• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তবতা ও বর্তমান বাংলাদেশ

প্রকাশ:  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৭ | আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৯
মো: সাখাওয়াত হোসেন

স্বাধীনতা প্রত্যয়টি প্রবল ভাবাবেগের সাথে অন্তরালেরও বিষয়। কারণ মানুষ মাত্রই স্বাধীন থাকতে চায়। পরাধীনতার মুখোশ পরে কেউ বেঁচে থাকতে চায় না। পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে সকলেই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়। কারণ স্বাধীনতাই পরম পার্থিব সাধারণের নিকট। আর স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মানুষটি কিংবা রাষ্ট্রটি যদি হয় স্বাধীনচেতা তাহলে তো কথাই নেই। যে কোন মূল্যে তথা ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার আরাধ্য স্বাদ পেতে পছন্দ করবে এবং বিশ্বে তার নজির ও রয়েছে ভুরিভুরি ।আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালির জাতির জীবনে সব থেকে মর্যাদাকর ও গর্বের ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃত। বাঙালি জাতি সংগ্রামের জাতি, বাঙালি জাতি সাহসী বীরদের প্রতিনিধিত্ব করে, বাঙালি জাতি দেশপ্রেমের বহ্নি শিখায় সর্বদা জাজ্বল্যমান। তাই বাঙালি জাতির নিকট স্বাধীনতা আরাধ্য ছিল এবং চরম ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পার্থিব স্বাধীনতাকে অর্জন করে।

স্বাধীনতা মানে কি? স্বাধীনতার ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক অর্থ রয়েছে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বলতে বোঝানো হয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরায় স্বাধীনতা, কর্ম সম্পাদনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার ও অন্যান্য। কিন্তু তাত্ত্বিক অর্থে স্বাধীনতা বলতে বোঝানো হয়: রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের অনুশাসনের মধ্যে থেকে যে কোন কিছুর করার ক্ষমতাকে কিংবা কিছু করার ইচ্ছা পোষণা করাকে স্বাধীনতা বলে। আমি বাঙালি, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে যে কোন কিছু করার অধিকার আমার রয়েছে, এটাই আমার স্বাধীনতা। তবে আইনের ভঙ্গনের মাধ্যমে কোন কিছু করার নাম স্বাধীনতা নয়। আইনের অবমাননা করলে আপনাকে রাষ্ট্র কর্তৃক যে কোন গৃহীত ব্যবস্থা মেনে নিতে হবে। কাজেই স্বাধীনতা হচ্ছে ব্যক্তি হিসেবে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং রাষ্ট্রের সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা।

সম্পর্কিত খবর

    এখন প্রশ্ন আসতে পারে জাতি হিসেবে আমরা যখন পাকিস্তানে ছিলাম তখন কি স্বাধীনতা পায়নি। উত্তরে বলবো, ক্ষুণাক্ষরে পায়নি। কারণ, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা আমাদের শোষণ করেছিল, নিষ্পেষিত করেছিল। বাঙালিরা তাদের অধিকার কখনো পায়নি। সবক্ষেত্রেই পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের কোন না কোন অযুহাতে নির্যাতন করার সুযোগ তৈরি করেছিল। সরকারি চাকুরিতে বাঙালিদের বৈষ্যম্য ছিল চোখে পড়ার মতই। এমন ও হয়েছে কোন প্রতিষ্ঠানে সর্বসাকুল্যে কর্মকর্তা কর্মচারী ৫০০ জন সেখানে মাত্র ২ জন বাঙালি। এ রকমি বৈষম্য ছিল সর্বক্ষেত্রে। আমাদের সোনালী আঁশের কদর ছিল বিশ্বব্যাপী, অথচ বৈদেশিক খাত থেকে অর্জিত আয়ের প্রায় সবটাই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। ছিঁটেফাটাও পেতো না তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। তথাপি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলাও নিয়মবিরুদ্ধ প্রথাতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদের ভাষা বন্ধ করতে নানামুখী তৎপরতায় মুখোর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তানে রাজত্ব করতো তাদের বশীভূত কর্তাব্যক্তিরা যারা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানিদের দিক নির্দেশনা মেনে হুকুম তাবিয়াত করতো।

