• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কয়লা গেছে ইটের ভাটায়!

প্রকাশ:  ২২ জুলাই ২০১৮, ২১:২৫
বিশেষ প্রতিনিধি

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কয়লা গায়েবের ঘটনায় চলছে তোলপাড়। নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা যেখানে স্তূপ করে রাখা হয় সেখানে কয়লা থাকার কথা প্রায় দেড় লাখ টন। কিন্তু সেখানে কয়লা আছে মাত্র পাঁচ-ছয় হাজার টন। এক লাখ ৪২ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস মিলছে না। গায়েব কয়লার বাজার মূল্য প্রায় ২২৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিপুল পরিমান কয়লা একদিনে লোপাট হয়নি। দীর্ঘদিনের জেরেই এই গায়েবের ঘটনাটি ধরা পড়েছে।

দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়ার এ খনিটি দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাখনি। ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত ভূগর্ভস্থ এ কয়লা খনি থেকে ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ৬৬৮ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ খনিতে ৩৯০ মিলিয়ন উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লা মজুদ আছে। খনিটি থেকে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার টন কয়লা উত্তোলিত হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবস্থাপনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি (বিসিএমসিএল) এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে থাকে।

উত্তোলন করা কয়লার প্রধান গ্রাহক হলো বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদনে প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হয়। বাকি কয়লার সিংহভাগ চলে যায় পার্বতীপুর, সৈয়দপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ইটভাটায়। এছাড়াও এখানে থেকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, চা বাগান ও অন্য ব্যবহারকারীরাও কয়লা কিনে থাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে খনির কোল ইয়ার্ড (কয়লা মজুদ কেন্দ্র) কখনও খালি হয়নি।দীর্ঘদিন ধরেই কোল ইয়ার্ডে বিপুল পরিমাণ কয়লার ঘাটতি ছিল। খনি কর্তৃপক্ষ এতদিন তা সমন্বয় করেনি এবং কোল ইয়ার্ড খালি না হওয়ায় এতদিন বিষয়টি ধরাও পড়েনি।

খনির কূপে উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় যন্ত্রপাতি সংস্থাপন ও স্থানান্তরের জন্য বড়পুকুরিয়ায় গত ২৯ জুন থেকে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পুনরায় কয়লা উত্তোলন শুরু হবে আগস্ট মাসের শেষে। কোল ইয়ার্ডে নতুন মজুদ যোগ না হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এ বিষয়টি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পেট্রোবাংলাকে জানালে কয়লা উধাও হওয়ার ব্যাপারটি প্রকাশ্যে আসে।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, এখানকার কয়লার সবচেয়ে বড় গ্রাহক বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও বিপননের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইটভাটা মালিকদের কাছে কয়লা বিক্রিতেই বেশি আগ্রহী। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লা ১১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হয়। আর ইটভাটার মালিকদের কাছে কয়লা বিক্রি করা হয় প্রতি টন ১৭ হাজার টাকা। কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী কর্মকর্তারা বিক্রয়ের লভ্যাংশের উপর কমিশন পান। ইটের ভাটায় বেশি দামে কয়লা বিক্রি হয়, এতে কমিশনও বেশি পাওয়া যায় বলে কর্মকর্তার তাদের কাছেই কয়লা বিক্রিতে বেশি উৎসাহী।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কেবল কমিশনই নয়। অনেক সময় স্থানীয় দালাল শ্রেণির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজিতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নির্ধারিত দামের চেয়ে টন প্রতি ৫০০ থেকে হাজার টাকা বেশি দামে ইট ভাটার মালিকদের কাছে কয়লা বিক্রি করা হয়। বাড়তি টাকার মোটা অংশ চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে, আর একটি অংশ চলে যায় দালালের পকেটে। বিশেষ করে ইট তৈরির সিজনে কয়লা বিক্রিতে এই কারসাজি করা হয়। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিকে ঘিরে গড়ে ওঠে সিন্ডিকেটের বেশিরভাগই হলেন পার্বতীপুরের হামিদপুর এলাকার বাসিন্দা। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়ার্ড থেকে বাড়তি কয়লা পাচারেরও অভিযোগ আছে।

সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী টাকা জমা দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ক্রেতাকে দুই কপি ডিও (বিলি আদেশ) দিয়ে থাকেন। একটি ডিও ইয়ার্ডে জমা দেওয়ার পর সে অনুযায়ী ক্রেতাকে কয়লা সরবরাহ করা হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কয়লা বিক্রিতে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তৈরি হয় দুই রকম ডিও। সরকারি নথিপত্রে দেখানো হয় একরকম, জাল ডিওতে দেখানো হয় আরেকরকম। যেমন: সরকারি ডিওতে ৫ টন কয়লা উল্লেখ থাকলেও জাল ডিওতে অাদেশ থাকে ২০ টন কয়লা সরবরাহের। এক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে কয়লা কেনায় ইটের ভাটার মালিকরাও অর্থছাড় পেয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। এই জালিয়াতি একাধিকবার ধরা পড়লেও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বেশি দূর গড়াতে না দিয়ে দ্রুত ধামাচাপা দিয়েছেন। জাল ডিও’র মাধ্যমে কয়লা বিক্রির অবৈধ টাকার ভাগ কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাও পকেটে যায় বলেও অভিযোগ আছে।

বড়পুকুরিয়া খনি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ পার্বতীপুর ও সৈয়দপুর এলাকার ভাই ভাই ব্রিকস, এমএফ ব্রিকস্, বিবি ব্রিকস্, আমিন ব্রিকস, জিসান ট্রেডার্স ,বিবিএম ব্রিকস্, জেবিএম ব্রিকস্, এসকে ব্রিকস প্রভৃতি ইটভাটার মালিকেরা জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করা কয়লার বড় গ্রাহক।

কয়লা উত্তোলনের রেকর্ড ঠিক রাখালেও ইয়ার্ড থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে খালাস হয়েছে বাড়তি কয়লা। স্তুপকৃত কয়লার নিরীক্ষণ ও তদারকি না থাকাতেই অল্প অল্প করে পাচার করা কয়লা এখন বড় ঘাটতি তৈরি করেছে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় এক লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা ঘাটতির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)-এর কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কয়লা বিক্রি ও দূর্নীতির প্রতিবাদের বেশ কয়েকবার সোচ্চার হয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা ব্যবসায়ী সমিতি। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু লুটপাট, দুর্নীতি ও তুঘলকি কারবারের বৃত্ত থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে মুক্ত করা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অনিয়ম আর দূর্নীতির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, খনি থেকে উত্তেোলনের পর ১৭ একর জমিতে কয়লাগুলো স্তূপ করে রাখা হয়। ২০০৫ সালের পর এ পর্যন্ত কখনো স্তূপে কয়লা ১ লাখ ৫০ হাজার টনের নিচে নামেনি। এছাড়া নতুন কয়লা উৎপাদন হওয়ায় সবসময় পরিমাপ করা যায় না কতটুকু কয়লা আছে। এখন কয়লার মজুদ কমে যাওয়ায় বিষয়টি নজরে এসেছে। বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী কয়ল দেওয়া যায়নি, ঘাটতি পড়েছে।

তিনি বলেন, বিশ্বের প্রতিটি কয়লাখনিতে ২-৫ শতাংশ সিস্টেম লস থাকে। সিস্টেম লসের কারণে কয়লা শুকিয়ে যায়, অটোমেটিম জ্বলে যায়, কয়লা বাতাসেও উড়ে যায়। বাতাসে উড়ে যাওয়ার কারণে কয়লা অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।

সরকারি নথিতে কম দেখিয়ে কালোবাজারে কয়েকগুণ বেশি কয়লা অবৈধভাবে বিক্রি করার বিষয়টি মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানিয়া অস্বীকার করে বলেন, ২০০৫ সাল থেকে অন্তত ৭/৮ জন এমডি এখানে এসেছেন এবং চলে গেছেন। বছর বছর কর্মকর্তা-কর্মচারি বদলি হচ্ছে। সবার হিসেবে তো দিতে পারবো না। আমি যতদিন আছি, কোনো অনিয়ম হয়নি।

কয়লা খনিতে অনিয়মের জন্য যে চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানিয়া। তাকে বদলি করে সিরাজগঞ্জে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে। তবে আবুল কাশেম প্রধানিয়া তাকে নিয়ম অনুযায়ীই বদলি করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, আমাকে ভালো জায়গাতেই বদলি করা হয়েছে।

আবুল কাশেম প্রধানিয়া ছাড়াও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কয়লা খনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমদকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করে পেট্রোবাংলায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর সাময়িক বরখাস্ত দুই কর্মকর্তা হলেন, আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান, মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ও খালেদুল ইসলাম উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর)।

এনই

বড়পুকুরিয়া কয়লা গায়েবের,কয়লা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close