• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

চরিত্র দূষন পরিবেশ দূষনের চেয়ে ভয়াবহ!

প্রকাশ:  ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:১১
জয়ন্ত রিপন
ফাইল ছবি

সেদিন রিক্সায় যাচ্ছিলাম! হঠাৎ পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল খুব বেশী দ্রুতগতিতে রিক্সাটিকে অতিক্রম করলো। ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। ইদানিং অধিকাংশ প্রাইভেট কারকেও এভাবে বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখি। গতি বেশী থাকার কারণে মোটরসাইকেল আরোহীকে দেখে বুঝতে পারিনি, তিনি কেমন বয়সী।মনটা এই ভেবে খুব খারাপ লাগছিল! জনকোলাহলপূর্ন এই ব্যস্ত শহরে মানুষ কি করে জানমালের কোন তোয়াক্কা না করে এমন অদূরদর্শীর মতন ড্রাইভিং করতে পারে। যেহেতু মোটরসাইকেলটি আমার রিক্সাটিকে পেছন থেকে অতিক্রম করেছিল সেহেতু এটা খুব সহজ হিসেব যে,আমি যেদিকে যাচ্ছিলাম মোটরসাইকেল আরোহীও সেদিকেই যাচ্ছিলো।

প্রায় এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর কিছুটা দুর থেকে লক্ষ করলাম সামনে বিরাট জটলা। আ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখলাম সাইলেন বাজিয়ে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপছিল। রিক্সা থেকে নেমে ভীড় ঠেলে দেখতে চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রচণ্ড ভীড়ে দেখা সম্ভব হচ্ছিলো না। পুলিশের পেট্রোল ভ্যান আসলো তৎক্ষনাৎ। আমি যেন কেমন হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষের আলোচনায় শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে একটি মোটরসাইকেল অপর একটি প্রাইভেট কারের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।মোটর সাইকেল আরোহী বয়সে তরুন সবার মতে ১৩/১৪ বছর বয়স হবে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাইভেট কারটিতেও শুধু ড্রাইভার ছিল কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার তেমন আঘাত লাগেনি। আ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর সময় ছেলেটিক দেখে বেশ বুঝতে পারলাম যে, এই ছেলেটিই কিছুক্ষন আগে আমার রিক্সাটিকে অতিক্রম করেছিল।

সম্পর্কিত খবর

    আমি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মোটর সাইকেলটিকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম।আ্যাম্বুলেন্স চলে যাবার পর ভীড় কমতে থাকলো। পুলিশের সদস্যরা দুমড়ানো-মোচড়ানো মোটরসাইকেলটিকে তুলে তাদের গাড়ীতে উঠাচ্ছিলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম নিশ্চিত হলাম যে,এটা সেই বাইক।

    রিক্সায় উঠতে যাবো এমন সময় উল্টো দিক থেকে যুগল কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম, একজন পুরুষ অপরজন মহিলা সমস্বরে বিলাপ করছে।বুঝতে বাকী রইলোনা, উনারাই সেই তরুনের পিতামাতা। অপর একটি পুলিশের গাড়ী ঘটনাস্থলেই দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে কয়েকজন নেমে এসে তাদের নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো!

    এধরণের ঘটনা ইদানিং হরহামেশাই ঘটছে। স্কুল/কলেজ পড়ুয়া অনেক তরুনদের আমরা দেখতে পাই বেপরোয়া হোন্ডা চালাতে। যে বয়সে আমরা পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম সে বয়সে তাদের হোন্ডা না চালালে চলেনা। আবার এই খবরও প্রকাশিত হয়েছিলো যে,বাবা হোন্ডা কিনে দেয়নি তাই সন্তান অভিমানে আত্মহত্যা করেছে! এ কোন অসম প্রতিযোগিতায় মেতেছি আমরা?

    মেয়েদের স্কুল কিংবা কোচিং এর সামনে এখন হরহামেশাই দেখা যায় ছেলেদের ভীড়।কেউ বা আঙুল দিয়ে নিজের চুল পরিপাটি করছে, কেউবা বিশেষ ভঙ্গীতে দণ্ডয়মান, কেউবা ফিল্মি কায়দায় আসন পেতে বসে আছে, অনেকে মিলে আড্ডাও দিচ্ছে।এরাতো কোন অভিভাবকের ধার ধারেণা! না নিজের, না অপরের অভিভাবককে গুরুত্ব দেয়। কিছুদিন পরপর শোনা যায় প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে নিদারুন প্রতিশোধের মর্মান্তিক ঘটনা কিংবা পজিটিভ হলে ভয়ংকর নিরুদ্দেশ যাত্রা।যার শেষ পরিনতি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ধ্বংস। এই হলো আমাদের ডিজিটাল সন্তানদের নৈতিক অবস্থান! মনে খুব কষ্ট পাই যখন দেখি, এসএসসি এবং এইচএসসি তে এ+ পাওয়া ছেলেগুলোও পাড়ার মোড়ে কিংবা গার্লস স্কুলের সামনে দাড়িয়ে থাকছে। এছাড়াও নানা রকম অসমাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে।

