• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ভিআইপি আসনে ত্রিমুখী লড়াই, এরশাদ-ফারুক-পার্থ সমানে সমান

প্রকাশ:  ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৭ | আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:১৬
বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকা-১৭ (গুলশান, বনানী, ঢাকা সেনানিবাস ও ভাষানটেকের কিছু অংশ) আসনে ভোটের লড়াইটা এবার হবে জমজমাট। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন হেভিওয়েট প্রার্থীরা । রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলো অন্তর্ভূক্ত থাকায় ভোটের লড়াইয়ে এটি ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত। এবারের নির্বাচনে এখানে একাধিক হাই প্রোফাইল প্রার্থী থাকায় আসনটি ঘিরে তৈরি হয়েছে বাড়তি কৌতুহল।

আসন্ন নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন খান পাঠান ফারুক। মহাজোটের বাইরে এককভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন।আর ধানের শীষের প্রার্থী ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।

এর বাইরে এ আসনে আরেক পরিচিত প্রার্থী হলেন তৃণমূল বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সিংহ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আরও আছেন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে বিএনএফ প্রধান ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, বাঘ প্রতীক নিয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের প্রার্থী আলী হায়দার), মই প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের আহসান হাবিব, গোলাপ ফুল প্রতীকের জাকের পার্টির কাজী মো. রাশিদুল হাসান, হাতপাখা নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের মো. আমিনুল হক তালুকদার (হাতপাখা) এবং কুলা প্রতীক নিয়ে বিকল্পধারার লে. কর্নেল ডা. (অব.) এ কে এম সাইফুর রশিদ (কুলা)।

ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী সংখ্যা ১০ হলেও ভোটাররা মনে করছেন লড়াইটা হবে ত্রিমুখী লাঙ্গলের এরশাদ, নৌকার ফারক ও ধানের শীষের পার্থের মধ্যে। অন্যদের মধ্যে কিছু ভোট নাজমুল হুদা পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নব্বুইয়ের পরে সংসদীয় ব্যবস্থায় ১৯৯১ সালে প্রথমবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে দুই নারী প্রার্থীর লড়াইয়ে ৭১ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য সাহারা খাতুন। খালেদা জিয়া পরে আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির মেজর (অব) কামরুল ইসলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কামরুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হন আওয়ামী লীগের একেএম রহমতউল্লাহ। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে রহমতউল্লাহকে হারিয়ে বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম বিজয়ী হন। তখন এটি ছিল সংসদীয় আসন ঢাকা-৫।

২০০৮ সালে এ আসনটি ভেঙে সৃষ্টি করা হয় ঢাকা-১৭ আসনটি। ওই বছর অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) হান্নান শাহকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনটিতে ঘটেছিল চমকপ্রদ ঘটনা। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের। শেষমুহূর্তে তিনি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ফাঁকা মাঠে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) সভাপতি এস এম আবুল কালাম আজাদ। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও বর্তমান এমপি এলাকায় অজ্ঞাত ও অপরিচিতই রয়ে গেছেন। গড়ে তুলতে পারেননি কোনোরকম জনসমৃক্ততা, কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তাকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তবু এবারের নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হয়েছেন।

ঢাকা-১৭ আসনের ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ নিশ্চিত জয়ী হতে পারতেন যদি তাকে মহাজোটের প্রার্থী করা হতো। কিন্তু এবার তিনি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হয়েছেন। ‘অসুস্থ’অবস্থায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকায় এরশাদ নিজে মাঠে থাকতে পারছেন না। এ কারণে প্রার্থী হিসেবে শুরুতেই খানিকটা ব্যাকফুটে চলে গেছেন। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আাছেন তিনি। প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেেই ঢকা-১৭ আসনে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফয়সল চিশতী। অন্যদের আগেই পাড়া-মহল্লা ছেয়ে গেছে এরশাদের পোস্টারে।

নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে লড়বেন চলচ্চিত্রের মিয়া ভাই খ্যাত চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। এবারই প্রথম তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে তার নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত করার উপরই মূলত নির্ভর করছে ফারুকের সাফল্য। এটা মানতেই হবে যে, দেশের অন্যসব জায়গার মতোই ঢাকা-১৭ আসনের সর্বত্রই তিনি সুপরিচিত। সুজনসখি, নয়নমনি, সারেং বৌ, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে -্এসব পর্দা কাঁপানো ছবির এ নায়ক চলচ্চিত্র থেকে দুই দশক আগে সরে আসলেও আজও রয়ে গেছে তার জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে ফারুক যদি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিজের প্রচারণার টেনে আনতে পারেন, নির্বাচনী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনায় এগিয়ে থাকবেন তিনি।

