সেই রাত্রির কল্পকাহিনী
তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে-,
তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,
সম্পর্কিত খবর
তারপর তোমার জন্মসহোদর ভাই, শেখ নাসের,
তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,
আমাদের নির্যাতিতা মা।এরই ফাঁকে একসময় ঝরে গেছে তোমার বাড়ির
সেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল।
এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকে
খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ-মার্কা ছবি।
এরই ফাঁকে একসময় সংবিধানের পাতা থেকে
মুছে গেছে দু’টি স্তম্ভ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।এরই ফাঁকে একসময় তোমর গৃহের প্রহরীদের মধ্যে
মরেছে দু’জন প্রতিবাদী,
কর্নেল জামিল ও নাম না-জানা এক তরুণ,
যাঁরা জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিল।তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,
তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,
লু্ঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবি,
মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিল?
তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তমা পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?
তোমার মেহেদী-মাখা পুত্রবধূদের মুজিবাশ্রিত করতল?
রবীন্দ্রনাথের ভূলুণ্ঠিত ছবি?তোমার সোনার বাংলা? সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার আগে তুমি শেষবারের মতো
পাপস্পর্শহীন সংবিধানের পাতা উল্টিয়েছো,
বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে
মেখেছো কপালে; ঐ তো তোমার কপালে আমাদের হয়ে
পৃথিবীর দেয়া মাটির ফোঁটার শেষ-তিলক, হায়!তোমার পা একবারও ঢলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।
তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্য
আহ্বান জানালে আমাদের।-আর আমরা তখন?
আমরা তখন রুটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।
তোমার বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে হাজার পাখির ঝাঁক
পাখা মেলে উড়ে গেলো বেহেশতের দিকে....।
তারপর ডেডস্টপ।তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে,
আমাদের চোখের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।
--কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।
সিঁড়ি ভিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে, সেই রক্ত,
সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দুর্বা ছোঁয়ার আগেই
আমাদের কর্নেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।