• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মোদির নোটবন্দী সমস্যার সমাধান ৫০ দিনে নয় ৩৬৫ দিনেও হয়নি, তাই কালোদিবস

প্রকাশ:  ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৯ | আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৪৮
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

নরেন্দ্র মোদীর নোটবন্দীর এক বছর হয়ে গেল ৮ নভেম্বর। এই দিনটি কংগ্রেসের নেতৃত্বে সারাদেশে কালো দিবস হিসাবে পালন করা হয়। নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ৫০ দিনের মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধাণ হয়ে যাবে। দেখা গেছে ৩৬৫ দিনেও ভারতের মানুষ নোটবন্দী নিয়ে যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিলেন তা থেকে মুক্তি পায়নি। কবে তার সুরাহা হবে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ আর মোহন ভাগবত এই তিনমূর্তি জানেন না।

এদিকে মানুষ এমন দুর্ভোগের চরম সিমায় পৌঁছে গেছে। গত বছর ৮ নভেম্বর মধ্য রাতে তিনি বলেছিলেন, এই নোটবন্দী করা হলো কালো টাকা সাদা করার জন্য, কালো নোট উদ্ধার করার জন্য এবং সাম্যবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য এর কোনোটাই সফল হয়নি, রিজার্ভ তখনই বলেছে। কালো টাকা আরো বেড়ে গিয়েছে।

সম্পর্কিত খবর

    পরিস্থিতি বাধ্য করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, এটা ছিল একটা সংগঠিত লুঠ। মনমোহনের অভিযোগের কোনো জবাব নরেন্দ্র মোদী বা অরুণ জেটলি দিতে পারেননি। ১৩০ কোটি লোক এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মোদীর এই লুটের ফলে সারাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য হতে চলেছে। হেমন্তকালে বাজার এখন আকাশ ছোঁয়া, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে।

    কংগ্রেস থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, নোটবন্দীর তিন সপ্তাহ আরও পুরনো দিয়ে অমিত শাহের নামে হাজার হাজার হেক্টর জমি কেনা হয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাজারে যে টাকা ছিল তার মধ্যে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা ফেরত আসেনি। এক বছরে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন। এই ভয়ঙ্কর আর্থিক পরিস্থিতি থেকে ভারতকে উদ্ধার কোনো বিকল্প পথের সন্ধান মোদী ৩৬৫ দিনেও দিতে পারেননি। এই আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য অ-বিজেপি সব রাজনৈতিক দল উক্ত পযায়ে তদন্ত দাবি করেছে। এক কথায় এ যেন আঁকা কল্পনার শব্দমাত্র। মোদী বলেছিলেন, বছরে সাড়ে তিন কোটি লোককে চাকরি দেবেন। সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, সাড়ে তিন বছরে চার লক্ষ লোকও চাকরি পাননি। সরকারি অফিস নিয়োগ বন্ধ। মোদী বলেছিলেন, দুর্নীতিবাজদের কোনো স্থান নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর দুর্নীতিবাজ মুকুল রায় সেই অঞ্চলের রাজা। হিমাচল প্রদেশের সুখরাম ও তার ছেলেকে বিজেপি দলে নিয়েছে। উদ্দেশ্য ২০১৯-এর নির্বাচন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত এক ভয়ঙ্কর আর্থিক পরিস্থিতির সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মোদিরাই।

    এক রাহুলে রক্ষা নেই মনমোহন দোসর-কংগ্রেসের এই জোড়া ফলায় বেকায়দায় পড়েছেন মোদি-শাহ জুটি। গুজরাটে গিয়ে আজ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শোচনীয় অবস্থা ভারতীয় অর্থনীতির। এই সরকার যে অর্থনীতির কী হাল করেছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। বহু সময় লাগবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরোতে। কার্যত তিনি বিজেপি পরিচালিত সরকারকে আম্বানি-আদানির সরকারকে তকমা লেপে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, নোট বাতিলে চীনের সুবিধার কথা উল্লেখ করে মনমোহন সিং প্রশ্ন তুলেছেন, এত লুকুছাপা কেনো? তিনি পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন- ‘ডাল মে কুছ কালা তো জরুর হ্যায়’। মনমোহনের আক্রমণের মূল লক্ষ্য যে প্রধানমন্ত্রী সততার ইমেজ তা গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মনমোহনের এ ধরণের নজিরবিহীন আক্রমণ থেকে পরিষ্কার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে কংগ্রেস। সাধারণ মানুষের কাছে বিজেপি যে গণশত্রুতে পরিণত হচ্ছে তা এই কেম্ব্রিজ শিক্ষিত সুপণ্ডিতের ভাষণের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে।

    গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনের দামামা বেজে উঠতেই গত মাস দুয়েক ধরে ধীরে ধীরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছিলেন কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধী। সাস্প্রতিককালে তো একেবারে চুড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে গেছে। তিনি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাহতে শুরু করেন। নোট বাতিল ও জিএসটি নিয়ে রাহুলের আক্রমণের ধাক্কায় বিজেপির বেসামাল দশা মাঝে মাঝেই নেতামন্ত্রীদের বক্তব্যে ফুটে উঠছিল। দু-একবার আমতা আমতা করে জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং একটা প্রশ্নেরও সুদুত্তর দিতে পরেননি। বরং প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে কংগ্রেসের দুর্নীতিকেই টার্গেট করেছেন। রাহুল গান্ধীকে অনুসরণ করে আজ সেই একই লাইনে নোটবন্দী জিএসটি এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতি সামলাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।

    আজ আহমেদাবাদে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের স্মরণে এক অনুষ্ঠানে মোদী সরকারকে তিনি যৎপরোনাস্তি তুলোধানা করে বলেন, বর্তমান সরকারের হাতে মহাসংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। নোটবন্দীর ঘোষণা আসলে সংগঠিত লুট। ৮ই নভেম্বর ২০১৬ দেশের ইতিহাসে কালো দিন হিসাবে চিহ্নিত হবে। অন্যদিকে জিএসটি ব্যবস্থা তো সাধারণ মানুষকেই কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে। দেশজুড়ে এখন কর সন্ত্রাস চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার যা করেছেন তা থেকে বের হতে প্রচুর সময় লাগবে। যেভাবে বিজেপি গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচন প্রচারে বিদ্ধ হচ্ছে তা সামাল দেয়া যে বেশ কঠিন তা দলের একজন সাধারণ কর্মীও বুঝতে পারছেন। কার্যত নোট বাতিল পরবর্তীকালে মানুষের মনের মধ্যে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল তার সঙ্গে আগুনে ঘি পড়েছে জিএসটি নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়িতে। এই দুইয়ের স্পর্শে যতদিন যাচ্ছে দুই রাজ্যেই বিজেপি কোনঠাসা হয়ে পড়েছে।

    অবস্থা এমনই এসে দাড়িয়েছে যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সব কাজ ফেলে পরপর তিনদিন হিমাচলে পড়ে থাকতে হয়েছে। আগে বিজেপি সভাপতি বুক বাজিয়েই বলেছিলেন, দুই রাজ্যেই জেতা শুধু সময়ে অপেক্ষা। কিন্তু এখন কংগ্রেসের ব্রক্ষ্মাস্ত্র রোধ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে শীর্ষনেতৃত্ব বেশ সন্দিহান। উল্লেখ্য, কংগ্রেসে আগেই ঘোষণা করেছিলো সমস্ত বিরোধীদের নিয়ে আগামীকাল অর্থাৎ নোট বাতিলের বর্ষপুর্তির দিনটি তার দেশজুড়ে কালো দিবস হিসাবে পালন করবে। সমস্ত জায়গায় রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে বিক্ষোভ দেখানো হবে। বামেরাও জানিয়েছেন, দেশজুড়ে আরও একদিন বিক্ষোভ দেখাবেন। তূণমূল কংগ্রেসের মতো বিরোধীদলও পথে নামার কথা ঘোষণা করেছে।

    মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গতকাল বলেছেন, নোটবাতিলের বর্ষপূর্তিতে ওই দিন টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্ল্যাক রাখা হবে। আগামীকাল এ রাজ্যে বাম, কংগ্রেস ও তৃণমুল কংগ্রেসে আলাদাভাবে প্রতিবাদ মিছিল বের হবে। লিখিত বক্তৃতায় শানিত বাক্যবানে মনমোহন সিং এদিন বলেছিলেন, মোদী সরকারের জিএসটি আসলে কর সন্ত্রাস। উল্লেখ্য, এর আগে রাহুল গান্ধী এই করকে গব্বার সিং ট্যাক্স বলে কটাক্ষ করেছিলেন।মনমোহন বলেন, জিএসটির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। কার্যত অসংগঠিতভাবে সরকার লুটতরাজ শুরু কে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই কর নিয়ে সন্ত্রস্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মনমোহন বলেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত আইনসিদ্ধ বড়সড় ভুল। এর ফলে দেশের অর্থনীতি শোচনীয় অবস্থায় চলে গিয়েছে। তিনি এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার কোনো আশু সম্ভাবনা দেখতে পাননি। তার মতে, নোট বাতিলের ফলে লাভ হয়েছে চীনের। দেশের উৎপাদনশিল্প মার খাওয়ায় চীন থেকে আমদানি বেড়েছে গত এক বছরে প্রায় ২৩ শতাংশ। যে কারণে গত ২৫ বছরের মধ্যে এ বছরই বৃদ্ধির হার সবচেয় কম। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোদি স্বীকার করুন অর্থনীতির কী হাল। জিডিপি বৃদ্ধির হার যে হারে কমছে তা দেশের অর্থনীতিতে বড় আঘাত বলেও তিনি মনে করেন। কেন্দ্রীয় সরকার আসলে দেশবাসীকে নিয়ে ছেলেখেলা করছেন।

    তিনি বলেন, নোট বাতিল কার্যত ক্ষুদ্র শিল্পের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। মনমোহন প্রশ্ন তোলেন, লগ্নী টানতে না পারলে দেশের উন্নতি হবে কী করে? এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেই তাকে দেশদ্রোহী তকমা দেগে দেয়া হচ্ছে। বিজেপি যেভাবে গণতন্ত্রকে আঙুল দেখিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে সবকিছু কুক্ষীগত করে নিচ্ছে তারও কড়া সমালোচনা করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কোনো সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সরকার কেন এতো লুকোছাপা করছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বস্তুত দীর্ঘদিন পরে দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কার্যত বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সততা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।

    তিনি স্পষ্টতই অভিযোগ করেছেন, বিজেপি আসলে সবকিছু ধামাচাপ দেয়ার চেষ্টা করছে। কেন নোট বাতিল সে কথা প্রকাশ্যে আসা দরকার। গুজরাটের উন্নয়ন নিয়েও আজ মনমোহন বিজেপি শাসিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে বিধেছেন। তিনি বলেন, ৮৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বুলেট ট্রেন তৈরির কোনো সুফল রাজ্যের ব্যবসায়ীরা পাবে না। বরং সব পাকা নিয়ে যাবে জাপানের কোম্পানি। তার চেয়ে বরং ইউপিএ সরকারের আমলের প্রস্তাবিত ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর প্রকল্পের ওপর জোর দিলে ভালো হতো। শুধু তাই নয়, সার দেশজুড়ে হাই স্পিড ট্রেন চালানোর কথাও ভাবা যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল লাইনের অবস্থা শোচনীয়। প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে মেরামতের কাজ বন্ধ করে বুলেট ট্রেনের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয়ের কোনো মানে হয় না। তিনি বলেন, গুজরাটের সর্দার সরোবর বাঁধের কৃতিত্বও বিজেপি সরকার নিতে চাইছে। ওরা ভুলে যাচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক যখন এই প্রকল্প থেকে সরে আসার কথা বলল তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। তিনি আরো বলেন, শিশু মৃত্যুর হারসহ সমস্ত সামাজিক উন্নয়ন সূচকের নিরিখে গুজরাট আজ পিছিয়ে পড়েছে। রাজ্য সরকার এ নিয়ে কিছুই করতে পারেনি।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close