• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

যুগে যুগে নন্দিনী

প্রকাশ:  ০৬ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২৮
বিনোদন প্রতিবেদক

নন্দিনীর কথা মনে পড়ে। রবি ঠাকুরের সেই নন্দিনী। রক্তকরবীর নন্দিনী। যক্ষপুরীতে পাষাণ রাজার জাল ছিঁড়ে আলোর দরজা খুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখান যে নন্দিনী। সুন্দরের প্রতীক হয়ে যক্ষপুরীতে আসেন তিনি, বিষুর সঙ্গে বসে পৌষের গান শোনান। সেই ঈষাণীপাড়ার নন্দিনী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া সেরা নারীচরিত্র নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকতেই পারে। তবে রবীন্দ্রসাহিত্যপ্রেমী সবাই মেনে নেবেন যে, রক্তকরবী নাটকের ‘নন্দিনী’ চরিত্রটি অবশ্যই শীর্ষ তালিকায় উঠে আসবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ বঙ্গাব্দে শিলংয়ের শৈলবাসে ‘রক্তকরবী’ রচনা করেন। তখন এর নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’। ১৩৩১ সনের আশ্বিন মাসে প্রবাসীতে নাটকটি ‘রক্তকরবী’ নামে প্রকাশিত হয়। আর এ নাটকেরই কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিনী। যুগে যুগে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান অভিনেত্রীরা। সব অভিনেত্রীর জন্য এ এক স্বপ্নের চরিত্র। অন্ধকারে আলোর প্রতীক হয়ে নন্দিনীর আবেদন আজও প্রবহমান।

‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী প্রেমের প্রতীক। যক্ষপুরীতে নন্দিনীর এই প্রেমের পরশ রাজা পাননি তার লোভের জন্য, সন্ন্যাসী পায়নি তার কুসংস্কারের জন্য আর মজুররা পায়নি তারা নিজেরাই নিজেদের শেকলে বন্দি বলে। তবু সেই যক্ষপুরীর শেকল ছেড়ে মুক্ত হওয়ার বারতা আনে নন্দিনী। নন্দিনীর এই আহ্বানে চঞ্চল হয় সবার হৃদয়। জেগে ওঠে সবার মধ্যে মুক্তির স্বাদ। অত্যাচারী রাজাও পেতে চাইল নিষ্কৃতি। কিন্তু লোভী রাজা যে কায়দায় স্বর্ণ মজুদ করেন, সেভাবে কী নন্দিনী নামের প্রেম আর শ্বাশত সুন্দরকে পাওয়া যায়। কেবল রাজা নয়, নন্দিনীকে পেতে চায় সবাই। মোড়ল, কিশোর, অধ্যাপক, কেনারাম, বিশু সবাই চায় নন্দিনীর স্পর্শ। কিন্তু নন্দিনীর ভালোবাসা শুধু একজনের জন্য। মানুষটির নাম রঞ্জন। রঞ্জনের মধ্যেই নন্দিনীর প্রেমের দিশা। অথচ রঞ্জনও তার নিজের শেকলে বন্দি।

রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক ‘রক্তকরবী’-তে দেখা যায় যক্ষপুরীর অন্ধকারে পুরুষের সবল শক্তি ভূমিগর্ভ থেকে উঠিয়ে আনছে তাল তাল সোনা। এখানে শুধু কঠোর আর নিঠুর শ্রম দিয়ে সবার কেবল স্বর্ণ লাভের চেষ্টা। এখানে নেই মোটেও প্রাণের আহ্বান। তাই প্রেম সেখান থেকে যায় নির্বাসিত। যক্ষপুরীর মানুষরা ভুলে গেছে যে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি। ভুলেছে প্রতাপের মধ্যে নেই পূর্ণতা, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা। নিজের শেকলের কাছে নিজেই তারা দাস। কিন্তু একসময় নন্দিনী রূপে সকলের চিত্তে দোলা দেয় প্রেম। তাই নন্দিনী চরিত্র দিয়ে বোঝা যায়, মাটির তল থেকে যে সম্পদ খুঁড়ে খুঁড়ে আনতে হয় নন্দিনী সে সম্পদ নয়। মাটির উপরিতলের প্রাণের রূপই হলো নন্দিনী।

ভারতে ও বাংলাদেশে বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, এখনো হচ্ছে এবং আগামীতে হবে। টিভিতেও একাধিকবার প্রচার হয়েছে এর টিভি নাট্যরূপ। এই নাটকে প্রাণভোমরা নন্দিনী চরিত্রে যেসব অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন, তারা ধন্য হয়েছেন। সার্থক মনে করেছেন তার শিল্পী জীবন।

