• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মটি তারুণ্যের অপমান

প্রকাশ:  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:২৫ | আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৫০
শিল্পী জলি

‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্ম দেখে নাকি লোকে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। ভাবলাম, আমিও না হয় একটু কাঁদি– কতদিন নাটক সিনেমা দেখে কান্নাকাটি হয় না! তবে নাটক/মুভিতে বিচ্ছেদের চেয়ে নিখাদ প্রেম দেখলেই আমার কান্না বেশি পায়। মনে হয়, আহা এই প্রেম যদি বাস্তব জীবনে থাকতো কতই না সুন্দর হতো পৃথিবী, কিন্তু তেমন প্রেম বাস্তবে কোথায়? মনে গভীর প্রেম নিয়েও জীবনে তেমন প্রেমিক/প্রেমিকার দেখা মেলে কই? না হয় নাটক সিনেমাতেই দেখলাম! কিন্তু সেটাও কি মেলে?

‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্ম নিয়ে এত সরবতা দেখে ভেবেছিলাম, বেশ ভালোই হয়তো একটা কিছু বানিয়েছে। ভাবছিলাম নায়িকার ফুৎ ফুৎ করে এতো কান্নার কথা যখন বলছে সবাই, তাহলে তাদের বিয়ে অন্তত হয়েছে। পরে টেলিফিল্মটি দেখে ভুল ভাঙলো। বুঝলাম, লোকে কেন এটা নিয়ে এতো কথা বলছেন– সেই চিরাচরিত ধারায় টেলিফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে রক্তের সম্পর্কের খাতিরে বাবা-মা এবং পরিবারকে দেখতে গিয়ে আবেগের সম্পর্কটিকে কেমন করে অস্বীকার করে বসে গল্পের নায়ক। কীভাবে জীবনে নো-কিস, নো রোমান্টিকতা পলিসিটি গ্রহণ করে বৈধ সেক্সের প্রয়োজনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিয়েকে বাতিল ঘোষণা করে! আর এই ত্যাগ দেখেই দর্শক কাঁত– আহা এমন ছেলে হয় না, কত দায়িত্ববান! যেখানে ভালোবাসার মূল ভিতই হলো মানসিক এবং আবেগিক সম্পর্ক, ঘোর লাগা, আকর্ষণ, কেয়ার, শ্রদ্ধা, বিপদে হাত ধরে রাখা, লড়াই, টিকে থাকার সংঘর্ষ, এবং দায়িত্ববোধের সেটাকেই অস্বীকার করে বসলে জীবনে আর ভালোবাসার থাকে কী? তখন নারীপুরুষের বন্ধনের ভীত কী?

সম্পর্কিত খবর

    টেলিফিল্মটিতে মূলত পরিবারের খাতিরে ভালোবাসাকে অস্বীকার করার বার্তা দেয়া হয়েছে, আর সেই কারণেই সবাই এই ফিল্মটি নিয়ে এতো উতলা। নইলে এটাতে কোন শক্তিশালী মেসেজ নেই সমাজের জন্যে। এমনকি টিকে থাকতে জীবনের তেমন কোন কঠিন সংঘর্ষও দেখানো হয়নি। নেই তারুণ্যের কোনো অহঙ্কার যখন দুটো হাত, দুটো পা’ই মানুষের মূলশক্তি হয়ে হাজারগুণ মনোবল বাড়িয়ে দেয়, যখন সাঁতার কেঁটেই সাগর পাড়ি দেবার বাজি ধরে মানুষ।

    বড় ছেলে গল্পের কোন গভীরতা নেই। যেই পরিবারে চাল নেই সেই পরিবারের কলেজ পড়ুয়া ছেলে আট’শ টাকা খরচ করে যাবে কলেজের কোন এক ইভেন্টে। বড়ছেলেটি আবার সেই টাকা মায়ের মাধ্যমে দিয়ে বলে, ‘বলবে বাবা দিয়েছেন।’

    কেন অকারণ এই মিথ্যের আশ্রয়? আর একজন কলেজ পড়ুয়া পরিবারের সদস্য কেন জানবে না তার পরিবারের টানাটানির কথা? সুযোগ পাবে না জীবনকে বোঝার? অথচ চাইলে পার্ট টাইম কাজ করে সেও কিছু আয় করার চেষ্টা করতে পারতো বিশেষ করে যে দেশে এখনও শিশু শ্রমই চালু রয়েছে।