    আমাদের স্বাধীনতা কেন দরকার ছিল? স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য, মুক্তভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও আমাদের স্বাধীনতা দরকার ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশি তথা বাঙালিদের কোণঠাসা করে রেখেছিল। একতরফা শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলো। সামরিক সরকারের রোষানলে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার। বাঙালিদের শিক্ষা, স্বাস্থা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নে কোন ভূমিকাই নেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা। তথাপি আমাদের দেশের সম্পদ বিভিন্নভাবে লুণ্ঠন ও বাজেয়াপ্ত করেছিলো। অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব বাংলা শাসন করতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাঙালি এজেন্টরা। পশ্চিম পাকিস্তানকে সামরিকভাবে সুসজ্জিত করার জন্য নানা রকমের যুদ্ধযান ও যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করা হয়েছিল। সেখানে পূর্বপাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য কোন রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পূর্ব বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো পশ্চিম পাকিস্তানের দোসররা। কোন বাঙালি পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের এজেন্ট পেতো না। এককথায় বাঙালিকে নাস্তানুবাদ করে রেখেছিল যেন কোনভাবেই নিজেদের মেধা প্রতিভাবে বিকশিত করতে না পারে, প্রতিবাদের ভাষা যেন সোচ্চার না হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতো ভয়াবহ আকারে। এ রকম আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো শাসনাবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য হলেও বাঙালিদের স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

    স্বাধীনতার সুফল কি আমরা পাচ্ছি? অবশ্যই আমরা স্বাধীনতার সুফল পাচ্ছি। এই যে আমি আমার ইচ্ছেমতো দু’কলম লেখার সুযোগ পাচ্ছি এটা কিন্তু স্বাধীনতার সুফল। যখন আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে ছিলাম পত্রিকাগুলো কিন্তু সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেনি। যদিও দু একটা পত্রিকা প্রতিবাদ করতো তথাপি তাদের উপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসতো, বন্ধ করে দেওয়া হতো পত্রিকা অফিসগুলো। গ্রেফতার করা হতো পত্রিকার সম্পাদককে। সরকারি চাকুরিতে আমাদের বাঙালিরাই যোগদান করছে কিন্তু একটা সময় সরকারি চাকুরি বাঙালিদের জন্য কল্পনার অতীত ছিল। জিডিপি সহ অনেক সম্মানসূচক সূচকে আমরা ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে অতিক্রম করেছি এবং কিছু কিছু জায়গা বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন সহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। আর পাকিস্তান সেখানে ক্রমশই অধ:স্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের বাঙালিরা বর্হিবিশ্বে নানাবিধ ক্ষেত্রে সুনামের সহিত কাজ করছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশে, ক্রিকেটে বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে পরাশক্তি, বাংলাদেশের সিনেমা আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনতে সাহায্য করেছে। বাঙালি বংশোদ্ভূতরা ব্রিটেন আমেরিকার মতো দেশে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছে বর্হিবিশ্বে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের উত্থান অনেকটা আগুনের ফুলকির মতো, ইতিমধ্যে তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশী গবেষকরা বিশ্বের প্রথিতযশা গবেষণাগারে নিজেদেরকে যুক্ত করছে, ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্যান্য খেলাধূলায় বাংলাদেশের দামাল ছেলে-মেয়েরা তাদের মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেই চলেছে। জাতিসংঘের মতো বড় ফোরামে বিশেষ বিশেষ সভায় সভাপতিত্ব করছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। এসব কি কখনো সম্ভব হতো স্বাধীনতা ব্যতিরেকে? মানবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে। কাজেই স্বাধীনতার সুফল আমরা পাচ্ছি এবং ইহাই প্রমান করে স্বাধীনতা আমাদের দরকার ছিল। স্বাধীনতার মাসে সে সব মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি যারা দেশমাতার টানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছে।

    স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বকে অর্থবহ করার জন্য আমাদের কি করতে হবে? কারণ স্বাধীনতা রক্ষা করা খুবই কঠিন একটি কাজ। স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে তথা স্বাধীনতার সুফলকে ধরে রাখতে হলে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে। কেননা, ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ইতিহাস দিক নির্দেশনা দেয়, ইতিহাস অনুপ্রেরণা জোগায়, ইতিহাস ভবিষ্যৎ বির্নিমাণে সহায়তা করে থাকে। তাই, সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদেরকেও বাংলাদেশের জন্মের সঠিক ইতিহাস তাদের নিজ নিজ সন্তানদের জানানোর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই সকলের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, দেশের জন্য কাজ করার সাহস আসবে প্রত্যেকের মাঝে। বিজয়ের মাসে সকলের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও এর আলোচনা নিয়ে আগ্রহ দেখা যায় বিষয়টা খুবই ইতিবাচক। কিন্তু আরো ভালো হতো যদি সারাবছর ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, স্বাধীনতা সংগ্রামের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করা যেতো। কারণ নিশ্চিত পরাজয় জেনেও একমাত্র দেশপ্রেমের শৈল্পিক সৌন্দর্য ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণেই বীর বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা দেশটাকে মুক্ত করতে পেরেছিলো, তাদের সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

    লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক ডিভোর্স সমস্যা নয়

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close