• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

আবারও মঞ্চে নিত্যপুরাণ

প্রকাশ:  ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ২০:০৩
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

নিত্যপুরাণ দেখে অভিভূত হয়েছি। অভিভূত হওয়ার কারণ আছে। নিত্যপুরাণ মহাভারতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। কবি লড়াইয়ের মতো যুক্তিতর্কে মন্থন করেছে মহাভারত। তাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে সত্য। যে সত্য আড়াল করেছিল মহাভারত তার কৌলীন্য বজায় রাখতে। নাটক দেখে তাই যেমন আলোড়িত হয়েছি তেমনি অক্ষম মহাভারত স্মরণে হয়ে পড়েছি অস্থির। নিত্যপুরাণ দেশ নাটক প্রযোজনা। রচনা-নির্দেশনায় ছিলেন মাসুম রেজা।

নিত্যপুরাণের শরীরে মোড়ানো প্রেম। পঞ্চপতির এক ভার্যা দ্রৌপদী উপস্থিত হয় অরণ্যচারী যুবক একলব্যর সামনে। একলব্যর বীরত্ব ও কথায় মুগ্ধ হয় দ্রৌপদী। নিজের ভেতর শুরু হয় উথালপাথাল ভাঙন। কাতর কণ্ঠে একলব্য বলে, 'বেশি তো চাইনি দ্রৌপদী, এক ফোঁটা শুধু, কড়ে আঙুলের নখ থেকে তুলে দেওয়া এক ফোঁটা প্রেম।' পরাস্ত হয় দ্রৌপদী। কাতর হয়ে আসে। ধীরশান্ত অথচ ব্যাকুল চোখে বলে, 'একলব্য এত গভীর আকাঙ্ক্ষা তোমার প্রেমের? যা পাওনি কোনোদিন, তার এক ফোঁটা পেলে ভরে যাবে তোমার শূন্য হৃদয়? কড়ে আঙুলের নখ থেকে তুলে দেওয়া এক ফোঁটা প্রেম!

সম্পর্কিত খবর

    মহাভারতে একলব্য অতি সামান্য একজন। নিতান্তই গল্পের প্রয়োজনে তার আগমন। নিত্যপুরাণে একলব্য বীর-নায়ক। সাধারণ মানুষ। বুকে সাহস আছে, বুদ্ধি আছে শতভাগ, আর আছে মনে জমাট প্রেম। তবু সে ভ্রষ্ট সমাজের কূটচালে বাধা পড়ে জটিল ধাঁধায়। তাকে পরাস্ত করে যুক্তি নয়, মিথ্যার আশ্রয়। সাহিত্য বা দৃশ্যকাব্য তখনই শিল্প হয়ে ওঠে যখন সে সাধারণ দ্রষ্টব্যকে ছাপিয়ে গভীরে ভাবায়। নিত্যপুরাণ সেখানেই অনন্য।

    হাজার বছর ধরে মহাভারত নারীকে অবগুণ্ঠনে লুকায়। নিত্যপুরাণে সেই নারী মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। একলব্য জোর দিয়ে বলে, 'এক বছর ধরে দ্রৌপদী ভালোবাসবে একজনকে, অবগাহন করবে তার জলে, আকুল আলিঙ্গনে, উষষ্ণ নিঃশ্বাসে, সমুদ্র মন্থনের মতো প্রেম জমবে শয্যায়, এক বছর। অতঃপর সবই শেষ, বছরের শেষ দিন শেষে নতুন পতি, নতুন প্রেম, নতুন শয্যা পুনরায়। ভালো লাগে? ভালো লাগে এই শর্ত পাঞ্চালী? শুধু একটা, অন্তত এই সত্যটা বলুন, ভালো লাগে এই শর্ত?'

    মহাভারতে এমন প্রশ্ন কোনোদিন করা হয়নি। ধর্মের বাতাবরণে পঞ্চপতির এক ভার্যা দ্রৌপদীকে মহীয়সী নারীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। নিত্যপুরাণ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে মহাভারতের। স্পষ্ট উচ্চারণে জানতে চেয়েছে এমন অপমান, অসম্মান, অমর্যাদার জীবন পেয়ে সে কেমন আছে। দ্রৌপদী সমাজে গড়া পুতুল নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠে। মহাভারতের দ্রৌপদী অসম্ভব রূপবতী এক নারী। নিত্যপুরাণ নাটকের যে ভাষা, যে গম্ভীর উপস্থাপন সেখানে কুশীলবের চেহারার সৌন্দর্য গৌণ। নাটকে দ্রৌপদীর ভেতরের যে দোলাচল, ঠমক, আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা ও অসহায় আবেগে ভেঙে পড়া তা অসাধারণভাবে উঠে আসে নাটকের কথায়। নাট্যকারের এ এক বিরাট মুন্‌শিয়ানার কাজ। একইভাবে একলব্য বা পঞ্চপাণ্ডবের বেলায়ও সেই কথা খাটে। নাট্যকার এখানে নির্দেশক, তিনি ঘটনা উপস্থাপন করেছেন চমৎকারভাবে।

    প্রসেনিয়ামে দাঁড়িয়ে নির্দেশক নিত্যপুরাণে লোকনাট্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিপুল বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। প্রপসের ব্যবহার, পোশাক, তীর চালনা, মঞ্চে হাঁটাচলা, আলো প্রক্ষেপণ এসবই লোকনাট্য ভাবনা। অসাধারণ অভিনয় সবার। নিত্যপুরাণ আমাদের নাটকের বিশাল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উপচেপড়া নাটকের দর্শক। পরপর দুই দিন। টিকিট আর বসার জায়গা না পেয়ে দর্শক ফিরে গেছেন। তার মানে ভালো নাটকের দর্শক আছে। আমাদের মঞ্চে বেশি-বেশি ভালো নাটক হওয়া দরকার। যে নাটক মানুষের জীবনের কথা বলে। সংগ্রাম করে টিকে থাকার সাহস জোগায়।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close