    নাটকটিতে পরিবারের বড় ছেলে আর ডিভোর্সি মেয়েটি ছাড়া আর কারও কোন কর্মের ধান্দাই নেই। অথচ আমরা বহু আগেই দেখেছি, বাংলা মুভিতে মায়েরা সেলাই করে সন্তান পালন করছেন। পরিবারের শিক্ষিত সদস্য রিক্সা চালাচ্ছে, খবরের কাগজ বিক্রি করছে বাড়তি আয় ঘটাতে। অথচ এই টেলিফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে, কান্না ছাড়া কেউই কমফোর্ট জোন থেকে বেরুচ্ছে না। নায়ক মেন্দাভাবে সেই গতানুগতিক ধারায় টিউশনি ধরেই পড়ে আছে। অথচ আমাদের চারপাশেই প্রতিটি পরিবারে বাস্তবে এই সংঘর্ষ আকাশ ছোঁয়া। তবুও মানুষ ভালোবাসে, পথ চলে, প্রেম এবং বিয়ের মাঝামাঝি সময়টিতে এসে হাত ছেড়ে দেয় না।

    অবাক কাণ্ডটি হলো নায়ক/নায়িকার কেউই তার পরিবারকে বলেইনি তাদের সম্পর্কের কথাটি। অর্থাৎ পারিবারিক বন্ধনটিও ততটা পরিস্কার এবং গভীরতা পায়নি এই কাহিনীতে। মানুষের বয়স যখন হাতে থাকে তখন দুনিয়া থাকে তার হাতের মুঠোয়। এখানে নায়ক নায়িকার মাথার উপর ছাদ আছে, তিন বেলার খাবারের ব্যবস্হা থাকা সত্ত্বেও জীবন তাদের উদানো মুড়ি। প্রেমের টানে যেখানে দুগুণ উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে তাদের ছোটার কথা, লক্ষ স্বপ্ন সাজাবার কথা সেখানে আশি বছরের বৃদ্ধের মতো যুদ্ধে যাবার আগেই তারা মনোবল খুইয়ে বসে আছেন।

    অথচ আমাদের দেশেই দশ-বার বছরের অনেক বাচ্চাই সকালে পেপার বিক্রি করে দুপুরে স্কুলে পড়ে। টিভির অনুষ্ঠানেই দেখানো হয় সেসব বাস্তবতা। তবুও অনেকে পরিবারের কারণে প্রেমকে ত্যাগ করাকে জাতির আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাঁয়তারা করে– বিষয়টি সমাজে ভয়ঙ্কর মেসেজ সরবরাহ করে। সমাজ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মনোবল ধরে রাখার শিক্ষা পায় না।

    আজকাল নাটক বা মুভিতে আর তেমন করে দেখানো হয় না যে, যে কোন কাজই সম্মানজনক। তাই অনেকেই কাজে বিশ্বাসী না হয়ে এক লাফে লাট হতে চায়, উল্টা পথে কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখে। তথাপি আলগা হালচাল দেখিয়ে পরোক্ষভাবে বোঝানো হয়, অগাধ ধনসম্পত্তি ছাড়া মানুষের জীবন কোনো জীবনই নয়। ফলে সবার মধ্যেই সৃষ্টি হয় আরও চাই, আরও চাই এর অস্হিরতা। জীবনের কোনো সন্তুষ্টি নেই, অথচ কাজের ধান্দা কম। বাছাইকৃত সম্মানজনক কাজগুলোই করতে চায় সবাই।

    সব কাজই যে কাজ, সম্মানজনক সেই বোধটি ছড়িয়ে দেবার পাঁয়তারা আজ আর নেই জাতির মাঝে। সেইসাথে সবখানেই নারীদেরকে আক্ষরিক অর্থে অকেজো করে দেখানো হয়। এমন কী যে নারীরা অভিনয় করে অবিরত ঘরে পয়সা আনছেন, পরিবারকে সাপোর্ট করছেন তারাও কাজে অভিনয় করছেন ‘অবলা কেঁদো সুন্দরীর’। নাটকেও সমাজের ছেলেদেরকে জীবনের বাস্তবতাকে স্বীকার না করে মেন্দা করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে অনেকেই আজীবনই আর ঘাড় সোজা করে হাঁটার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। জীবনের শুরুতে এমনই ব্রেন ওয়াশ করে দেয়া হয় যে অনেকেই আজীবন ঘোরে থাকে। নিজের পায়ে ভর করে নিজে আর কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না, সংঘর্ষে নামে না। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আর নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে বহন করতে চায় না। কিন্তু এভাবে কতদিন? এর ফলাফল কী? আর কোথায় গেলে এর পরিসমাপ্তি? আদৌও আছে কী?

