• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

শেখ হাসিনাকে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রে’র খবর এবং সংবাদসূত্র পর্যবেক্ষণের ব্যর্থতা

প্রকাশ:  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:০২
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ফেসবুক, টুইটার কিংবা অখ্যাত কোনো পত্রিকা বা অনলাইন থেকে পাওয়া সংবাদের সূত্র যাচাই না করে প্রকাশ করাকে দুর্বল ‘এডিটোরিয়াল জাজমেন্ট’-এর ফল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, বিদেশি সংবাদসূত্রের ক্ষেত্রে ‘আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্পন্ন’ কিনা তা যাচাই না করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সরাসরি সেই ব্যক্তির সঙ্গে কথা না বলে, সেসব তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন ‘ব্যাড জার্নালিজম’-এর উদাহরণ। এমনকি কেবল প্রকাশিত রিপোর্টের ওপরে নির্ভর না করে প্রত্যেক মাধ্যমের নিজেদের অনুসন্ধান থাকাও জরুরি বলে মত দিচ্ছেন তারা।

সম্প্রতি ভারতের ‘নিউজ এইটিন’ নামে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং একটি অনলাইন পত্রিকা ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর খবর পরিবেশন করে, ‘২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিল জঙ্গিরা।’ প্রতিবেদনটি করেন সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। পরবর্তী সময়ে সেই প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি অনলাইনেও খবর প্রকাশ করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টিকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে জানানো হয়। এর আগেও ‘প্রধানমন্ত্রীর কন্যার ফেসবুক পোস্ট’ উল্লেখ করে একাধিক জায়গায় অসত্য নিউজ প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সোর্স হওয়া উচিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেকোনও অবস্থাতেই এই দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মন্তব্য যুক্ত করা জরুরি। আর প্রাথমিক সূত্র হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে গ্রহণ করলেও সেটি যাচাই-বাছাই না করে কোনও কিছু দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশের সুযোগ নেই।

সম্পর্কিত খবর

    এর কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে নোবেল তালিকায় প্রধানমন্ত্রীর থাকা নিয়ে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে নামি-বেনামি কয়েকটি অনলাইন। পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফেসবুকে শেয়ারের কারণে এসব ভিত্তিহীন খবর মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়।

    পরে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে একটি বিদেশি টিভি চ্যানেল ও একটি আন্তর্জাতিক অনলাইন পত্রিকার সূত্র ব্যবহার করে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গত ২৪ আগস্ট প্রাণঘাতী হামলার ব্যর্থচেষ্টার খবর প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর ২৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হামলার খবরটি সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন, বিভ্রান্তিমূলক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশের নিরাপত্তার সার্বিক স্বার্থ পরিপন্থী এরূপ বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচার করা যেকোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সচেতন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে মোটেও কাম্য নয়। এরূপ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্কতা অবলম্বন এবং বিচার বিবেচনাপ্রসূত মিডিয়া কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’

    সোর্স নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি এবং সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংশ্লিষ্ট কোনও খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা বা এই বিষয়ে আরও অনুসন্ধানের জন্যে কী সোর্স ব্যবহার করা দরকার, সেটা নির্ভর করে খবরটা কী তার ওপরে। তবে প্রথম এবং প্রধান সোর্স হওয়া উচিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেকোনও অবস্থাতেই এই দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মন্তব্য যুক্ত করা জরুরি। এমনকি ওই দফতর কোনও মন্তব্য না করলেও সেটাও উল্লেখ করা দরকার।’

    সম্প্রতি প্রকাশিত ‘প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা’র সংবাদটি ধরে বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে একাধিক সূত্রের কাছ থেকে আলাদা-আলাদাভাবে নিশ্চিত হওয়া খুবই দরকার ছিল। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর দফতর। দ্বিতীয়ত, যেহেতু নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়ে উল্লেখ ছিল, সেহেতু আইএসপিআর-এর বক্তব্য জরুরি ও অত্যাবশ্যক ছিল। তৃতীয়ত, যে বিশেষ বাহিনীর কথা বলা হয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা যেত। চতুর্থত, কেবল একটি রিপোর্টের ওপরে নির্ভর না করে প্রত্যেক মাধ্যমের নিজেদের অনুসন্ধান করা দরকার ছিল। সবশেষে, সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে এটা জানার চেষ্টা করা যেত, তাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ ও সাক্ষ্য আছে কিনা।’

