মাদকবিরোধী অভিযানে ১০ দিনে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত অর্ধশতাধিক
মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে দেশজুড়ের অভিযান চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। পুলিশ-র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানে গত ১০ দিনে 'বন্দুকযুদ্ধে' ৫২ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' পাঁচ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। একই সময়ে মাগুরায় দু'জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে একজন করে মাদক ব্যবসায়ীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করার দাবি করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, মাদক নিয়ে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ওই পাঁচজন নিহত হয়।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এদের কয়েকজনকে আগেই ধরে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। চলমান অভিযানে গতকাল পর্যন্ত অন্তত আড়াই হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়।
সম্পর্কিত খবর
চলতি মাসের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকনির্মূল অভিযান চলছে। এসব অভিযানে জেলায় জেলায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই; র্যাব ও পুলিশ এসব ঘটনাকে বর্ণনা করে আসছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে। পুলিশ ও র্যাবের দাবি নিহতরা সবাই মাদক চোরাকারবারে জড়িত ছিল। কারও কারও বিরুদ্ধে থানায় মাদক আইনে মামলাও রয়েছে।
রাজধানীতে গত ৩ মে র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো মাদকের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে বাহিনীটিকে নির্দেশ দেন। এরপরই শুরু হয় দেশজুড়ে মাদকনির্মূলে সাঁড়াশি অভিযান। র্যাবের পাশাপাশি এ অভিযানে মাঠে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও বিভিন্ন থানার পুলিশ।
মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে শুরু হওয়া অভিযানের প্রথম দুই-তিন দিন কোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। র্যাবের অভিযান শুরুর পর প্রথম বন্দুকযুদ্ধ ঘটে ৭ মে রাতে; তাতে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় একজন করে নিহত হয়। এরপর ৯ মে রাজশাহীতে নিহত হয় একজন। তারা সবাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানায় র্যাব।
এরই মধ্যে র্যাব-প্রধান বেনজির আহমদ গত ১৪ মে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তারা মাঠে নেমেছেন। মাদকের বিরদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। র্যাব-প্রধানের এ ঘোষণার পর মাদক নির্মূল অভিযান আরও জোড়ালো হয়।
পুলিশ ও র্যাবের সূত্র বলছে, অভিযান জোরদারের পর গত ১৫ মে বন্দুকযুদ্ধে দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। একদিন বাদে ১৭ মে নিহত হয় আরও দুই মাদক ব্যবসায়ী। পরের দিন তিনজন ও ২০ মে নিহত হয় ছয় মাদক ব্যবসায়ী। ২১ মে সারাদেশে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নয় মাদক ব্যবসায়ী। পরের দিন বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। একদিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে 'গোলাগুলিতে' এখন পর্যন্ত নিহতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এ ছাড়া গত ২৩ মে নিহত হয় আটজন।
এদিকে, বুধবার থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬৮ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। কারওয়ান বাজার এলাকায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ২২ মাদক ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেন।
এসময় পুলিশ-র্যাবের অভিযানে কুমিল্লায় 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছে দুই মাদক ব্যবসায়ী। বুধবার রাত ১টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন আমানগণ্ডা সলাকান্দা নতুন রাস্তার মাথায় পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' বাবুল ওরফে লম্বা বাবুল (৩৫) নিহত হয়। একই রাতে সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারাসংলগ্ন ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন ট্যাঙ্ক রোডের গোয়ালমথন এলাকায় নিহত হয় রাজীব (২৬) নামের এক মাদক ব্যবসায়ী।
ফেনীর ফুলগাজীতে বৃহস্পতিবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' মনির হোসেন ও শাহ মিরান শামীম নামের দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলছে, শামীম ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল।
মাগুরা শহরতলির পারনান্দুয়ারী হাউজিং প্রজেক্ট এলাকা থেকে বুধবার গভীর রাতে আইয়ুব শেখ ও মিজানুর রহমান কালু নামের দুই মাদক ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতদের পরিবারের দাবি, দু'দিন আগে পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' আমির খাঁ নামের এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। পুলিশ জানায়, তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও রয়েছে। বুধবার রাত ২টার দিকে উপেজলার ধরখার ইউনিয়নের বনগজ স্টিল ব্রিজসংলগ্ন পাকা রাস্তার মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আমির খাঁ উপজেলার চানপুর এলাকার সুরুজ খাঁর ছেলে। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ ১২টি মামলা রয়েছে।
সাতক্ষীরায় অস্ত্র-ফেনসিডিলসহ গুলিবিদ্ধ লাশ :সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে আবদুল আজিজ নামের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার ভাড়াসিমলা ইউনিয়নের হিজলা চণ্ডীপুর গ্রামের সিদ্ধেরপুকুরে লাশটি পাওয়া পায়।
কক্সবাজারে মাদক মামলার আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ :কক্সবাজারের কলাতলী এলাকা থেকে মোহাম্মদ হাসান নামের এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে। হাসানের বাড়ি কলাতলীর আদর্শগ্রামে। তার বাবার নাম খুইল্যা মিয়া।
নারায়ণগঞ্জে 'ফেনসি সেলিম' নিহত :নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' সেলিম (৩২) নামের সন্দেহভাজন এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। বুধবার গভীর রাতে দক্ষিণ নিমাইকাশারী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নজরুল ইসলাম জানান, স্থানীরা সেলিমকে 'ফেনসি সেলিম' হিসেবে চেনে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযান চালানোর সময় মাদকব্যবসায়ী বা পাচারকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি ছুড়ছে। এরপর আত্মরক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা গুলি চালালে তারা নিহত হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ সশস্ত্র। তাদের গ্রেপ্তার করতে গেলেই তারা আমাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে থাকে। সঙ্গত কারণেই আমাদেরও গুলি করতে হয়।
দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা মাদকের বিরুদ্ধে এই সাঁড়াশি অভিযান সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি দিচ্ছে। তবে দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বন্দুক যুদ্ধের ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা’হিসেবে বর্ণনা করে তা বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও সরকারের তরফ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। বরং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মাদকবিরোধী অভিযান আরো বেশি জোরদার হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও গোয়েন্দা পুলিশ, রেল পুলিশ, থানা পুলিশ এবং বিজিবিকেও বিভিন্ন স্থানে মাদকবিরোধী অভিযানে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে।