক্তিযুদ্ধকালে আমার বয়স ছিল সাত-আট। এখনো মনে পড়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে ঘর-বাড়ি ফেলে আমরা যখন সীমান্ত এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। মাকে মা, বাবাকে বাবা ডাকছি বলে এক আত্মীয় ভৎর্সনা করেছিলেন। তাচ্ছিল্যে করে জানতে চেয়েছিলেন, আমরা হিন্দুদের মতো মা-বাবা কেনো ডাকি।

    আমাদের পরিবার ধর্মভিরু। মা-বাবার নামাজ কখনো কাজা হতে দেখিনি। মা-বাবা ও বোনদের নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াতে কোনোদিন ছন্দ পতন হতে দেখিনি। আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করা মা-বাবা আমাদের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গভীর আত্মীয়তার বন্ধনে পাড়া-পড়শি সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার উদার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলে, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মা-বাবা ডাকার কারণে যে আত্মীয় তিরস্কার করেছিলেন, তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে না পারলেও তার মৃত্যুর পর চেয়েছি, আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন। ধর্মের নামে পাকিস্তান আমলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের ভারতের দালাল এবং হিন্দুত্ববাদী বলে অভিযুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের নামে সংখ্যালঘুরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দাসত্ব বরণ করে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছে।

    ধর্মের নামে মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতির উন্মাষিক আস্ফালন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যেমন ঘটেছে, মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার আমলেও তাদের ওয়াজ-ফতোয়াদান বহাল রয়েছে। পহেলা বৈশাখে মুসলমানরা পাঞ্জাবি পড়লে জাহান্নামী হবে এমন মূর্খ বয়ান অনেকে দিচ্ছেন। যেন বিচারের মালিক আল্লাহ শাস্তির রায় ও বেহেস্তে যাওয়ার টিকেট এই সব গ্রাম্য মোল্লাদের হাতে দিয়েছেন। ধর্মের নামে এই উগ্রতা, মিথ্যাচার, হটকারিতা সমাজে বিষের বাতাস ছড়াচ্ছে।

    এক সময় দেখতাম আলেম-ওলামারা ইসলামের বাণী প্রচার করতেন। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রতিষ্ঠা, ঈমানী মনোবল সুদৃঢ় করা, নিয়মিত নামাজ পড়া, সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা, পাড়া-পড়শি গরীব-মিসকিনদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবতাবাদী ধর্মীয় চিন্তাভাবনার আলোকিত পথ দেখাতেন। অহংকার ও পরনিন্দা পরিত্যাগ করার তাগিদ দিতেন। ঘুষ-দুর্নীতি ও পাপাচারের বিুরুদ্ধে কথা বলতেন। সেই সব আলেমদের অনুপস্থিতি দিনে দিনে ঘটেছে।

    এখন একদল কাটমোল্লা আবির্ভূত হয়েছেন। যাদের জ্ঞ্যানের পরিধি ওয়াজ শুনলেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। কেউ কেউ হিন্দি গান পরিবেশন করছেন। কেউ বা আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড সংগীতও গাইছেন। সঙ্গে নামের সাথে জিহাদী যুক্ত করে ওয়াজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষের বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি বিঘিœত হতে পারে এমন উস্কানিও দিচ্ছেন। তারা ভুলে যাচ্ছেন, এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষেরা, সকল শ্রেণি-পেশার বীর জনতা আত্মত্যাগই করেননি, বীরত্বের লড়াই করে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

    একাত্তরের রক্তঋণে বাধা অঙ্গীকার হচ্ছে, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। এই চেতনার জায়গায় ধর্মের নামে যারা আঘাত করছেন, তাদের বিষয়ে সকল মহলকেই সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখন সময় দরজায় কড়া নাড়ছে।

    বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতেও হিন্দুত্ববাদের স্লোগান তুলে আসা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের চেতনা ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি আগামী নির্বাচনের আগেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। ধর্মান্ধ শক্তিকে জনগণের শক্তিতেই মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের অতীত ইতিহাসে সেই বিজয়ের শিক্ষা উদাহরণ হিসেবে সামনে রয়েছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত ধর্মান্ধ শক্তির কাছে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্বাসিত অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক চেতনা পরাস্ত হতে পারে না। আশা করছি, সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী ও সকল রাজনৈতিক সামাজিক শক্তিসমূহ এটি বিবেচনায় নিবেন।

