• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এলো পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর ১৫৭তম জন্মজয়ন্তী

প্রকাশ:  ০৭ মে ২০১৮, ০৩:০০ | আপডেট : ০৭ মে ২০১৮, ১০:৫৪
বিশেষ প্রতিনিধি

সময় বদলায়৷ আধুনিকতা থেকে উত্তর আধুনিকতায় যাত্রা করে সময়৷ তবুও বাঙালির মনন ও জীবনজুড়ে প্রাসঙ্গিক তিনি। বাংলার মাটি আর মানুষের অন্তরে ছড়িয়ে আছে তার অপার সৃষ্টি সম্ভার। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক- এমন শতদলে বিকশিত বাঙালি শত-সহস্র বছরে জন্মেছে একজনই, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ আজ আমাদের বিশ্বকবির ১৫৭তম জন্মবার্ষিকী ।

কে না জানে, কোন আলোকবর্তিকা নিয়ে প্রতিবছর আসে পচিঁশে বৈশাখ। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে (৭ মে, ১৮৬১) কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মেছিলেন বাঙালির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বাবা -মায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। রবীন্দ্রনাথের বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মায়ের নাম সারদা দেবী। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সমাজ সংস্কারক ,রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মহর্ষি বলে ডাকতেন।

সম্পর্কিত খবর

    সেই সনাতন সময়েই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র ছিল ।চার বছর বয়সের সময় থেকে রবির বিদ্যা শিক্ষা শুরু হয়, শৈশবেই উৎসরিত হয় তার মেধা ও বুদ্ধির শিখা। ছোটবেলা থেকেই তার কবিতা পরতে খুব ভাল লাগতো, ''জল পড়ে পাতা নড়ে''এ কথাটি লিখেই তার কবিতা লেখার উৎসাহ যোগায়।তিনি বাংলা ভাষায় বহু কবিতা,গান,নাটক,উপন্যাস,প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করে থাকেন। ট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়।১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ (গীতাঞ্জলী) লিখে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি শুধু ভারতের কবি নন ,সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি বলে খ্যাতি লাভ করেন।

    রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী "রবীন্দ্রনৃত্য" নামে পরিচিত। ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বকবি।

    রবীন্দ্রনাথের ১৫৭তম জন্মজয়ন্তী পালনের জন্য প্রস্তুত কবির আত্রাইয়ের পতিসরের কাচারি বাড়ি। প্রতিবারের মতো এবারও কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি তাঁর স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের। প্রতি বছরই পতিসরে নামে রবীন্দ্রভক্তদের ঢল। পরিণত হয় মানুষের মহামিলনমেলায়। সরকারিভাবে একদিনের কর্মসূচি নিলেও এই মিলনমেলা চলে প্রায় সপ্তাহ জুড়ে । দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতিচারণে মগ্ন হন কবিভক্তরা।

    রবি ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে সাজানো হয়েছে অপরূপ বর্ণিল সাজে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও এখানে আসবেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র ভক্তরা। নাচ, গান আর কবির রচিত কবিতা আবৃত্তি করে উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বকবির জন্মোৎসব। দিনব্যাপী সরকারি অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির দেবেন্দ্র মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সাড়ে ১০টায় ‘একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক স্মারক আলোচনা অনুষ্ঠান, বিকাল ৩টা থেকে নাটক, আবৃত্তি, নাচ-গানসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন নওগাঁসহ দেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা।

    কবির ৭৬ বছর বয়সের একটি উন্মুক্ত ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে পতিসরে। স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। এই কাচারি বাড়িতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র।

    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নওগাঁর আত্রাইয়ের এই পতিসরে এসে তাঁর কাচারি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’।এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত কবিতা “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে”, “দুই বিঘা জমি”, “সন্ধ্যা”সহ অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন এই পতিসরের কাচারি বাড়িতে বসে।

    কবির নিজস্ব জমিদারি নওগাঁর পতিসর যেন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কাচারি বাড়িতেই কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পতিসরে নাগর নদের পাড়কে মনমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও পতিসরের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন না হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবার যেন হাঁটি হাঁটি পা-পা করে উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।

    কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি এলাকা কালিগ্রাম পরগনার সদর দফতর এই পতিসর। আর এই পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মাধুর্যঘেরা কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর আজও সাহিত্যের অঙ্গনে সাড়ম্বরে বিরাজিত। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখন তিনি বিরাজ করেছেন এই পতিসরে। প্রতিবছর কবির এই জন্মদিনে দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা ছুটে আসেন। তাদের প্রিয় কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণ যেন কবিভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

    নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৩৬ কিলোমিটার ও আত্রাই উপজেলা সদর হয়ে ৫৫ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীতে, কবিগুরুর কাচারি বাড়ি জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের পতিসর গ্রামে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক হোক আর নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লিই হোক, তাতে কি আসে যায়! তিনি যে আমাদের প্রাণের কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নওগাঁ এবং আত্রাই থেকে মাইক্রোবাস, বাস, সিএনজি, টেম্পু, চার্জার, ভটভটিসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে পতিসরে যাওয়া যায়।

    কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার পুরস্কারের অর্থ তিনি এই পরগনার প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার জন্য ৭৫ হাজার টাকা তৎকালীন সময়ে এখানে স্থাপিত কৃষিব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার প্রজাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কবি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পতিসরে এসে তার পুত্র রথীন্দ্রনাথের নামে কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন স্থাপন করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের নামে ২শ বিঘা জমি দান করেন। অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মহান ও উদার মনের মানুষ। এই পরগনাসহ দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য ছিল অপরিমেয় ভালোবাসা। এই ভূখণ্ডের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমৃত্য লড়েছেন তিনি।

    বাঙলা ভাষা যতোদিন আছে, বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যতোদিন ধরনীতে থাকবে ততোদিনই অক্ষয় আর অমৃত হয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ, আমাদের চিরচেনা রবি ঠাকুর।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close