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান তথ্য কমিশনার ড. মো. গোলাম রহমান মনে করেন, গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কেবল স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রেই নয়, যা কিছু পাঠকের কাছে দেবে তা যেন যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। সংবাদে উল্লেখ করা প্রতিটি পক্ষের কাছে বিষয়টি নিয়ে হাজির হতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক স্পর্শকাতর বিষয়ে আরও সাবধানী আচরণ করা উচিত।

    ড. গোলাম রহমান আরও বলেন, ‘কোনও সেকেন্ডারি সোর্স থেকে কোনও তথ্যসূত্র পেলে, সেটা ধরে তার গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা থাকতে হবে। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো এসব নিয়ে কমই চিন্তা করে। নিউজ পেলেই ছেপে দিচ্ছে। কারা কোথা থেকে কেন তথ্য দিলো, তা ভেবে দেখছে না। এটা দায়িত্বশীলতা না।’

    নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বাংলাদেশের ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম মনে করেন, সম্পাদকীয় জাজমেন্টের জায়গা দুর্বল হলে, সোর্স যাচাই না করে যেকোনও মাধ্যমে প্রকাশিত টেক্সটকে সংবাদ হিসেবে হাজির করবে। সেটি সাংবাদিকসুলভ আচরণ নয়। তিনি বলেন, ‘প্রোপাগান্ডা ও নিউজের মধ্যে পার্থক্য সাংবাদিককে বুঝে নিতে হবে।’ প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিন একটি টক শো’র মাধ্যমে ‘প্রধানমন্ত্রীর হত্যাচেষ্টা’ বিষয়ক প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জুলহাস বলেন, ‘‘তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সাংবাদিকতার কোন মানদণ্ডে আপনার প্রতিবেদনটি প্রশ্নাতীতভাবে সত্য ধরে নিতে পারবো। উনি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘পাকিস্তানি জেনারেলরা চুপ কেন।’ এসব ক্ষেত্রে আমরা যখন প্রতিবেদনটি ক্যারি করার সিদ্ধান্ত নেবো, তখন পিএমও, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, নিউজ এইটটিন বা মিজিমা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনও গণমাধ্যম না।’’

    তিনি মনে করেন, এই জায়গায় এডিটোরিয়াল পলিসি একটি বড় বিষয়। জুলহাস বলেন, ‘এডিটোরিয়াল জাজমেন্ট দুর্বল হলে এ ধরনের নিউজ ছাপা হয়। বিদেশি কোনও পত্রিকা থেকে কোনও সংবাদ পেলে সেটা চেক না করে, সেটি সঠিক তথ্য দিচ্ছে কিনা, তা না বুঝে হুবহু প্রকাশের কোনও সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে যখন সংবাদ তৈরি হবে, তখন আরও সতর্ক হতে হবে। কেননা, ফেসবুক পেজটি বা পোস্টটি সেই সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির কিনা, সেটি না জেনে দায়ভার নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এটি না করলে তা ব্যাড জার্নালিজমের উদাহরণ তৈরি করবে।’

    ফরাসি বার্তা সংস্থা এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেসের (এএফপি) ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংবাদ করার সময় মনে রাখতে হবে— সোর্স হিসেবে কোনও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করলে ওই অ্যাকাউন্ট যে আমার সোর্সেরই, সেটা নিশ্চিত কিনা। যদি নিশ্চিত হই, তবে ভেরিফাইড পেজ না হলেও সে তথ্য আমি ব্যবহার করতে পারি। তবে সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে ভেরিফাইড পেজ ছাড়া এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ না করে নিউজ করা রিস্কি; এটা উচিতও না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনটা ফেক নিউজ লিংক, কোন নিউজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত— সম্পাদকীয় বোর্ডে যারা থাকবেন, তাদের সেটি বুঝার দক্ষতা থাকতে হবে। আর সোর্সের সঙ্গে কমফোর্ট ফিল করছেন কিনা, সেটিও বুঝতে হবে।’

    এ বিষয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্র্যাকের আসিফ সালেহর সাম্প্রতিক এক পোস্টের কথা উল্লেখ করে এএফপি ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি জানি, এটি আসিফ সালেহর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। ফলে ভেরিফাইড না হলেও এই অ্যাকাউন্ট থেকে আমি তথ্য নিতে পারি। কিন্তু সুবীর ভৌমিকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ে যারা নিশ্চিত নন, তারা তার পোস্ট থেকে নিউজ করবেন না, এটাই হওয়া উচিত।’

    সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close