    জিপিএ ফাইভের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত পিতামাতা।প্রাইভেট, কোচিং ছাড়া অন্য কোন আলাপই নেই।স্কুলগুলোতে শিক্ষক সাহেবেরা ভুলেও কিছু পড়াবেন না। মনে হয় স্কুলে পড়ালে তাদের পাপ হবে।

    তিনারা নিজের বাসায় কিংবা রুম ভাড়া নিয়ে সারাদিন ব্যাচের ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান।নিজের অনৈতিক চিন্তার বাস্তবায়ন করে কিভাবে তারা ছাত্রদের পড়াবেন এই হিসাবই মিলেনা। বাংলাদেশের শিক্ষকরা নিজেদের যথাযথ মূল্যায়িত বলে মনে করেন না।

    এখানেও কিছু সমাধানের অবকাশ রয়েছে। তবে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকলে অনেক চিন্তাভাবনা করেই ঢোকা উচিত। যদি কাঁচা পয়সা উপার্জন করাই একজনের লক্ষ্য হয়, তবে তো কোনো রকমে এক রাতে এক কেজি হেরোইন জোগাড় করতে পারলেই তো হলো। সকালে তা বিশেষ স্থানে যথাযথ পাত্রের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই কয়েক কোটি টাকা। তবে সেটাই তো ছিল ভালো। অথবা কিডনি জোগাড়ের খামার বানালেই তো একটি একটি শিশুর কিডনি বেচে লাখ লাখ টাকা আয়। সেটাই তো সহজ পথ ছিল। তাহলে আর শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখানো কেন?

    এমন হওয়ার কথা ছিল কি? সমাজ আজ বিভ্রান্ত। মূল্যবোধের মড়ক ছড়িয়ে পড়েছে! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুণগত মানের বড়ই অভাব। ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড মূল্যবোধের অভাব। শিক্ষার প্রতি বেশির ভাগ শিক্ষকের অঙ্গীকার কম। অথচ উচ্চশিক্ষা প্রদানকারীদের মধ্যে যদি মূল্যবোধের অভাব থাকে, তবে একটি সময় আসবে, যখন অনিবার্যভাবেই ‘বুমেরাং’ হয়ে ফিরে আসবে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে গড়তে হবে স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন দিয়ে। শিক্ষকদের তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকা উচিত।

    একজন শিক্ষকের সৎগুণ ছাত্রছাত্রীর অন্তরে স্বর্গীয় জ্যোতির মতোই বিকিরণ করে চলে আজীবন। শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন- সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, করুণার আলোড়ন, সংবেদনশীলতা, ঔদার্য, দয়া, ক্ষমা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম প্রভৃতি একজন হৃদয়বান শিক্ষক কোমলমতি বিদ্যার্থীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত করে দেন তার সহজাত কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন, কার্যকলাপ ও উদাহরণের মাধ্যমে। মা-বাবার যেমন দায়িত্ব আছে তাদের সন্তানদের প্রতি, শিক্ষকেরও তেমনি দায়িত্ব আছে ছাত্রছাত্রীর প্রতি।

    অপরদিকে অভিভাবকেরাও মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে প্রতিনিয়ত। নিজেদের সন্তানদের শুধু ব্রয়লার মুরগীর মতন আকার বাড়াচ্ছে,সঠিক শিক্ষা এবং মেধার চর্চা সূদুর পরাহত! ছোটবেলায় এদের কাঁধে তুলে দিচ্ছে শুধু বইয়ের বোঝা! এই বোঝা বইতে বইতে তারা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত! আমরা,আমাদের শিক্ষা বস্থা,সমাজ,অভিভাবক, রাষ্ট্র সবাই মিলে তাদের শৈশব, কৈশোর কেড়ে নিচ্ছি না কি? আমরা তাদের স্বাভাবিক বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছি! এরা কখনোই শারীরিক মানসিকভাবে পরিপূর্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।নদীমাতৃক সোনার বাংলায় আজকালকার অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাটতে জানেনা। খেলাধুলা কিংবা সংস্কৃতিচর্চার সময় নেই। অধিকাংশ শিশু ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনগুলো প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম! অনেক সময় দেখা যায় অভিভাবকেরা সময় দিতে না পারায় সন্তান যে বিপথগামী হচ্ছে সে খেয়ালই তাদের নাই। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষনায় দেখা যায় যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার পর্যাপ্ত আদর-যত্ন পায় না, তারা প্রায়ই কুসঙ্গে পড়ে মাদকাসক্ত হয়। টিনএজাররা খুবই আবেগপ্রবণ এবং তাদের সমস্যাবলী বেশির ভাগই মা-বাবার অজানা থাকে। এর ফলে তাদের কল্পনাবিলাসী মন এবং মা-বাবার বাস্তব চিন্তার মাঝে সৃষ্টি হয় বিস্তর ব্যবধান এবং গড়ে ওঠে অদৃশ্য এক দেয়াল। এ কি করছি আমরা?একটি দেশের এবং জাতির শক্তিশালী সম্পদ হচ্ছে তরুন জনশক্তি অথচ তাদের আজ করুন অবস্থা। এই অবস্থা কি একদিনে তৈরী হয়েছে?

