কোরবানির পশুহাটের ইজারা নিয়ে কারসাজি
প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে বসবে অস্থায়ীভিত্তি কোরবানির পশুর হাট। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যবস্থাপনায় নগরীর ২০টি স্থানে এবার কোরবানির পশুরহাট বসবে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১৩টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় সাতটি পশুর হাট। এই ২০টি হাটের মধ্যে ১২টিরই ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বাকি আটটি হাটের বিপরীতে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। অবশ্য নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে সেগুলোর বিপরীতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করেছে দুই সিটি করপোরেশন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দরপত্র জমা পড়লেও এগুলোও সরকারি দলের নেতাকর্মীরাই পাবেন। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে।
ঈদুল আজহার তিন দিন আগে থেকে রাজধানীতে অস্থায়ীভাবে কোরবানির পশুর হাট বসে। হাটগুলোর স্থায়ীত্ব হয় ঈদের পর দিন পর্যন্ত। এই মুহূর্তে হাটগুলোর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। গত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটগুলো ইজারা নিচ্ছেন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। হাটগুলো হয়ে ওঠেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের একটি বার্ষিক আয়ের উৎস।কম টাকায় হাটের ইজারা নিতে প্রতিবছরই সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। সিটি করপোরেশনের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও যোগ দেন এ সিন্ডিকেটে। এবারও এই কারসাজিতে স্বল্পমূল্যে ১২টি হাট স্বল্পমূল্যে পেয়েছেন এই নেতাকর্মীরা।
সম্পর্কিত খবর
২০১১ সাল থেকে ২০১৮সাল, এই সাত বছরে বেড়েছে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনমান, বেড়েছে চাল, ডাল, তেল, তরি-তরকারিসহ কতকিছুর দাম। ২০১১ সালে অবিভক্ত ডিসিসি’র বাজেট ছিল দেড় হাজার কোটি টাকা। তার ৮ বছর পরে এসে ২০১৮-১৯ সালের অর্থ বছরে শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। শুধু বড় হচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোরবানির হাটের ইজারামূল্যের অংক।
রহমতগঞ্জ হাটের ইজারা মূল্য ছিল ২০১১ সালে পাঁচ লাখ ৬২ হাজার ২৫০ টাকা। সাত বছর পরে এসে ২০১৮ সালে এই হাটের ইজারা মূল্য হয়েছে ১১ লাখ সাত হাজার ১৫০ টাকা। এই সাত বছলে এই হাটের ইজারা মূল্য বেড়েছে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে এই হাটের ইজারামূল্য ছিল ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ওই বছর হাটে গরু বিক্রি হয় ৪ হাজার ৯৮০টি। গরুর গড় মূল্য অনুযায়ী ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাসিল পায় ইজারাদার। ইজারামূল্যের চেয়ে সে বছর ওই পশুর হাট থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেশি হাসিল আদায় হয়। ডিএসসিসি গতবছর এ হাটের ইজারামূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ১০ লাখ ৩ হাজার টাকা।
চলতি বছর কোরবানির হাটের দরপত্র বাক্সগুলো খুলে ও পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রে নূ্যনতম সংখ্যক দরপত্রও জমা পড়েনি। নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো হাট ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে নূ্যনতম তিনটি দরপত্র জমা পড়তে হবে। না হলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে হবে।
এদিকে ডিএনসিসিতে যে সব হাটের ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর ইজারাদার হিসেবে যাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কয়েকজন পদধারী নেতা। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বর-সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ইজারা পেয়েছেন উত্তরখানের ১৭০/৯ বেথুলীর বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। তিনি উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তিনি এলাকায় গোল্ডেন শফিক নামে পরিচিত। এ হাটটি গত বছর তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছিল। অথচ এবার তাকে এটি ইজারা দেওয়া হয়েছে মাত্র দুই কোটি ২১ লাখ টাকায়। নিয়ম অনুযায়ী, এটি গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ শতাংশ বেশি মূল্যে ইজারা দেওয়ার কথা।
