• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

অভাবনীয় ‘রিজওয়ান’, কুর্নিশ সৈয়দ জামিল আহমেদ

প্রকাশ:  ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১০:৩৯ | আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১০:৪০
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

আকাশে কিছুটা মেঘ জমেছে, এরই মধ্যে হাতের কাজ শেষ করে বের হতে হলো শিল্পকলার দিকে। উদ্দেশ্য সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় মঞ্চনাটক ‘রিজওয়ান’ দেখা। ৪টার শো দেখবো ভেবে সাড়ে ৩টায় অফিস থেকে বের হওয়া; কিন্তু টিকেট মিলছে কি না সে নিয়ে একটা অনিশ্চিয়তা রয়েই গেছে, অনিশ্চিয়তা রয়েছে সঠিক সময়ে হলের ভিতর প্রবেশ করার নিয়েও, কারণ ঢাকার রাস্তায়- সবই অনিশ্চিয়তা!

ভাগ্য সহায় হলে জয় মিলবে নিশ্চিত, আমার ক্ষেত্রেও হয়তো কিছুটা এমনই হয়েছে- ভাগ্যদেবতা প্রসন্ন হয়েছেন বলেই হয়তো গুলশান এক থেকে সেগুনবাগিচায় অবস্থিত শিল্পকলায় যেতে লেগেছে মাত্র ১৫ মিনিট! কিন্তু শিল্পকলার গেটে দাঁড়াতেই মনে হলো ভাগ্যদেবতা ঠিক কতটা প্রসন্ন হয়েছেন? টিকেট কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম টিকেটের জন্য রীতিমত যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন ‘রিজওয়ান’ দেখতে আসা দর্শক। গেটের এক পাশেই অভিনেতা শহীদুল ইসলাম সাচ্চু এবং জিয়াউল হাসান কিসলুকে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছেন, টিকেট পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট।

সম্পর্কিত খবর

    আমার টিকেটটি এক বড় ভাই এর কল্যাণে আগে থেকেই রিজার্ভ করা ছিল বিধায় কিছুটা নিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু তখনই কাউন্টার থেকে ভেসে আসে- রিজার্ভেশনের টিকেট যারা এখনো সংগ্রহ করেননি, তাদের টিকেট ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মাথায় হাত! এত কষ্ট করে এসে তবে কী ‘রিজওয়ান’ না দেখেই ফিরতে হবে? না! বড় ভাই ফোনে আশ্বাস দিলেন- মৎস্যভবনের কাছাকাছি চলে এসেছি, তুমি টিকেট দুইটা হাতে নাও। কাউন্টারের ধারের কাছেই তো যেতে পারছি না, টিকেট নেবো কী করে? আমার আত্মনাদ! বড় ভাই মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে এলেন। কিন্তু কাউন্টার থেকে বলছে আর টিকেট নেই। সবাইকে ঠেলেঠুলে বড় ভাই এগিয়ে গেলেন, হাত বাড়িয়ে বললেন আমার নামে দুটি টিকেট বুকড ছিল, আমার টিকেট দুইটি দেন। কাউন্টার থেকে খুবই বিব্রত বা বিরক্ত হয়ে বললেন শেষ দুইটা টিকেটই আছে, কাকে দেবো? বড় ভাই চেঁচিয়ে উঠে জানালেন- আমাকে দেবেন, আমার নামে টিকেট রিজার্ভ ছিল বলে, কাউন্টারে থাকা ভদ্রলোকের হাত থেকে টিকেট দুটি দ্রুতই নিয়ে নিলেন। চারটা বাজতে দুই মিনিট বাকি! কাউন্টারে এখনো দাঁড়িয়ে থাকা গোটা পনেরজন ব্যক্তির অসহায় মুখকে পিছনে রেখে ছুটে চললাম এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলের দিকে, ওইখানেই মঞ্চায়িত হচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত নাটক ‘রিজওয়ান’।

    আমরা হলে প্রবেশের আগেই পুরো হল লোকে লোকারণ্য, হলের ভিতর যেন তিল ধারণের জায়গা নেই আর। বড় ভাই তার টিকেট নিয়ে ইতোমধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছেন, সেটা খোঁজার চেষ্টা না করে নিজের বসার জন্য একটা সিট খুঁজছিলাম। আমার পেছনে এখনো কিছু মানুষ ঢুকছেন, তাদের টিকেটগুলো হয়তো আগে থেকেই সংগ্রহ করা। হলে ঢুকার মুখে দুই একজন মোবাইলে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে মঞ্চের ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন, হলের তৃতীয় স্তর থেকে ভেসে আসলো একটি ভারি কণ্ঠ- ‘হলের ভিতর আপনারা কেউ ফ্ল্যাশ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবেন না, প্লি......জ!’ কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই আহবানে এমন কিছু আছে, যাতে সবাই যারা যার ফোনটি পকেটে ঢুকাতে বাধ্য হলেন। কণ্ঠটি ছিল খোদ নাটকটির নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদের।