    আমাদের শিক্ষা মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষার উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাঝেও এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহ আছে কিনা তাও গবেষনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমাদের পিতামাতা ছিলেন সন্তানদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ছোটকাল থেকে তারা সন্তানদের যে ধরণের শিক্ষা দিতেন সন্তানরা সেই শিক্ষায়ই বড় হয়ে ওঠতো। সন্তানকে আদর্শ ও চরিত্রবান করতে গেলে মা-বাবাদের সেই ধরণের শিক্ষাই দিতে হয়। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই একজন ছেলে/মেয়েকে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ করতে পারেনা। এইজন্য পরিবারের বাবা-মায়ের ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু বর্তমানে কিছু বাবা-মায়ের হয়ত ধারণা জন্মেছে সন্তান ভালো করে লেখাপড়া করলে, ভালো রেজাল্ট করলেই সে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধারণা শুধুই অমূলক নয় ভয়ংকরও বটে। সন্তানকে ভালো পড়াশুনার পাশাপাশি, সে কোথায় যায়, কোন বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করে এসব বিষয়ে আগ্রহ সহকারে খোজখবর নিতে হবে। পিতামাতার মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। কোনটা সঠিক পথ আর কোনটা ভুল পথ সেইটা স্পষ্ট করে সন্তানদের বোঝাতে হবে। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি কি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে সেসব বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।

    তরুনরা আগামী দিনের ভবিষ্যত তারাই আগামী দিনের মন্ত্রী, এমপি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। দেশ গঠনে তারাই রাখবে অগ্রনী ভুমিকা। তাই তাদের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার জন্য বাবা মা, শিক্ষকদের প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। বাবা মায়েদের উচিত সন্তানকে ভালো লেখা পড়ার পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া।

    বড় ভুমিকা নিতে হবে দেশের সরকারকে। কারণ তারা দেশের অভিভাবক। নৈতিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে যে আইনগুলো তারা প্রনয়ন করবে জনগন তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। কাজেই এই বিষয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ দরকার।

    বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে মাদকদ্রব্য। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের তরুণ-তরুণীদের জীবন; ধ্বংস করে দিচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। সেই সাথে মাদক ব্যবসা বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় চোরাকারবারীরা এই ব্যবসার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ভৌগলিক অবস্থান এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান পথের কমপক্ষে ৩০টি রুট দিয়ে এ দেশে মাদক আমদানী ও রফতানী হয়ে থাকে নেশা জাতীয় দ্রব্য দেশের তরুনদের সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এগুলোর মাধ্যমে যুবসমাজ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেশাকর দ্রব্যের মাধ্যমে তরুন শক্তির শরীর ভাঙ্গছে, ঘরও ভাঙ্গছে। রাতভর নেশা করে নেশাসক্ত নিঃশেষ হয়ে ঘরে ফেরে। ওদিকে তার গর্ভধারিনী মা তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেে রাতভর।এর চাইতে কষ্ট আর কি হতে পারে!

    একটি শিরোনামে চোখ পড়তেই সারাটা দেহ হিমশীতল হয়ে গিয়েছিল সবার। মা বাবার একমাত্র মেয়ে তার নিজের মা-বাবাকেই কুপিয়ে হত্যা করেছিলো !মেয়েটির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিলো, সে তার মা-বাবাকে নিজের হাতে খুন করেছে ।আমাদের সমাজের এধরনের দুরবস্থায় উপনীত হওয়ায় কারণ কি এবং আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনার দরকার বলে মনে করে বিবেকবান প্রতিটি মানুষ।

    ভৌগ্যবাদী জীবনের নেশায় মানুষ যেভাবে দৌড়ে চলছে তাতে নিজের পরিবার, ছেলে সন্তান যে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তে সে খেয়ালই যেন কারো নেই। এখন বলা হয় ছোট পরিবির সুখী পরিবার।আধুনিক পরিবার মানেই তো ছোট পরিবার। আগের প্রসন্নতায় ভরা একান্নবর্তী পরিবারগুলো দ্রুত ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে। এর কুফলই চোখে পড়ছে বড় বেশি। বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার এ বিশ্বে এগিয়ে যেতে হবে তরুন-তরুনীদের। তবে সবকিছুতেই বানরের মত অনুকরণ প্রিয় হলে দেখা দেয় সমস্যা। অবশ্যই এতে শঙ্কার একটি বিষয় আছে বৈকি।