এ প্রসঙ্গে শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছরও তিনি হাটটি ইজারা নিয়েছিলেন। তবে তার দুই কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল। এ জন্য তিনি কম দর দিয়েছেন। ভাটারার (সাইদনগর) হাট ইজারা পেয়েছেন ছোলমাইদের আবদুল মান্নানের ছেলে মারফত আলী। তিনি ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী সড়ক-সংলগ্ন (বছিলা) পুলিশ লাইন্সের জায়গার হাট পেয়েছেন মোহাম্মদপুরের ৬৩/১১ কাটাসুরের বাসিন্দা শাহ আলম হোসেন জীবন। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই হাটটিও গতবারের চেয়ে ১৫ লাখ টাকা কম মূল্যে ৯০ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।
মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট পেয়েছেন আশরাফ উদ্দিন। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে তারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। মিরপুরের ডিওএইচএস সংলগ্ন উত্তর পাশের খালি জায়গা পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।
একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীন হাটগুলোরও। উত্তর শাহজাহানপুরের খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠ পেয়েছেন শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ। তিনি শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের পরিচালক (ফাইন্যান্স) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক। সমকালকে তিনি বলেন, যে বেশি দর দেবে, সেই তো পাবে। তিনি বেশি দর দিয়েছেন। এ জন্য ইজারা পেয়েছেন। তবে হাটটি তার নামে নেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং স্থানীয় কিছু লোকদেরও লাভের ভাগ দেন তিনি।
হাজারীবাগ হাটের ইজারা পেয়েছেন জাহিদুল কবির। তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল ইসলামের ভাই। রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ পেয়েছেন রহমতগঞ্জ মুসলিম সোসাইটির পক্ষে ডাল ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সভাপতি হাজি শফি মাহমুদ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অবশ্য শফি মাহমুদ বলেন, তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। ক্লাবটা চালানোর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য সিটি করপোরেশন তাদের হাট ইজারা পাওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা সহযোগিতা করে- হাটের লাভের টাকা দিয়ে তারা ক্লাবটা পরিচালনা করেন।
কামরাঙ্গীরচর চেয়ারম্যানবাড়ির হাট পেয়েছেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকার। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পাশের হাটের ইজারা পেয়েছেন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। শ্যামপুর বালুর মাঠ পেয়েছেন শেখ মাসুক রহমান। তিনি কদমতলী থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ ও জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার ভাগ্নে।
সাতটি হাটের বিপরীতে নেই দরপত্র :এদিকে প্রথম দফায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১২টি হাটের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও এর মধ্যে সাতটি হাটের বিপরীতে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। অথচ এগুলোর বিপরীতে ২৭টি দরপত্র বিক্রি হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ উঠেছে. সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটটি সাধারণ ইজারাদারদের দরপত্র জমা দিতে দেয়নি। এমনকি তারা নিজেরাও জমা দেননি। কারণ, কোনো দরপত্রই জমা না পড়লে ঈদের আগে খুবই কম মূল্যে সেগুলো ইজারা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ হাটগুলো হলো- মেরাদিয়া বাজার-সংলগ্ন খালি জায়গা, ব্রাদার্স ইউনিয়নের বালুর মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের খালি জায়গা, আরমানিটোলা খেলার মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গা, ধূপখোলা ইস্টএন্ড ক্লাব মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গা এবং সাদেক হোসেন খোকা মাঠের আশপাশের খালি জায়গা।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের একচেটিয়াভাবে হাটের ইজারা পাওয়া প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, বাইরে কী হয়েছে, সেটা তারা জানেন না। তবে দরপত্র বাক্সের কাছে সব সময় পুলিশ ছিল। এসবির লোক ছিলেন। সিটি করপোরেশনের লোক ছিলেন। কেউ কোনো অভিযোগও করেননি যে তারা দরপত্র জমা দিতে পারেননি। এমনকি দরপত্র খোলার দিনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই তারা হাট ইজারা দেবেন। কে কোন দলের লোক সেটা তারা দেখবেন না। প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করেন ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, তারা কাউকে মুখ চিনে হাটের ইজারা দেবেন না। কাগজপত্র ঠিক থাকলে সর্বোচ্চ দরদাতাই হাটের ইজারা পাবেন।