• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নিরাপদ সড়ক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলন

প্রকাশ:  ২৩ আগস্ট ২০১৮, ১৮:৫৪
মোস্তাফা জব্বার

নিরাপদ সড়ক চাই- We want Justice এমন দুটি শ্লোগানের মধ্য দিয়ে আমরা জুলাই এর শেষ ও আগস্টের শুরুর সময়টা কাটিয়েছি। প্রায় সকলের কাছেই এটি এখনও একেবারেই তরতাজা স্মৃতি। বাংলাদেশের এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবেনা যিনি ছাত্র ছাত্রীদের সেই সময়কার আবেগ ও দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেননি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে, মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, সরকারি ও অন্য সকল দল এই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু একটি অসাধারণ সুন্দর অনুভূতি অবশেষে জামাত শিবিরের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে পথ হারায়। এটি সুখবর যে, জামাত শিবিরের সেই চক্রান্ত শেষ প্রান্তে এসে সফল হতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়ায় ফিরে গেছে এবং সরকার তাদের সকল দাবি মেনে নিয়ে সেইসব বাস্তবায়নে পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

২৯ জুলাইতে এই আন্দোলনের শুরু এবং ৮ আগস্ট এর সমাপ্তি। ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস দুর্ঘটনায় নিহত হলে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। আন্দোলনের নেতৃত্ত্ব বলতে কোন সুনির্দিষ্ট নিউক্লিয়াস আমি অন্তত খোজে পাইনি। তবে তাদের পক্ষ থেকে নয়টি দাবি তোলা হয়েছে। দাবিগুলো হলো:

১. দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. দুর্ঘটনার পর করা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে স্পিডব্রেকার দিতে হবে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না। ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।

তাদের দাবিকে যৌক্তিক মনে করে সরকার সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করে এবং তাদের দাবিগুলো পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এই দাবিগুলো মূল সমস্যার সমাধানে পুরোপুরি সক্ষম হবে না। দাবিগুলো বাস্তবায়নের ফলে সড়ক পরিবহনে কিছুটা শৃঙ্ক্ষলা ফিরে আসবে বটে-কিন্তু প্রকৃত সমাধান হচ্ছে পুরো ব্যবস্থাটির ডিজিটাল রূপান্তর। এই অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা কেন যে সেই কথাগুলো বললো না, সেটিই আমার নিজের কাছে অবাক লেগেছে। এতে মনে হয়, আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে ফেসবুক তুলে দিয়েছি, কিন্তু ডিজিটাল বানাতে পারিনি। ওরা হয়তো এখনও ডিজিটাল রূপান্তরের ধারনাটি অনুভবও করতে পারে না।

কেউ যদি ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিগুলো খতিয়ে দেখে তবে তার মাঝে অপেশাদারিত্ব চোখে পড়বে। এটি স্বাভাবিকও। ওদের দ্বারা একটি বিজ্ঞানসম্মত দাবিনামা তাৎক্ষণিকভাবে পেশ করা সহজ কাজ নয়। প্রথম দাবিতে তারা দুর্ঘটনাকারী গাড়ি চালকের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সেটি “সংবিধানে সংযোজন” করতে বলেছে। এরকম বিধানের জন্য যে আইন হয়, সংবিধানে যে এটি সংযোজন করা যায়না সেটি তারা বুঝেনি।

নৌ পরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং ক্ষমা চাওয়া বিষয়ক দ্বিতীয় দাবিটি আবেগতাড়িত হলেও যুক্তিসঙ্গত। আন্দোলনের সময় এমন দাবি ওঠতেই পারে। তবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, নৌ মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়ায় সড়ক ব্যবস্থা নিরাপদ হবেনা।

তৃতীয় দাবিটি যৌক্তিক। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য ফুট ওভারব্রিজ চেয়েছে। এটি অবশ্য সকল জনগণেরই দাবি। তবে বিদ্যমান ফুট অভারব্রিজ যে ছাত্র-ছাত্রীরাও ব্যবহার করেনা সেটিও উপলব্ধি করা দরকার এবং এজন্য তাদের নিজেদের শিক্ষিত হওয়া আবশ্যক।

