• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

যুগে যুগে একজন হুমায়ূন

প্রকাশ:  ১৯ জুলাই ২০১৮, ০০:৫৭ | আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৮, ১১:২৮
রবিউল কমল

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ চলে গেছেন ছয় বছর আগে, তবে তিনি প্রস্থান করেন নি মোটেও। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে আছেন তার অসংখ্য সৃষ্টিকর্মে। তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্রে আমার আজও খুঁজে পাই। আজও বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের শীর্ষে থাকে হুমায়ূন আহমেদের নাম। তাঁর সহজিয়া ভঙ্গিমার গদ্য ছুয়ে যায় বার বার মানুষের অন্তর। বাংলাসাহিত্যের অভূতপূর্ব জনপ্রিয় এই লেখক যুগে যুগে আলোকবর্তিকা হয়ে বাঙালি মননে আলো ছড়িয়ে যাবেন, বেঁচে থাকবেন তিনি তার সৃষ্টির মাঝে।

দেখতে দেখতে হুমায়ূন আহমেদ প্রয়াণের ছয়বছর পেরিয়ে গেল। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে (১৯ জুলাই) ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে মারা যান। মাত্র ৬৪ বছরে জীবনের দীপ নিভে যাওয়া হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্মরণ করছে বাংলাদেশের মানুষ।

হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জের থানার কুতুবপুর গ্রামে। বাবা ফয়জুর রহমান ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। ফলে তার শৈশবের দিনগুলো ছিল অনেক রঙিন এবং মধুর। শৈশবে একবার তাঁর মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাঁর স্মৃতিবিভ্রম দেখা দেয়। তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, এমন কি তাঁর ছেলেকেও না। ফলে হুমায়ূন আহমেদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। সেখানে দু’বছর তিনি নানা-নানির আদরে বেড়ে উঠেন। বাবার চাকরি সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিচিত্র সব দৃশ্যাবলীর ভেতর দিয়ে তিনি ঘুরে ঘুরে তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন।

শৈশবে হুমায়ূন আহমেদ যত জায়গায় গিয়েছেন তার মাঝে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলো দিনাজপুরের জগদ্দল। কারণ স্কুলে যেতে তার ভাল লাগতো না আর জগদ্দলের আশেপাশে কোনও স্কুল ছিল না। তবে প্রাইমারি স্কুল পাশের পর হুমায়ূন বদলে যান। ষষ্ট শ্রেণীতে উঠার পর থেকে স্কুলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগ্রহটা এমনি ছিল যে এস.এস.সি. পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এস.এস.সি. পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচ.এস.সি. পাস করেন। এইচ.এস.সি. পরীক্ষাতেও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর পাশ করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি নেন। ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখিতে অধিক সময় এবং চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেবার জন্য পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দেন।

‘নন্দিত নরকে’ যখন প্রকাশ হয় তখনই বোঝা গিয়েছিলো কথা সাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি, থাকতেই এসেছেন। ফলে এদেশের সাহিত্যাকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন। তাঁর মধ্যে এই অমিত সম্ভাবনা তখনই টের পেয়ে প্রখ্যাত লেখক সমালোচক আহমদ শরীফ এক গদ্যের মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আহমদ শরীফের প্রশংসা যে অপাত্রে ছিল না তা তো আজ সর্বজন বিদিত।

হুমায়ূন আহমেদ একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং নাট্যকার। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।

১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ‘নন্দিত নরকে’ যখন প্রকাশ হয় তখনই বোঝা গিয়েছিলো কথা সাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি, থাকতেই এসেছেন। ফলে এদেশের সাহিত্যাকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন। তাঁর মধ্যে এই অমিত সম্ভাবনা তখনই টের পেয়ে প্রখ্যাত লেখক সমালোচক আহমদ শরীফ এক গদ্যের মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আহমদ শরীফের প্রশংসা যে অপাত্রে ছিল না তা তো আজ সর্বজন বিদিত। মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। বেশ কিছু সার্থক সায়েন্স ফিকশন-এর লেখকও তিনি। জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর ¯্রষ্টা তিনি- যে দু’টি চরিত্র যথাক্রমে লজিক এবং এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে।

হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। যা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। এছাড়াও ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি দশকপ্রিয় এবং প্রশংসিত। টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয়। তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ মধ্য আশির দশকে তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়ো’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে মিছিল হয়েছিলো। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এমনটি আর হয়নি কখনো। নাট্যকার- নির্দেশক দুই ভূমিকাতে সমান সফল তিনি।তাঁর সফল শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলা। তাঁর চিত্রশিল্পের স্বাক্ষর নিজ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) প্রিয় এই মানুষটির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। নিজের হাতে গড়া নন্দনকানন নুহাশপল্লীর লিচুগাছ তলায় মাটির বিছানায় শুয়ে আছেন হুমায়ুন আহমেদ। সেখান থেকেই আজও আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুরো বাংলাদেশে।

এক মহাজীবনের,হুমায়ূন আহমেদ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close