    নটরডেম কলেজ পড়ুয়া এক ছেলে আমেরিকার ইঞ্জিনিয়ার। তার সাথে যোগাযোগের খাতিরে জানলাম, আশি হাজার ডলার ক্রেডিটকার্ড থেকে লোন তুলে এবং নিজের থেকে আরও টাকা দিয়ে ঢাকাতে বাবা-মাকে পাঁচতলা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় দুই বোনকে এনে নিজ খরচে এমবিএ করিয়েছেন। অতঃপর আমেরিকাতেই বোনদের বিয়ে দেন খাটপালং হাবিজাবি যৌতুক দিয়ে। গর্বিত হয়ে বলছিলেন, ‘বাবা-মাকে এবার হজ্জ করতে পাঠাচ্ছি–লোনের টাকা তাই নিজে যাবো না, হজ্জ হবে না তাতে!’ শুনে বললাম, লোনের টাকায় বাবা-মাকেই বা হজ্জে পাঠাচ্ছেন কেন? আর আমেরিকায় কেউ যৌতুক দিয়ে এমবিএ পড়া বোনকে বিয়ে দেয় নাকি? বাবা-মায়ের এক তলাতেই যেখানে হয়ে যাবার কথা, সেখানে পাঁচ তলা বানিয়ে দিয়েছেন তিনি একুশ পারসেন্ট হারে সুদের ঋণ নিয়ে। তাও ডলারের উপর। জানালো, ইতিমধ্যেই বউ চলে গিয়েছে।

    বউয়ের অভিযোগ ছিল, ক্রেডিট কার্ড থেকে বিশ/বাইশ পার্সেন্টে সুদে ডলার তুলে কেন দেবে, এগুলো শোধ দেবে কী করে? একবার, ঐ ছেলের চাকরি চলে গিয়েছিল। তখন ক্রেডিট কার্ডের উপর নির্ভর করেই কোনমতে চলেছে তার। তখনও বাবা-মাকে নিয়মিত ডলার পাঠিয়েছে, কিন্তু তাদেরকে জানায়নি চাকরি নেই। অথচ বাবা-মা তখন দেশে বাসার ভাড়া থেকেই অনেক টাকা পাচ্ছিলেন। বাবা-মা চানওনি টাকা–তাহলে? সমস্যা কোথায়?

    সম্ভবত গোড়াতেই। হয়তো গড়ে তোলার সময়টিতেই অসীম ক্ষমতাধর হিসেবে ব্রেন ওয়াশ করে দেয়া হয়েছিল তাকে যেমন আমাদের দেশীয় ছেলেদেরকে অহরহ করা হয়। আর তারা কখনও বলতে শেখে না মানুষের আয়েরও একটি লিমিটেশন থাকে– ইগো প্রবলেম। ফলে তাদের আর অল্পে সন্তুষ্টি আসে না জীবনে। তখন সমাজে যার যার কর্মের ধান্দা সে সে করতে শেখে না।

    দেখা যায় আমাদের দেশীয় অনেক মেধাবি ছেলেই বিদেশে এসে অডজব করতে চায় না– সামর্থ এবং মেধা থাকা সওেও তারা নিজের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের উপর চেপে থাকেন। তাদের পরিবার ভেঙে যায়, তবু তারা যে কোনো কাজ করে নিজের সম্মান খোয়াবেন না। ভোগেন তাদের পরিবার। এক মেয়ে জানালো, আমেরিকাতে বাচ্চা নিয়ে সে দিনের পর দিন ননদের বাসায় থেকেছে তথাপি বর কোনো অড জব করেনি। এমন একটি জীবনে কত রকম বিড়ম্বনায় তাকে পড়তে হয়েছে সেই কথা নাইবা বলি। মেয়েদের এমন ইগো প্রবলেম কম।

    এক ডাক্তার মেয়ের আমেরিকায় কাজের অনুমতি নেই। বললেন, ‘রাত চারটায় ঘুম থেকে উঠে বসে থাকি– সময় চলে যাচ্ছে, ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। যে কোনো একটি কাজ যদি করতে পারতাম, এমনকি হাবিজাবি কাজও, তাহলে জীবনে সান্ত্বনা থাকতো।’

    আমি তাঁর যে আকুতি দেখেছি, জানি সে থামবে না। এই আকুতিই তাকে পথ করে দেবে ভবিষ্যতে পথ চলার যেমন করে জীবনের তাগিদে আট/দশ বছরের ছোট্ট রোহিঙ্গা শিশুটি তার পাঁচ বছরের ভাইকে নিয়ে পাহাড়-পর্বত- নদী ডিঙিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে এসে পাড়ি জমিয়েছে।

    মানুষের ইচ্ছেই তার চালিকা শক্তি আর ওখানেই সঠিক তথ্য সরবরাহ করে মানুষের ভিতটি মজবুত করা দরকার। মানুষের ক্ষমতা যে কত অসীম তা সে নিজেই জানে না। তাই সমাজের দায়িত্ব পাশে থেকে সেটি বুঝিয়ে দেয়া। এমন প্যান প্যানানি নাটক/টেলিফিল্ম জাতি গড়তে যথেষ্ট নয়– দরকার, ক্লিয়ার মেসেজ!

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close