একটু দেরিতে হলেও ফারুক শুরু করেছেন তার নির্বাচনী প্রচারণা। চলচ্চিত্র শিল্পীদের নিজের প্রচারণায় টেনে এনে মাঠ জমাতে চেষ্টা করছেন ফারুক। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়াও পরিকল্পনা আছে তার। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেও তাদের এখনো ফারুকের নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের কমই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এবারের ভোটে এ আসনে স্থানীয় প্রার্থী দেখতে চেয়েছিল তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর।এ আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা কাদের খান এবং ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও গুলশান থানা কমিটির সাবে সভাপতি ওয়াকিল উদ্দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের পাশ কাটিয়ে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হয় ফারককে। বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি ঢাকা-১৭ এর মাঠ পর্যায়ের আ.লীগ নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন প্রত্যাশী স্থানীয় দুই নেতাকেও ফারুক নিজের প্রচারণায় এখন পর্যন্ত টেনে আনতে পারেননি। এই গ্যাপটুকু দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে্ উদ্যোগী না হলে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারেন ফারুক। অবশ্য তার পোস্টার এখন শোভা পাচ্ছে এলাকায়।

ভিআইপি এই আসনে ২০-দলীয় জোটের প্রার্থী ধানের শীষ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ। এর আগে তাকে ভোলা-১ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকে সরিয়ে পার্থকে ঢাকা-১৭’র প্রার্থী করা হয়। ২০০৮ সালে ভোলায় ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা বিজেপির আন্দালিভ রহমান পার্থ এবারই প্রথম নির্বাচন করবেন এই আসনে। তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে এই ভোটকে দেখলেও অজানা কারণে এখনও তাকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধানের শীষের কোনো পোস্টারও কোথাও চোখে পড়েনি। প্রতীক বরাদ্দের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি সমন্বয় সভা করলেও পরবর্তীতে আর যোগাযোগ রাখেননি। টক শোর এই তুখোড় বক্তাকে ধানের শীষের প্রার্থীতা দেওয়ার পর স্থানীয় বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা শুরুতে বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্ত পরবর্তীতে তাকে নির্বাচনী মাঠে সেভাবে না-নামায় তারা খানিকটা হতাশ।

সাবেক সাংসদ আন্দালিব রহমান পার্থের বাবা মুক্তিযোদ্ধা নাজিউর রহমান মঞ্জু, যিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ছেড়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) প্রতিষ্ঠা করেন। পার্থের মা শেখ রেবা রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বোন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাইঝি। বঙ্গবন্ধুর ভাতিজা শেখ হেলালের মেয়ে শেখ সায়রা রহমানকে বিয়ে করেন পার্থ। সবদিক থেকে পার্থ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের আত্মীয়। আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করা আন্দালিব রহমান পার্থ ২০০০ সালে বাবার প্রেরণায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোলা-১ আসনে চারদলীয় জোটের হয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে নাজিউর রহমান মঞ্জুর মৃত্যু হলে বিজেপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পার্থ। ২০০৮ সালের সংস নির্বাচনেও নিজ আসন থেকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা-১৭ আসনে নতুন প্রার্থী হলেও শিক্ষিত ভোটার অধ্যুষিত এ এলাকায় তিনি পরিচিত। এই পরিচিতির সঙ্গে পার্থ যদি বিএনপির নেতাকর্মীদের একাত্ম করতে পারেন, তাহলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশবাসীর কৌতূহল সৃষ্টিকারী এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। তিনি লড়বেন সিংহ প্রতীক নিয়ে। নানা জল্পনা-কল্পনার পর এই আসনে তিনি লড়ছেন। প্রথমে তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি প্রার্থিতা ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্রের আপিল নিষ্পত্তির শেষ দিনে তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ‘সিংহ’ প্রতীক পেয়ে নাজমুল হুদা বলেন, সিংহ যেমন বনের রাজা, আমিও গুলশানের রাজা হতে চাই। তবে বড় কোনো ব্যানার তাকে ছায়া না দেওয়ায় নাজমুল হুদা সাফল্য কতটুকু পাবেন তা নিয়ে সংশয় আছে সবারই।

উল্লেখিত চার প্রার্থী ছাড়া ঢাকা-১৭ আসনে রয়েছেন আরও ছয় প্রার্থী। তাদের নিয়ে যেমন কোনো আলোচনা নেই, তেমনি মাঠে নেই তাদের পদচারণা।

পিবিডি

ঢাকা-১৭
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close