চতুর্থ দাবিটি স্পীড ব্রেকারের। এটিও যুক্তিসঙ্গত। তবে এটি কেবল শহরের জন্য না করা হলে এবং হাইওয়েতে যত্রতত্র স্পীড ব্রেকার দিলে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যাবে যে, সেটি তাদের বোঝা উচিত।

৫ম দাবিতে তারা দুর্ঘটনা কবলিত ছাত্র-ছাত্রীদের দায় সরকারকে নিতে বলেছে। দাবিটি যুক্তিসঙ্গত।

৬ নাম্বার দাবিতে ছাত্র ছাত্রীদেরকে হাত তুললেই গাড়িতে তোলার দাবি তুলেছে। এই দাবিটি সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার সাথে যৌক্তিক কিনা সেটি ভাবা দরকার। কারণ এর ফলে বাসকে যেখানে সেখানে থামাতে হবে। তাতে সড়ক নিরাপদ না হয়ে অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে ওঠতে পারে।

৭নং দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা হাফ ভাড়ার দাবি করেছে। এক সময়ে আমরা হাফ টিকেটে সিনেমা দেখার দাবিও তুলেছিলাম। তবে সেদিনের প্রেক্ষিত এখন বোধহয় বিরাজ করেনা। এই দাবিটি এমন হতে পারতো যে, সরকারি সকল পরিবহনে ছাত্র-ছাত্রীদের ভাড়া অর্ধেক হবে। বেসরকারি পরিবহন মালিকরা ছাত্র-ছাত্রীদের এই দাবি মানবে বলে মনে হয়না।

৮ নাম্বারে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধ এবং লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালনা বন্ধ করতে বলা হয়েছে।

৯নং নাম্বারে বাসে অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করতে বলা হয়েছে। এই দুটি দাবিই পরিস্থিতির জন্য শিথিল হয়ে যায় এবং বস্তুত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সাথে এর ব্যাপক সম্পৃক্ততা রয়েছে।

আমি নিজে খুব অবাক হয়েছি যে তাদের দাবিনামায় ট্রাফিক সিগন্যাল শব্দটিই উচ্চারিত হয়নি। অথচ যানবাহন চলাচলের জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল না থাকার কথা ভাবাই যায়না। ঢাকা শহরে ট্রাফিক লাইট জ্বলে। তবে সবুজ বাতি জ্বলার সময় গাড়ি চলেনা এবং লাল বাতি জ্বলার সময় গাড়ি চলে। প্রধানত হাত ওঠিয়ে-নামিয়ে ট্রাফিক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা হয়তো ভাবেইনি যে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত না হলে সড়ক নিরাপদ হতে পারেনা।

আমি খুশি হতাম যদি ছাত্র ছাত্রীরা তাদের দাবিতে ফুটপাথ, সড়ক-মহাসড়ক অবৈধ দখলমুক্ত করার কথা বলতো, বিজ্ঞানসম্মত সড়ক নির্মাণের কথা বলতো, দ্রুত গতির ও শ্লথ গতির বাহনের জন্য আলাদা লেনের কথা বলতো। একই সাথে তারা যদি পুরো দেশবাসীকে সড়ক-মহাসড়কে নিয়ম মেনে চলার আহ্বান জানাতো তবে আমরা আন্দোলনে আরও বেশি সমর্থন দিতে পারতাম। তারা সড়কে নেমে কাগজ পরিক্ষা বা সড়কের ব্যবস্থাপনা করার যে দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেটি অতুলনীয়। কিন্তু এটাতো সত্য যে, তাদের কর্মক্ষেত্র ক্লাশরুমে-সড়কে না। তাই তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপনটিকে স্থায়ী করার জন্য সকলকে সচেতন করার আহ্বান জানানোটা জরুরি ছিলো।

