আমলাতান্ত্রিক ফাঁদে আটকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা!
বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীল নকশায় একাত্তরে বলি হন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। জাতির এই ধীমান সন্তানরা এখন বৃত্তবন্দি বছরের একটি দিনে, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দিবসটি বেশ ভাবগাম্ভির্যে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি আমাদের রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কি কোনো রকম স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে হয়েছে? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তাদের একটা তালিকা প্রয়োজন পড়ে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে রাষ্ট্র ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সম্পর্কিত খবর
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো তালিকাই নেই । পাকিস্তানিদের গণহত্যায় জাতি কতজন মেধাবী সন্তানকে হারিয়েছিল, তাদের নাম- পরিচয় এবং কর্ম জায়গা পায়নি ইতিহাসের পাতায়। তরুণ প্রজন্মের কাছে তারা অজ্ঞাতই রয়ে গেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির প্রতিশ্রুতি শুনেছে জাতি একাধিকবার। কিন্তু আমলানির্ভর প্রশাসনের ঠুনকো জটিলতায় কোনো উদ্যোগই বেশিদূর যেতে পারেনি। বুদ্ধিজীবীর ‘সংজ্ঞা’ কি, আর বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কি হবে সঠিক মাপকাঠি? এই আমলাতান্ত্রিক ফাঁদেই আটকা পড়ে আছে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা তৈরির উদ্যোগগুলো।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের তালিকা গত ৪৭ বছরে আমরা প্রণয়ন করতে পারিনি। অথচ একাত্তরে বিজয়ের ঊষালগ্নে পাকিস্তানিদের দেশীয় দোসররা খুব দ্রুতই জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানদের তালিকা তৈরি করতে পেরেছিল। সেই তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন কেনো হলো না? সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ না হওয়া, উদ্যোগে ধারাবাহিকতার অভাব এবং সরকারের উদাসিনতার কারণেই তা সম্ভব হয়নি। ‘জাতির মননের প্রতীক’ বলে দাবি করা বাংলা একাডেমি ১৯৮৫ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছিল। ওই সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শহীদদের তালিকা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। এতে দুই শতাধিক নামও যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সংজ্ঞা আর মাপকাঠির বিষয়টি সামনে আসার পর বাংলা একাডেমির ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী : কোষগ্রন্থ’ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। যদিও ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী : কোষগ্রন্থ’তে বুদ্ধিজীবীদের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। সেখানে লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সব পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবীদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা বিভিন্ন রকম হলেও মূলত সে আলোকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
এছাড়াও বাংলা একাডেমি ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে পরে তাদের নিয়ে ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশ করে । ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সবশেষ দশম খন্ডে ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশিত হয়। এর পর আর ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশ করা হয়নি।
এর আগে স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থ অনুযায়ী শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষক ৬৩৯ জন, মাধ্যমিক শিক্ষক ২৭০ জন, কলেজ শিক্ষক ৫৯ জন ও আইনজীবী ৪১ জন শহীদ হন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর, আলশামসদের তালিকায় ছিল ৮ হাজার বুদ্ধিজীবীর নাম। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণের সময় তারা পায়নি।
শহীদ পরিবারের কয়েকজন সন্তানের অভিযোগ, শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়েও এক ধরনের অপরাজনীতি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক বুদ্ধিজীবী নিখোঁজ হয়েছেন বা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের এক ধরনের তালিকায় রয়েছেন শুধু জাতীয় ব্যক্তিত্বরা। তাদের পরিবারের সদস্যদের ডেকে নিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। কিন্তু রাজধানীর বাইরের শহীদরা এখনো আলোচনার বাইরে।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান প্রজন্ম ৭১’র সভাপতি শাহীন রেজা নূর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭১ সালে ঘাতকদের কাছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, সরকারের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। মাত্র ৬১ জনের একটি তালিকা তাদের কাছে আছে। তিনি বলেন, সারা দেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা খুব বেশি হবে না। সর্বোচ্চ কয়েকশ’ নাম এ তালিকায় আসতে পারে। তাদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারছে না। এ অবস্থায় অবিলম্বে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দুই সংগঠন ‘প্রজন্ম-৭১’ ও ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিরক্ষার বিষয়ে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. এম এ হাসান বলেন, একাত্তরে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের একটি অংশ ছিলেন বুদ্ধিজীবী। এই বুদ্ধিজীবীরা মূলত পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসরদের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার। স্বাধীনতার পর এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সেভাবে স্মরণ করা হয়নি। অবশ্য কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিরক্ষায় কিছু উদ্যোগ সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া হয়েছে, সেগুলোও করা হয়েছে শহীদ পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়-স্বজনের উদ্যোগে। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া গেছে, যারা আজও পাদপ্রদীপের বাইরে আছেন। সরকারের উচিত সেসব বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রণয়ন ও স্মৃতি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো তালিকা নেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছেও। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, আলাদা করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নেই। তবে এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। যেমন চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও ডাক্তারদের আলাদা আলাদা তালিকা রয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংজ্ঞা না থাকায় এ তালিকা তৈরি করা কিছুটা কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, হয়তো একজন শিক্ষক নিহত হয়েছিলেন, তাকে সেভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই এই তালিকা করাটা কিছুটা কঠিন। একজনের তো ডুয়েল আইডেন্টিটিও থাকে। তবে শহীদ বৃদ্ধিজীবীদের নিয়ে কাজটা হওয়া উচিত।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা তৈরিতে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এটি শেষ হলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দেওয়ার ইচ্ছে আছে। এরই মধ্যে ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রাথমিক তালিকা আছে। সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও কিছু নামের তালিকা আমরা পেয়েছি। অাশা করছি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ণের প্রকল্প শিগগিরিই আলোর মুখ দেখবে।
পিবিডি-এনই/