    জীবনের পড়ন্ত বেলায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সাবেক সেনাশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ. এম. এরশাদ তাঁর দল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে অবর্তীণ হয়েছেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত ৯১ ও ৯৬ সালের নির্বাচনে কারাগারে বসে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। রংপুর তাঁর রাজনৈতিক দুর্গ সেটি প্রমাণ করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের কঠিন দমননীতির মুখে পতিত জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকা-ের উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞাই জারি হয়নি, অসংখ্য নেতাকর্মীরা ছিলেন পলাতক নয় জেলবন্দী। টেলিভিশন ভাষণের সুযোগ এরশাদকে দেয়া হয়নি। তবু অসম ভোটযুদ্ধে জাতীয় পার্টি ৩৫টি করে আসনে জয়লাভ করেছিল।

    ৯৯ সালে চারদলীয় জোটে যাওয়াই এরশাদকে ফের কারাবরণ করতে হয়। এবং নির্বাচন করার যোগ্যতা হারাতে হয়। জোট থেকে বেরিয়ে ঝড়ের কবলে পতিত বিভ্রান্ত বিধ্বস্ত জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়লাভ করলেও এরশাদকে কখনো কোনো শাসক স্বাধীনভাবে রাজনীতির অধিকার দিতে পারেননি। যখনই এরশাদ সরকার বিরোধী অবস্থান নিতে গেছেন তখনই তাঁর ঘুমন্ত মামলা জেগে উঠেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের অংশীদার হয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। তবুও হাত-পা খুলে তাঁকে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়নি।

    ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ বর্জন নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সংসদে ৪০টি আসন নিয়ে এখনো রাজনীতির ময়দানে বহাল রয়েছে। ভোটরাজনীতিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি বড় ব্যবধানে হলেও তৃতীয় বৃহত্তম দলই নয়, মেয়র নির্বাচন ও উপ-নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছে এখনো রংপুর এরশাদের এবং জাপা তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।

    আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্যই নয়, কারাদহন ভোগ করছেন। তাঁর পুত্র বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেবয়ারম্যান মামলায় দ-িত, নির্বাচনে অযোগ্যই নয়, নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। মানুষের মধ্যে সরকার বিরোধী অসন্তোষ থাকলেও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় নির্বাচনে ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে এমন আলামত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সরকার বিরোধী যে জায়গাটি গণমানুষের মধ্যে বিএনপি অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে দলটি দমন-পীড়ন ও কারাদহনে পতিত হওয়ায় এরশাদ ও জাতীয় পার্টি সেখানে দাঁড়াতে চাইছে। সরকার বিরোধী সমালোচনায় মুখর হয়ে স্লোগান তুলেছে, এইবার এরশাদের সরকার।

    জীবনের পড়ন্ত বেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৪ মার্চ এরশাদ বিশাল সমাবেশ-শোডাউন করেছেন। বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ইতিহাস গড়বেন তিনি। আগামীতে সিলেট শহরে বড় শোডাউন করতে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামেও করেছেন। দলের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ঘুমন্ত জাপাকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জাগিয়ে তুলছেন। এরশাদের পাশে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, জিয়া উদ্দিন বাবলু ও কাজী ফিরোজ রশীদরা ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের তো আছেনই।

    তিন শ আসনে প্রার্থী দেয়ার চিন্তা করে মোটা নির্বাচনী বাজেটের সন্ধানে রয়েছে জাপা। এরশাদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় গেলে তাঁর পার্টিকে ৭০টি আসন ও ১০টি মন্ত্রণালয় দিতে হবে। বিএনপি নির্বাচনে এলে এক রকম না এলে এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টি নিয়ে আরেক রকম খেলবেন। জীবনের শেষ খেলায় এরশাদ জাতীয় পার্টিকে ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত করেছেন। সামনে ভোট রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত এক রকম, ঘোষণার পর আরেক রকম দেখা যাবে। পর্যবেক্ষকরা শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।

    লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close