• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

শালুক

প্রকাশ:  ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৫৭
লাজ্বাতুল কাওনাইন

বকুল মিয়া সারাদিন মাঠে ঘাঠে খেলে বেড়ায়। ওকে নিয়ে মার হয়েছে যতো জ্বালা। সে বলে দিয়েছে, পড়ালেখা করবে না, মাথায় কিছুই ঢুকে না। তারামন বিবির খুব শখ ছেলে লেখাপড়া শিখে শহরে যাবে, বড় চাকরী করবে। সবাই অবাক হবে গ্রামের, আহা তারামন আর রফিকের পোলাটা একটা জিনিস ই হয়েছে। কিন্তু সবার সব ইচ্ছা কি আর পূর্ণ হ! এই ছেলে পড়বে না তো নাই ই!

তবে এক শর্ত তার, স্কুলে যাবে কিন্তু এরপর যতো খুশি তাকে খেলতে দেওয়া হয়। খাওয়া, গোসল, ঘুম কিছুর জন্য ডাকা যাবে না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে ফিরে সে খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। এই অদ্ভুত শর্ত তারামন মেনে নিলেও, তার বাবা রফিক বেপারি মানতে পারে না। প্রায়ই উত্তম মধ্যম দিতে থাকে বকুল মিয়াকে। এই ছেলে বিন্দাস। উত্তম মধ্যমে তার কিছুই যায় আসে না। সে তার নিয়মেই চলছে তো চলছেই। তবে আজব ব্যাপার হলো, সে ক্লাসে সব ছাত্রদের ভিতর সবসময় ই চতুর্থ হয়ে আসছে। ছাত্র ও কম না। প্রায় ১৫৯ জন। না পড়ে কিভাবে সে এই অবস্থান ধরে রেখেছে কে জানে! সে সেইদিন ভাত খেতে খেতে তারামনকে বলে পাকনা বড় মানুষের মতো...

সম্পর্কিত খবর

    ---মা! আব্বাজানরে কইবেন। আর বেশি পিডাপিডি করলে কইলাম রুল বাড়ায় ফ্যালামু।

    তারামন বিবি কি বলবে। তার জীবনটাই আজব। কোনো কিছুতেই স্বস্তি পায় না। এই সংসারে মেয়ে, ছেলে আর স্বামী কিছু দিয়েই সে শান্তি পেলো না। রাতজাগা নীরবে কান্নাটাই এখন সম্বল।

    আজব ব্যাপার বকুল মিয়ার কিন্তু কোনো বন্ধু নেই। কোথায় কোথায়, হাটে, মাঠে, ঘাঠে জংগলে একা একাই সারাটা দিন ঘুরে। প্রায়ই তারামন ওকে জিজ্ঞেস করে,

    ---- বাপজান একা ঘুরোস যে খারাপ লাগে না? বাড়িত আয়া পড়লে কি অয়?

    ---- হিহিহি!

    কখনোই বকুল মিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দেয় নি। একদিন বলে বসলো তার মাকে,,

    ----আমি একা ঘুরি নাতো মা। বু থাকে আমার লগে।

    সেইদিন তারামন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো ছেলের দিকে আর কিছুই বলে নি।

    --- মা! বু প্রতিদিন একটা কইর‍্যা শালুক আমারে দিয়া কয়,,মারে দিবি বকুল।

    ---- তো কই সেই শালুক?

    ---- মা তুমি বিশ্বাস করতাসো না,আমি জানি। বু প্রতিদিন দেয় আমারে। আমি আনি না। তুমি মন খারাপ করবা যে তাই।

    তারামন আর কিছুই বলে না। তারও বিশ্বাস করতে মন চায় যে, চম্পা প্রতিদিন তার জন্য শালুক দিয়ে যায়। এটা তার মেয়েটার বড় প্রিয় কাজ। প্রতিদিন মায়ের জন্য শালুক আনা। এনে বলবে, ---- ও মা তুমার জন্য। একটু আদর করো না! একটু ছুমু দাও! এক শালুক দিয়ে সেই কত যে আল্লাদ তার। জোর করে আদর নিবে যতো ব্যস্তই থাকুক তারামন।

    একবার খুব খুব জ্বর হলো বকুল মিয়ার। আকাশপাতাল এক করা জ্বর। ঘোরে গেলো বেচারা। সারাদিন মরার মতো পড়ে থাকে। এক সন্ধ্যারাতে ঘরে কেউ নাই। বিদ্যুৎ ও চলে গেছে। তারামন বিবি হারিকেন ধরিয়ে, বকুল মিয়ার পাশে আধ শোয়া হয়ে দোয়া দরুদ পড়ছে। ছেলেটার জ্বরের তাপ তার গায়ে লাগছে! হঠাৎ বকুল মিয়া বলে উঠলো, --- মা ঘরের পিছে শিউলী গাছটার নীচে বু প্রতিদিন দাঁড়ায় থাকে শালুক হাতে। আমি তো যাইতে পারি না, তাই বু খুব মুন খারাপ করে।

    তারামন বিবি অনেক আদর করে বকুলকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেলো। কি ভেবে আর কিসের আশায়, সেই কৃষ্ণপক্ষের রাতে তারামন বিবি আস্তে আস্তে শিউলী গাছের নীচে চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সত্যি শুকনো কতগুলো শালুক মাটিতে পড়ে আছে আর একটা একদম তাজা। কুড়িয়ে নিলেন খুব যত্ম করে। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে, কিন্তু তারামন কাঁদছেন না। পাগলের মতো এদিক ওদিক হন্য হয়ে খুঁজে চলেছেন তিন বছর আগে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া তার মেয়েটিকে....!

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close