রক্তকরবী রচনার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতবারই নাটকটি মঞ্চস্থ করার আয়োজন হয়েছে ততবারই বিপদে পড়তে হয়েছে। কারণ সব চরিত্রের জন্য উপযুক্ত কাউকে পাওয়া গেলেও নন্দিনী চরিত্রের জন্য খুঁজে পাওয়া ভার। কবিগুরু যেভাবে চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে শিল্পী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই সমস্যায় পড়েছিলেন। রচনার পর `রক্তকরবী` মঞ্চায়ন করতে গিয়েছিলেন তিনি। অভিনয়ের জন্য সব চরিত্র তিনি চূড়ান্ত করেছেন। শুধু বাকি নন্দিনী। নন্দিনী চরিত্রের মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একটি মেয়ে পাওয়া গেল, যে নন্দিনী হতে পারে। মেয়েটি সিলেটের। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাকে নন্দিনী হিসেবে চূড়ান্ত করেছিলেন। নাম না জানা সেই মেয়েটিই আমাদের প্রথম নন্দিনী। কলকাতার বাঘা বাঘা অভিনেত্রী থাকতে আমাদের সিলেটের সেই তরুণীই রবীন্দ্রনাথের চোখে প্রকৃত নন্দিনী হয়ে উঠেছিলেন।

নন্দিনী রূপে ভারতীয় মঞ্চ রাঙিয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। ভারতে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় ১৯৫১ সালে নাট্যগুরু শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। এতে নন্দিনী চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়কে এখনও ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম সেরা কীর্তির মর্যাদা দেওয়া হয়। টানা ১১ বছর তিনি নন্দিনী সেজে মঞ্চ মাতিয়েছিলেন। তৃপ্তি মিত্র যতোদিন নন্দিনী সেজে মঞ্চে উঠেছেন, প্রতিবারই প্রেক্ষাগৃহ থাকতো কানায় কানায় পূর্ণ। পরবর্তীতে তৃপ্তি মিত্রের কন্যা শাঁওলী মিত্রসহ মধুমতি বসু, অনিন্দিতা রায়, বাসন্তী গুহ প্রমুখ ডাকসাইটে অভিনেত্রীরা এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কেউই তৃপ্তি মিত্রের মতো খ্যাতি পান নি।

আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদ ১৯৫৬ সালে রক্তকরবী মঞ্চায়ন করে। এতে রওশন আরা নামের এক অভিনেত্রীকে দেখা যায় নন্দিনী রূপে। দর্শক তাকে এবং তার অভিনয় দেখে সত্যিকারের নন্দিনী বলেই আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৬১ সালে ঢাকা ড্রামা সার্কেল তাদের `রক্তকরবী`তেও রওশন আরাকে নন্দিনী চরিত্রে নিয়েছিল। তখনকার দর্শকের কাছে নন্দিনীরূপী রওশন আরা স্বপ্নকন্যায় পরিণত হয়েছিলেন। রওশন আরার পরের নন্দিনী হয়েছিল কাজী তামান্না নামের এক কিশোরী। ১৯৬৯ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় তিনি নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাজী তামান্নাও দেখতে সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু রওশন আরাকে তিনি ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। বাংলাদেশে ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রটি প্রথম সার্থকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন দিলশাদ খানম। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনায় যদিও এটি ছিল টিভিনাট্যরূপ। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ‘রক্তকরবী’ নাটকে মূল সুরটি ছিল অবিকল।

হালে ঢাকার মঞ্চে নন্দিনীর সবচেয়ে প্রশংসিত রূপায়ন করেছেন নন্দিত অভিনেত্রী অপি করিম। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০১ সালের ৩০ নভেম্বর। প্রথম প্রদর্শনী থেকেই অপি একাকার হয়ে যান নন্দিনী চরিত্রটির সঙ্গে। অর্ধশতাধিক প্রদর্শনীতে অভিনয়ের পর অপি করিম দেশের বাইরে চলে যান, দু'বছর পর দেশে ফিরলেও মঞ্চে ফিরেননি। পরে নাগরিক নাটসম্প্রদায় অবশ্য একাধিক বিকল্প অভিনেত্রী দিয়ে নন্দিনী চরিত্রটি করাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঢাকার দর্শক অপি করিম ছাড়া ‘রক্তকরবী’ দেখতে আগ্রহী হননি বলে সেই চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে।

ঢাকার মঞ্চ প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদলের প্রযোজনায় বর্তমানে অনিয়মিত প্রদর্শিত হচ্ছে ‘রক্তকরবী’। এতে নূনা আফরোজ নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি নিজেই দিয়েছেন নাটকটির নির্দেশনা। আন্তরিকতার সঙ্গে নূনা আফরোজও এ চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

টিভিতে বিভিন্ন সময় নন্দিনী চরিত্রের খণ্ডিত রূপ উঠে এসেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও নাটকে। বিভিন্ন সময় নন্দিনী সেজে দর্শকদের সামনে এসেছেন সাদিয়া ইসলাম মৌ, শশী, তারিন প্রমুখ।

/এ আই/ এন ই

নন্দিনী,রবি ঠাকুর,রক্তকরবী,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,​বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close