    এ লেখা যতই এগোচ্ছে, রাত যতই গভীর হচ্ছে, আমার দীর্ঘশ্বাস ততই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন মা-বাবা আজ বড়ই চিন্তিত ও বিষণ্ণ। তাঁদের বিষাদ আমাদের বুকে বাজছে অতি করুণ হয়ে। তাই আমরা আবারও বুক বেঁধে দাঁড়াতে চাই। কেননা বিপুল মাশুল দিয়েই আমরা এ দেশটি পেয়েছি। আমাদের সামনে আশাবাদ ছাড়া আর তো কোনো পথ খোলা নেই।

    সমাজে বেড়ে উঠা নানা অবক্ষয় আমাদেরকে ক্রমাগত ভয়ঙ্কর এক অন্ধকার গহবরের দিকে কিভাবে ধাবিত করছে। বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, সন্তান বাবা-মাকে, বাবা-সন্তানকে, স্বামী-স্ত্রীকে, স্ত্রী-স্বামীকে, ভাই-ভাইকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না। যা প্রতিদিনকার পত্র-পত্রিকায় দৃশ্যমান। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, ভাবতে হবে ভবিষ্যতের উত্তরসূরী আমাদের এই তরুণরা দিনদিন কোন্ পথে ধাবিত হচ্ছে। তাই অতিদ্রুত আমাদের এর প্রতিকার খুঁজে বের করতে হবে। এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষার অধোগতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে গোলক ধাঁধার ভোগবাদী পশ্চিমা পণ্য-সংস্কৃতির খপ্পরে পড়ে আমরা আমাদের আপন বিশ্বাস, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হারাতে বসেছি। আর বিশ্বায়নের যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বায়নের থাবায় গনমানুষের নৈতিক চেতনাকে ক্রমাগত আক্রমণ করছে। যার প্রবণতা শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পৌঁছেছে। পরিণতিতে ব্যাপকভাবে বাড়ছে আত্মসর্বস্বতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও জনবিচ্ছিন্নতা। যার সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের উপর। যদিও আজকের এই তথাকথিত বিশ্বায়ন মানুষের সম্পর্ককে শুধু অর্থনৈতিক করতে চাচ্ছে। মূল্যবোধের এই অবক্ষয় তাই আজ সমাজে যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে।তথাকথিত বিশ্বায়ন নারী-পুরুষের সামাজিক স্বীকৃতিকে অগ্রাহ্য করতে শিখাচ্ছে। এতে ভাঙছে পরিবার, মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে, আগামী প্রজন্ম আসছে শিকড়বিহীন। যা দেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এই তরুণ সমাজের বেড়ে উঠার পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। একদিকে এককেন্দ্রিক চিন্তা মানুষের চিরন্তন সম্পর্কগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে অন্যদিকে সমাজে অবক্ষয়ের সর্বগ্রাসী বিস্তার আমাদের তরুণ সমাজকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে।

    দেশের প্রাণশক্তি এবং উন্নয়নের প্রধান কারিগর তরুণ সমাজকে সকল প্রকার সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। দেশে প্রতিটি অঞ্চলে ভয়াবহ অবক্ষয় রোধে রাষ্ট্র ও সমাজ তথা প্রতিটি নাগরিকের তরফ থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদসহ সকল অপকর্ম থেকে তরুণ সমাজকে দূরে রাখতে হবে। বর্তমানে চাকরি পাওয়ার এহেন পুঁজিবাদী শিক্ষার পাশাপাশি তরুনসমাজকে অবশ্যই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা প্রদানে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বপ্রথম পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিশুদেরকে ভালো-মন্দের ব্যবধান বুঝাতে হবে। শুভ বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরির জন্য যে নৈতিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন তা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষাসূচিতে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দেশের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, সততা, মানবতা, ঐতিহ্য ও পারিবারিক বন্ধন সম্পর্কে জ্ঞানদানের মাধ্যমে প্রতিটি সন্তানকে তথা তরুণদের সজাগ করে গড়ে তুলতে হবে।

    নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে ঘাটতি নিয়ে আমাদের সন্তানরা সমাজে বড় হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণগুলো চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে এর দায় যেমন রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের রয়েছে, ঠিক তেমনি আমাদেরও রয়েছে।তাই সজাগ হতে সবাইকে।এই ভয়ংকর খাঁচা যা আমাদেরকে পরাকাষ্ঠা,অবক্ষয় ও অনৈতিকতার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখতে চায় সেই খাঁচা ভাঙতে হবে আমাদেরকেই।

    লেখক. তরুণ সংবাদিক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close