    নিজের জন্য একটিও সিট না পেয়ে বাধ্য হয়েই সিড়িতে বসে পড়তে হলো। মিনিট খানিকের মধ্যে শুরু হলো বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘রিজওয়ান’ এর প্রদর্শনী। দৃশ্যে দেখা যায় ‘ফাতিমা’কে, যার বর্ণনাতেই আমরা ভ্রমণ করে আসি পৃথিবীর জান্নাত, একটি পরিবারের নির্মম পরিণতি, নিপীড়িত মানুষের অসহায়ত্ব, এবং একজন স্বপ্নবান যুবক ‘রিজওয়ান’ এর ট্রাজিক পতন। রিজওয়ান ডাকপিয়নের কাছে একটি ঠিকানাবিহীন চিঠি পাঠায়, যেখানে লেখা থাকে- আসসালামু আলাইকুম। আপনারা কেমন আছেন? এখানে আমরা সবাই ভালো আছি। শুকরিয়া- রিজওয়ান’। মেটাফোরিক এই দৃশ্যের ব্যবহার দর্শককে অবশ্যই নিয়ে যাবে এক অদ্ভুত ইল্যুশনের ভিতর।

    নাটকের শুরুতে ফাতিমা আর তার ভাই রিজওয়ানের স্মৃতিচারণ এবং বিচ্ছেদ দর্শককে কিছুটা ধন্ধে ফেলে দিতে পারে, কিংবা ভাবাতে পারে- গল্পটি আসলে কোনদিকে আগাচ্ছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটকের ভিতরে ঢুকে যেতে হবে যখন স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আগমনে অনেকটা সময় নিয়ে নিচ্ছিল কাশ্মীরের এক ছোট্ট শিশু রিজওয়ান। দেরী করে পৃথিবীতে আগমনের জন্য জন্মের আগেই পিতামহ তার নামকরণ করেন, রিজওয়ান- যার অর্থ স্বর্গের পাহারাদার।

    নাটকটিতে ফাতিমার মুখে একটি সংলাপ বহুবার ভেসে আসে- ‘এ দুনিয়ায় যদি কোনো জান্নাত থেকে থাকে, তবে সে জান্নাত এ মাটিতে’। এক জান্নাত থেকে আরেক জান্নাতে আগমনের আগেই রিজওয়ান তার বাবাকে হারায়। চাদর বিক্রির টাকা নিয়ে ফেরার সময় ট্রেনের মধ্যে একটা ধুলিকণার মতো গুলি এসে তার চোখে লাগে, কিছু বোঝার আগেই গুলি মাথার পিছন দিক ভেদ করে মগজ বের করে ফেলে।

    রিজওয়ান বড় হতে হতে আরো অনেকগুলো ঘটনা জেনে যাবো আমরা। একে একে শুনবো পাহাড়ের বুকে সৈনিক দ্বারা ফাতিমার ধর্ষণ এবং ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যুর বর্ণনা, তাদের আরেক ভাই ফরহাদের অন্তর্ধান, পিতামহের মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু এবং সবশেষে- হতভাগ্য রিজওয়ান যখন এই সবকটি লাশ নিয়ে নিজের ঘরে পাহারা দিচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের বাড়িটি দখল করে নেয়। পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যার অভিযোগে তারা হত্যা করে রিজওয়ানকে।

    জীবন মৃত্যুর এই স্মৃতি, ফাতিমা-রিজওয়ান ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সবকিছুর ভিতর যেন ঢুকে যেতে হয় দর্শকদের, মঞ্চ থেকে চোখ ফেরানোর এতটুকুও অবসর হয় না তাদের। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের ‘রিজওয়ান’ আসলে অতীত ও বর্তমান দুটোই কিন্তু বলে। এ জন্যই হয়তো বারবার উচ্চারিত হয়- ‘এ দুনিয়ায় যদি কোনো জান্নাত থেকে থাকে, তবে সে জান্নাত এ মাটিতে’। আরেকটি সংলাপ হয়তো ধাক্কা দিতে পারে প্রতিটি দর্শকদের হৃদয়- রিজওয়ান যখন তার মা’কে প্রশ্ন করেন, ‘কি হয় যদি কোনোকিছুই আর চিরদিন না থাকে, তার কি হয়ে, যে থাকে না চিরকাল’।

    নাটকটির মূল আকর্ষণ সৈয়দ জামিল আহমেদের অসাধারণ নির্দেশনা। মঞ্চের প্রতিটি অংশকে উপযুক্ত ব্যবহারের এই প্রতিভা দেখে অভিভূত হতে হয়। প্রতিটি চিত্রকল্প, সংলাপ, অভিনয় এবং সাউন্ডের মিশ্রণকে অবশ্যই প্রশংসনীয় বলতে হয়। রিজওয়ান চরিত্রে তিতাস জিয়া এবং ফাতিমা চরিত্রে মহসিনা আক্তার- দুজনই ছিলেন অনবদ্য।

    উর্দু কবি আগা শাহী আলীর ‘অ্যা কান্ট্রি উইদাউট অ্যা পোস্ট অফিস’ কাব্য অবলম্বনে ‘রিজওয়ান’ এর নাট্যরূপ দিয়েছেন ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার অভিষেক মুখোপাধ্যায়। আর নাটকটির অনুবাদ করেছেন ঋদ্ধিদেশ ভট্টাচার্য্য। জীবন-মৃত্যুর এই রকম মেটাফোরিক সংযোজন ‘রিজওয়ান’ দর্শকদের মোহগ্রস্থ করে রাখবে অনেকদিন। ‘বিষাদ সিন্ধুর’ বহু বছর পর সৈয়দ জামিল আহমেদের আবার নির্দেশনায় আগমন অবশ্যই তার ভক্তদের জন্য একটি সুখবর, টিকেটের জন্য এই হাহাকার মঞ্চনাটকের জন্য একটি অভাবনীয় শুভ বার্তা।

    সুত্র: প্রিয়.কম

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close