এই আন্দোলন চলার সময়েই আমি ফেসবুকে দুটি শ্লোগান দেখেছি। একটি ৪জি চাইনা-নিরাপদ সড়ক চাই ও অন্যটি ডিজিটাল বাংলাদেশ চাইনা নিরাপদ সড়ক চাই। আমার নিজের কাছে এসব শ্লোগান গুটি কয়েকের ভাবনার ফসল বলে মনে হয়েছে-ওরা ডিজিটাল প্রজন্ম ফলে তাদের পক্ষে এমন শ্লোগান দেয়া সম্ভব নয়। আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি যে, এই ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ বাংলার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি শ্লোগান দিয়েছে। সম্ভবত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর আধিপত্য অনেক ছিলো বলে আমরা ইংরেজি দাবি শুনেছি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দেশে। তার চাইতেও চরম দশা দেখলাম যে, কোন কোন কিশোরী বা শিশুদের হাতে মুখে উচ্চারণ করা যায়না এমন নোংরা ও অশ্লীল শ্লোগান লেখা ছিলো। আমি নিজে এর ব্যাখ্যা করি এভাবে যে স্বতস্ফূর্ত কোন আন্দোলনে কেউ কেউ এমন অপকর্ম করেই থাকে। আন্দোলনের এক স্তরে পরিকল্পিতভাবে খুন-ধর্ষণ ও চোখ নষ্ট করার গুজব রটানো আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত; সেটি নতুন করে বলার দরকার পড়েনা।

উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে; “২০১৫ সাল থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৫ হাজার মানুষ এবং আহত প্রায় ৬২ হাজার। ]বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে গাড়ির অতিরিক্ত গতির কারণে; ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং আর ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।” এই হিসাবটির পাশাপাশি আরও তথ্য হলো: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০১৮ সালে দেশে চলমান বৈধ গাড়ির সংখ্যা ৩৫ লাখ ৪২ হাজার, কিন্তু বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ৯ লাখ গাড়ি লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা চালিত হয়। উপরন্তু দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার।

বিদ্যমান অবস্থাতে গবেষণা করে এসব তথ্য খুঁজে বের করতে হয়েছে। অথচ এসব তথ্য যে কেউ যে কোন সময়ে একটি আঙুলের ডগায় পাবে এটাই এখনকার অবস্থা হওয়া উচিত। এই ছাত্র ছাত্রীদের দাবিগুলোর যদি আমাকে খসড়া বানাতে বলা হতো তবে আমি প্রথমেই বলতাম পরিবহন ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর করুন। সকল যানবাহন, চালক, মালিক, রুট পারমিট, ফিটনেস, ট্রাফিক সিগন্যাল, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রক, যান চলাচলের বা তার অবস্থানের প্রকৃত অনলাইন তথ্য ডিজিটাল হওয়া উচিত। যতো দিন এসব কায়িক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হবে ততোদিন এসব নিয়ে দুর্নীতি চলমান থাকবে ও প্রকৃত তথ্য কারও কাছেই থাকবেনা। বিআরটিএ কেন তার সকল কাজই ডিজিটাল করেনি সেটি নিয়ে ছাত্র ছাত্রীরা প্রশ্ন তুললে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। ছাত্র ছাত্রীদের দাবির মাঝে চালক ও ফিটনেস বিষয়ক যে সমস্যার কথা বলা হয়েছে তাকে যদি ডিজিটাল করা না হয় তবে ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স পাওয়া এবং ফিটনেস না থাকলেও তার ফিটনেস পাওয়া অব্যাহত থাকবে। একটি বিষয় বোধহয় আমাদের সকলেরই অনুভব করা উচিত যে গাড়ির ইঞ্জিনে চিপস থাকা বা মাদারবোর্ড দিয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা, গাড়িতে আরএফ স্টিকার থাকা, জিপিএস রাখা ইত্যাদি এখন আর সায়েন্স ফিকসনের বিষয় নয়। এসব গাড়িসহ বিদ্যমান গাড়িগুলোকে চোখের নজর আর হাতে ধরে ফিটনেস পরিক্ষা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

দেশের সকল নগর, সড়ক মহাসড়কে ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন, ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা প্রচলন, জিপিএস ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে দাবি তোলাটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো।

আমি নিজে কিন্তু এটি বিশ্বাস করি যে আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজেরা যখন নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করবে তখন তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হবে ডিজিটাল প্রযুক্তি। মান্ধাতার আমলের ঘুণে ধরা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের সোনার টুকরো ছেলে মেয়েরা নতুন একটি সভ্যতা নির্মাণ করবে সেই প্রত্যাশা আমরা করি। আমি এটিও প্রত্যাশা করি যে তারা নিজেরা ডিজিটাল হবে ও দেশটাকে ডিজিটাল বানাবে।

লেখক: ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)

-একে

সড়ক আন্দোলন,মোস্তাফা জব্বার
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close