• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আতঙ্ক কাটেনি রংপুরের ঠাকুরপাড়ায়

প্রকাশ:  ১০ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৪৮
রংপুর প্রতিনিধি

রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া গ্রামে তাণ্ডবের একবছর আজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত বছরের এ দিনে ওই এলাকায় ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও স্থানীয়দের সংঘর্ষে স্থানীয় এক যুবক নিহত এবং পুলিশসহ অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ গঙ্গাচড়া ও কোতোয়ালি থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দুই মামলার একটিরও প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে, টিটু রায় জামিনে বেরিয়ে আসলেও দিন কাটছে বেকার অবস্থায়। বন্ধ হয়ে পড়েছে টিটুর ছেলে সঞ্জয় রায়ের পড়ালেখাও। একবছর ধরে ওই এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও সেখানকার লোকজনের মাঝে আতঙ্ক কাটেনি এখনো।

সরেজমিনে ঠাকুরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, হামলার এক বছর পর বদলে গেছে ওই এলাকার চিত্র। সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক। ভাঙচুরের শিকার ঘরবাড়ি ও মন্দিরগুলো সরকারি-বেসরকারি অনুদানে সংস্কার করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। দিন-রাত পুলিশ সদস্যরা এলাকায় টহল দেন।

কথা হয় হামলার শিকার দিনেশ রায়ের স্ত্রী মিনতি রায়ের সাথে। তিনি বলেন, গত বছরের ঠাকুরপাড়ার হামলার ঘটনায় আমরা সব হারিয়েছি। আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ধান, চালসহ বাড়ির বিভিন্ন মালামাল লুটপাট করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অনুদানে আমাদের ক্ষতি পুরোপুরি পূরণ না হলেও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি।

ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডবের ৪দিন পর ১৪ নভেম্বর নীলফামারীর জলঢাকা থেকে গ্রেফতার হন টিটু রায়। এরপর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন তিনি। প্রায় ৯ মাস কারাগারে বন্দী থাকার পর গত ৫ আগস্ট জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তিনি।

টিটু রায় জানান, জামিনে মুক্ত হয়ে মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়িতেই থাকছেন।

হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হরকলি ঠাকুরপাড়া শিব মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুপুর গোস্মামী বলেন, হামলার কারণে আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় আমরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মন্দিরেরও সংস্কার করা হয়েছে। তবে আমাদের মনের ভয় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পটি স্থায়ীকরণেরও দাবি জানান তিনি।

এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ একেএম আব্দুল মান্নান জানান, অস্থায়ী এই ক্যাম্পে দিনে-রাতে ১৩ জন করে পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা সার্বক্ষণিক টহল অব্যাহত রেখেছি। এলাকায় কোনো ধরণের সমস্যা নেই। চলতি বছর এ এলাকায় মহা ধুমধামে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এদিকে, হামলার এক বছরেও দুই মামলার একটিরও প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেফতার হওয়া বেশিরভাগ আসামিই জামিনে মুক্ত রয়েছেন। তবে পুলিশের দাবি, সঠিক বিচার কাজের স্বার্থে ঘটনার ব্যাপক তদন্ত করা হচ্ছে। এ কারণেই প্রতিবেদন জমা দিতে দেরি হচ্ছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গংগাচড়া মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান মিজান জানান, ঠাকুরপাড়া হামলার ঘটনায় ৭৬ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৫১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলার রহমানসহ ৪ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

রংপুর সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাবেদ আলী জানান, এ ঘটনায় ৮৩ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃদের মধ্যে মাসুদ রানা নামে এক আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে। দ্রুত এই মামলার পুলিশ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।

এ ব্যাপারে রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) সাইফুর রহমান সাইফ বলেন, মামলা আমরা নিবিড়ভাবে তদন্ত করছি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ভিডিও ফুটেজ আমরা তদন্ত করছি। সঠিক তদন্তের কারণে একটু সময় লাগছে। নির্দিষ্ট করে সময় বলা যাচ্ছে না, তবে দ্রুত মামলা দু’টির প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া গ্রামের মৃত. খগেন্দ্র রায়ের ছেলে টিটু রায়ের ফেসবুক আইডিতে একটি ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত বছরের ১০ নভেম্বর শুক্রবার বাদ জুমা তার বিচার দাবিতে পাগলাপীরের শলেয়া শাহ বাজারে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন স্থানীয়রা। পরে ঠাকুরপাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এসময় পুলিশ ও দুষ্কৃতিকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় হাবিবুর রহমান হাবিব (৩০) নামে স্থানীয় এক যুবক নিহত ও পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। এসময় সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০/১২টি বাড়িঘর ও একটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগসহ তাদের বাড়ির মালামাল লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

পুলিশের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় তৎকালীন রংপুর কোতোয়ালী থানার এসআই রফিকুল ইসলাম রফিক ও গংগাচড়া থানার এইআই রেজাউল আলম বাদি হয়ে ১৫৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার জনকে আসামি করে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন। দুই মামলায় বিভিন্ন সময়ে ৯৩জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আসামিদের অনেকেই জামিনে রয়েছেন।

/পি.এস

রংপুর,আতঙ্ক কাটেনি ঠাকুরপাড়ায়
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close