• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শুধুই আশ্বাস

প্রকাশ:  ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১০ | আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১১
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শুধুই আশ্বাস! এ বৃহৎ শ্রম বাজারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও অদৃশ্য সংকটে আটকে আছে জনশক্তি প্রেরণ। দেশটির অনেক কোম্পানির মালিকরা শ্রমিকদের চাহিদাপত্র চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা করলেও মিলছে আশ্বাস।

দেশটিতে বৈধভাবে জনশক্তি প্রেরণ এক প্রকার থমকে থাকায় বাস্তবে তেমন কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ভুক্তভোগী জানান, বিভিন্নজনের কাছে টাকা, পাসপোর্ট দিয়ে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কবে খুলবে এই বন্ধ দুয়ার তা মালয়েশিয়া সরকার ছাড়া কেউ জানে না। তবে সম্ভাবনাময় এ শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন অফলাইন পদ্ধতি কার্যকর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মহ. শহীদুল ইসলাম।

এদিকে পাইপ লাইনে আটকে থাকা ২৫ হাজার কর্মী এখনো বাংলাদেশ থেকে এসপিপিএ পদ্ধতিতে (আগের নিয়ম) আসতে পারেনি, তাদের জন্য মালয়েশিয়া সরকার দুই মাস সময় বাড়িয়ে ছিল অর্থাৎ গেলো বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল।

এ বিষয়ে ম্যান পাওয়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেঁধে দেযা সময়ের মধ্যে অনেক কর্মীর ভিসা ষ্ট্যাম্পিং হওয়ার পরেও বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র না দেয়ার কারণে তাদের পাঠানো সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিবতুন রাজাকের আমলে বাংলাদেশ থেকে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় আড়াই লাখ কর্মী দেশটিতে পাড়ি জমায়।

এসব শ্রমিক সে দেশে যাওয়ার একবারে শেষের দিকে মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নাজিব রাজাক সরকারের দলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপরই নাজিব সরকারের আমলে শ্রমবাজারে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এর পরই সিনারপ্লাক্সের তৈরি করা এসপিপিএ সিস্টেম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় মাহাথির সরকার।

এ নিয়ে শ্রমবাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও থেমে যায়নি কুটনৈতিক তৎপরতা। মালযেশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সে দেশের সরকার পুরনো সিস্টেম (এসপিপিএ) বাংলাদেশ থেকে আর কোনো কর্মী নেবে না। তারা সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করলেও নতুন অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী নেয়া হবে বলে গেলো বছর মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দুটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং বৈঠকে অংশ নেয়া হাইকমিশন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন। এ ছাড়া তারা যে পদ্ধতিতে লোক নেবে, সেখানে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট থাকবে না বলেও মাহাথির সরকারের সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়। তবে নতুন কোন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যাবে সে ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা জানাতে পারেননি।

এবিষয়ে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাইলে হাইকমিশনের শ্রম শাখার দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, স্থগিত থাকা কর্মী নিয়োগের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে মালয়েশিয়া সরকার। খুব শিগিগিরই নতুন পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে বলে দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কবে নাগাদ কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রম শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার উম্মুক্ত করতে এক মাসের ব্যবধানে দুটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা কখনোই অতীতে অনুষ্ঠিত হয়নি। নিঃসন্দেহে এটি একটি অসাধারণ বিষয়। তারা বলছেন, যখনই দুই দেশের সরকারের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাবে, তখনই নতুন পদ্ধতি কার্যকর হবে।

এ দিকে জীবিকার তাগিদে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকরা জানান, মালযেশিয়ার শ্রম বাজার চালু না থাকলেও দালালদের কাছে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে রেখেছেন তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সমৃদ্ধির জন্য প্রবাসী আয় একটি সম্ভাবনাময় খাত। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রবাস থেকে দেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে প্রবাসে কর্মরত রয়েছেন ১ কোটির উপরে। প্রতিবছরই দেশে নতুন করে প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে। যে হারে শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে, সে হারে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারের হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সরকারি বা বেসরকারি যে খাতেই হোক এ দেশের বেকাররা কাজ করে বাঁচতে চায়। কিন্তু সে আকাংক্ষা দেশীয়ভাবে পূরণ না হওয়ায় পরিবার ও দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে যুব সমাজ।

