ছোটগল্প: অস্তিত্ব
এভাবে আর কতদিন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নাহয় আরেকটা বিয়ে কর। আবার নতুন করে ঘর বাঁধ।
রাইদ তার স্ত্রী হারিয়েছে সে বহুদিন হল। খুব ভালোবাসত সে তার স্ত্রীকে। পাঁচ বছরে আত্মীয়স্বজনরা বহুবার ধরেছে তাকে বিয়ে করানোর জন্য। কিন্তু সে রাজি হয় নি। কিভাবে রাজি হত সে? তার মনে এখনো মিলির বাস। মিলি, হ্যাঁ,মিলিই সেই মেয়েটি। যে মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল তার। না,তার চেহারার মধ্যে বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু তার উপস্থাপন মুগ্ধ করেছিল তাকে।
সম্পর্কিত খবর
কলেজের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বক্তা ছিল সে। সেদিন "বাংলাদেশের শিক্ষা অনগ্রসরতার প্রধাণ কারন দারিদ্র্য" এই বিষয়ে বিতর্ক চলছিল। সমাপনী ভাষণ দিতে দলনেতা হিসেবে উঠেছিল মিলি। তখন সবার মনোযোগ তার দিকে ছিল। রাইদও সবার মত মনোযোগ দিয়েছিল তার দিকে। সেদিন তার বক্তৃতা শুনেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল রাইদ। এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথ বলতে পারে মিলি,মিলির এ গুণটাই মুগ্ধ করেছিল তাকে।
তারপর বহু চেষ্টা করে তাকে খুঁজে বের করেছিল রাইদ। সে নিজে ছিল সাইন্সে,কিন্তু মিলি ছিল কমার্সে। তাই ঠিক কিভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত জানা ছিল না তার। সে সুযোগটা একদিন ঠিকই মিলে গেল।
একদিন মিলিকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। লাইব্রেরীরুমে বসে মাথা চাপড়াচ্ছিল বার বার মিলি। তাই দূর থেকে দেখছিল রাইদ। সাহস করে এগিয়ে গেল।
-কি ব্যাপার? আপনি ঠিক আছেন তো।
-না ঠিক নেই।
-কেন কি হয়েছে?কদিন পর ইংলিশ ডিবেট কম্পিটিশন। আর আমার ইংলিশ স্কিল তেমন ভালো না। ম্যাডাম আমাকে না বলেই আমার নাম দিয়ে দিয়েছে। এখন ম্যাডামের মন খারাপ হবে বলে বাদও দিতে পারছি না।
রাইদ কিছুক্ষণ থামল। বুঝতে পারছে সে বিষয়টা। নিজের স্কিলটা অতটা ভালো না হলেও এ সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি।
- আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
সাহস করে বলে ফেলে সে।
-সত্যি?
-অবশ্যই।
-অনেক অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা নাম কি তোমার?
-রাইদ।
-আমি মিলি।
-আমি জানি।সে প্রথম চোখে চোখ পড়েছিল তাদের। তারপর রাইদ ইউটিউব,বন্ধু,টিচারদের সহায়তায় নিজের স্কিল বাড়াতে থাকল আর মিলিকে ফ্রি টিউশন দিতে থাকল। তাদের ঘনিষ্ঠতাও বাড়তে থাকল। ভালোবাসি বলতে যদিও রাইদের লেগে গেছিল পুরো কলেজ লাইফের শেষ দিনটা। তবু দুজনের মনে ব্যাপারটা আগেই গেথে গেছিল যে তারা দুজন দুজনের জন্যই তৈরি।
সেবার ডিবেট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মিলি। প্রতিটা পর্বেরই ভিডিও করেছিল রাইদ। এক এক্সিডেন্টে মিলি মারা যাওয়ার পর এমন কোনো রাত নেই যেদিন সে সেই ভিডিওগুলো দেখে না। প্রতিদিনই মিলির বক্তৃতা শেষ হলে সে তালি বাজায়,ফিরে যায় কলেজের দিনগুলোতে।
মিলি ও রাইদের সংসার আলো করে আসে তাদের একমাত্র মেয়ে ইশিতা। মিলির মৃত্যুর পর সব দায় রাইদের উপর এসে পড়ে। মা বাবা দুজনের ভালোবাসা দিয়েই ইশিতাকে মানুষ করতে থাকে রাইদ। তবুও রাইদের মার মনে হয় সংসারে কমতি আছে,কমতি আছে তার ছেলের সুখে। মা হিসেবে তা মেনে নিতে পারেন না রাইদের মা।
-বাবা,শোন।
-বল মা।
-একটা বিয়ে কর।
-এখন কি বিয়ে করার কথা না বললে হয় না মা।
-এভাবে আর কতদিন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নাহয় একটা বিয়ে কর। আবার নতুন করে ঘর বাঁধ।রাইদ ঘরে ঢুকে যায়। দরজাটা বন্ধ করে দেয়। হয়ত মা ঠিক বলেছে,হয়ত ইশিতার মায়ের প্রয়োজনটা সে কখনো মিটাতে পারবে না। তবে মিলিকেও সে কখনো ভুলতে পারবে না এটাও সে জানে। সে দরজা খুলে মায়ের দিকে তাকায়। তার মা পানের বাটা নিয়ে পান বানানোয় ব্যস্ত ছিল।
-মা আমি বিয়ে করতে রাজি।
-আলহামদুলিল্লাহ।
-তবে আমার কিছু শর্ত আছে।
-কি শর্ত?
-সে শুধুই ইশিতার মা হয়ে আসবে। আমার স্ত্রী হিসেবে না।
-না, বাবা তা হয় না। আমি কারো জীবন এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না।
-তাহলে সম্ভব না মা।
রাইদের মা কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
-ঠিক আছে। তবে আমারও একটা শর্ত আছে।
-কি শর্ত?
-বিয়ের প্রথম এক বছরে তুই তাকে মিলির মত করে দেখবি। তাকে একটা সুযোগ দিবি তোর জীবনে জায়গা করে নেওয়ার। সে যদি ব্যর্থ হয় তবে সে তোর কথা মেনে নিবে।
-ঠিক আছে।পুরো এক বছর ধরে রাইদের মা মিলির মত একজনকে খুঁজে বের করে তার জন্য। মিলির চেহারার সাথে তার চেহারার ছিল অদ্ভুত মিল,আর মিলির মত করেই গুছিয়ে কথা বলতে পারত সে। তার নাম বৃষ্টি।
রাইদের সাথে বৃষ্টির বিয়ে হয়। প্রথম দিকে রাইদ তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়,অবাক হয়ে যায় তার কথা শুনে। হয়ত চোখের সামনে সে দেখতে পাচ্ছিল মিলিরই প্রতিরূপ। ধীরে ধীরে মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায় রাইদ। সে বৃষ্টিকে নিজের অনুভূতির কথা খুলে বলে।
-না,এটা সম্ভব না।
-কেন?
-কারণ তুমি আমাকে ভালোবেসেছ কারণ আমার মধ্যে তুমি মিলির প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছ। আমি হয়ত তাতে তোমার ভালোবাসা পাব। কিন্তু সে ভালোবাসা আমার জন্য হবে না,আমার অস্তিত্বের জন্য হবে না। হবে মিলির জন্য। সেটা আমি চাই না। তুমি যেদিন আমার অস্তিত্বকে ভালোবাসতে শিখবে সেদিন আমাকে ভালোবেস,কেননা তুমি সেদিন আমাকে আর মিলিকে আলাদা করতে পারবে।রাইদ তার মাকে সব কথা খুলে বলে। সে এটাও বলে সে তার ভুলটা বুঝতে পেরেছ।
-মা,হয়ত তুমিই ঠিক ছিলে। -একটা কথা কি জানিস বাবা। প্রতিটা নারীর আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে,রয়েছে একক কিছু বৈশিষ্ট্য। সেসব বৈশিষ্ট্য তাকে অনন্যা করে তোলে। তুই চেয়েছিলি সে হবে শুধু ইশিতার মা। তবে আমি তো জানি বাবা যে তোরো কাউকে প্রয়োজন আছে। তবে তুই তার মধ্যে মিলির ছায়া খুঁজে পেয়ে তাকে ভালোবেসেছিস। এবার নাহয় তার অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো দেখ। দেখ পুনরায় প্রেমে পড়িস কি না।
রাইদ এবার বৃষ্টিকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করে। খুঁজতে শুরু করে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। অদ্ভুতভাবে সে পুনরায় প্রেমে পড়ে। এবার প্রেমে পড়ে বৃষ্টি নামের মেয়েটির। তাকে আবার সে নিজের ভালোবাসার কথা জানায়। তবে এবার তার অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণণা অনুসারে।
বৃষ্টি রাইদের ভালোবাসা বুঝতে পারে। এবার সে ইশিতার মা আর রাইদের স্ত্রী দুটো হতেই প্রস্তুত হয়। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি হল।তারা তিনজনে বৃষ্টিতে ভিজে। এ বৃষ্টি নতুন শুরুর জন্য তাদের পথ দেখায়।