বিদেশে বাংলাদেশি প্রতি চারজনের তিনজন কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও মালয়েশিয়ায়।

মালয়েশিয়ায় প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে দু’দেশের সরকারি পর্যায়ে অর্থাৎ জিটুজি পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। মূলত ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় লোক নেয়া শুরু হলেও শুধু প্লান্টেশন প্রজেক্টে কাজ করতে আগ্রহ কম থাকায় জনশক্তি রফতানির হার ছিল কম। পরে মালয়েশিয়া জনশক্তির জন্য বাংলাদেশকে তাদের ‘সোর্স কান্ট্রির’ তালিকাভুক্ত করে। ফলে সেবা, উৎপাদন, নির্মাণসহ অন্যান্য খাতেও বাংলাদেশি কর্মী নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানির সাথে যুক্ত কিন্তু সুযোগ সন্ধানী এজেন্সি মালয়েশিয়ার উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাড়তি অর্থ আদায় করে কর্মী পাঠানো শুরু করে।

প্রকৃত অর্থে মালয়েশিয়ার স্বপ্ন দ্রষ্টা, উন্নয়নের স্থপতি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় না আসলে হয়তো মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারি মদদপুষ্ট আদম ব্যবসায়ীদের রাহুগ্রাস বন্ধ হতো না। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সরকারের সময় বাংলাদেশ সরকারের তরফে সকল এজেন্সিকে লোক প্রেরণের ক্ষেত্রে সুযোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও কোন প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ১০ কোম্পানির সুযোগ সুবিধাকে বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে ৪০ হাজার টাকার স্থলে ৩/৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। বর্তমান মাহাথির মোহাম্মদের সরকার মালয়েশিয়ার উন্নয়নে কাজ করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশিদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এখনও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের প্রচুর কদর রয়েছে। কারণ আমাদের দেশের কর্মীরা কর্মঠ এবং আন্তরিক। যাদের প্রেরিত অর্থে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। যারা কাজের আশায় অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছেন। অনেককেই সাগরে ডুবে মরতে হয়েছে। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ কিনারের দেখা পেলেও বনে জঙ্গলে মাসের পর মাস পালিয়ে থেকে কাজ খুঁজতে হয়েছে। অনেককেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কাউকে দালাল চক্র আটকে রেখে মুক্তিপণ পর্যন্ত আদায় করেছে। টাকা দিতে না পারার অপরাধে হাত পা পর্যন্ত কেটে নেয়া হয়েছে। সে এক অমানবিক বিভৎসতা, যা কল্পনা করাও যায় না। অভিশপ্ত এ জীবন কাহিনী অনেকের ভাগ্যে জুটেছে।

আমরা আশা করি, মানব সম্পদকে কাজে লাগাতে মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকার আন্তরিক হবেন। শত অনিয়ম, নির্যাতন বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা নিবেন। অবশ্য ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন মানবপাচারে জড়িতদের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করলেও তা আলোর মূখ দেখেনি। কারণ আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজদের শিকড় অনেক গভীরে। তারা পরম ক্ষমতাশালী। যারা পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন। সবসময় থেকে যান ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। আবার কোন কোন সময় চুনোপুটিরা ধরা পড়ে যায়। কার্যত কাজের কাজ কিছুই হয় না। আর বড় কোন নতুন ঘটনার নিচে চাপা পড়ায় তদন্ত কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এসব ঘটনা পর হর হামেশাই ঘটছে। যা নতুন কিছুই নয়। অধিক জনসংখ্যাই আমাদের মানবসম্পদ।

বিশ্লেষকরা বলছেন এই মানব সম্পদকে দেশে বিদেশে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এ জন্য সরকার মালয়েশিয়ার সরকারের সাথে কুটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে কর্মী প্রেরণে দ্রুততর কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এটাই কর্মমুখী মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা এবং মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি বাড়ানো গেলে এ আয় আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পিবিডি/পিএস

মালয়েশিয়া,শ্রমবাজার,বাংলাদেশ,হয়রানি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close