• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস

সম্ভাবনাকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে

প্রকাশ:  ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:১৪
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত মানুষের উন্নয়নে জাতিসংঘ ২০০২ সালে ১১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য 'পার্বত্য অঞ্চলের ঝুঁকি: জলবায়ু, ক্ষুধা, অভিবাসন'। পর্বতের টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে পর্বতারোহীদের সংগঠনগুলো। সোমবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক সংলাপ। এখানে অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও বাংলাদেশে নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন ধন বাহাদুর ওলী।

বাংলাদেশ সমতল ভূমির দেশ হলেও এখানে বেশকিছু পাহাড়-পর্বত রয়েছে। বাংলাদেশের এই পাহাড়গুলো টারশিয়ারি যুগে গঠিত হয়। পর্বতের শ্রেণী বিভাজনে এগুলো ভাঁজ শ্রেণীর পর্বত। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার লালমাই এলাকায় বাংলাদেশের পাহাড়গুলো অবস্থিত। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এই তিনটি জেলাকে একত্রে 'পার্বত্য জেলা' বলা হয়।

সম্পর্কিত খবর

    'ময়মনসিংহের গারো' পাহাড় হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম পাহাড়। 'গারো পাহাড়'টি বাংলাদেশ এবং ভারতের মেঘালয় ও আসামজুড়ে প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই 'গারো পাহাড়'ই গারো সম্প্রদায়ের মূল বাসভূমি।

    বাংলাদেশের পাহাড়গুলোর উচ্চতা খুব বেশি নয়। পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার বা ২০০০ ফুট। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হলো 'তাজিনডং' যেটি বিজয় নামেও পরিচিত। বান্দরবান জেলায় অবস্থিত তাজিনডংয়ের উচ্চতা ৩১৮৫ ফুট। 'তাজিনডং' একটি মারমা শব্দ, যার অর্থ গভীর অরণ্যে পাহাড়। তাজিনডংয়ের আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ছিল 'কেওকারাডং' যা বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। 'কেওকারাডং'-এর উচ্চতা ২৯২৮ ফুট।

    বান্দরবানে অবস্থিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য পাহাড় হলো চিম্বুক পাহাড়। এই চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে মারমা আদিবাসী গোষ্ঠী বাস করে। এছাড়াও রয়েছে চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথের পাহাড়, যা হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসেবে বিখ্যাত। বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত হলো মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। এটি মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। বড়লেখা উপজেলার পাথুরিয়া পাহাড় থেকে এই জলপ্রপাতটির উৎপত্তি। মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতটিতে ২৫০ ফুট ওপর থেকে পানি নিচে পড়ে। পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান।

    পাহাড়ী জনপদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের জমি দখলের অভিযোগ উঠছে। বড় পরিসরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হলে অধিকাংশ ঘটনাই সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে না। পাহাড়ের নির্যাতিত মানুষেরা ক্রমশ উনমানুষে পরিণত হচ্ছে। শতাধিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিমানবিকরণ ঘটেছে। প্রতিনিয়ত বর্বরতার মুখোমুখি হওয়া এইসব মানুষগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের উপরে ঘটে যাওয়া অবিচারের ন্যায় বিচার পায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষের অপরাধপ্রবনতা বৃদ্ধি করে। ধারাবাহিক অবিচারের শিকার মানুষ ধীরে ধীরে নির্যাতিত পরিচয় হারিয়ে ফেলে। বর্বরতা সহ্য করতে করতে,এক সময় এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

    সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অর্থনৈতিকভাবে দেশের অন্য এলাকাগুলো থেকে পিছিয়ে আছে। এসব পার্বত্য এলাকায় লাখ লাখ মানুষের বাস। কিন্তু এদের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। জীবিকার প্রশ্নে এখনো পার্বত্য এলাকার মানুষ গতানুগতিক পেশায় আবদ্ধ রয়ে গেছে। বিশেষ করে কৃষি বা জুমচাষ, বন-বাগান সৃষ্টির কাজে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়।

    সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পায়নের ফলে এ এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ কর্মক্ষেত্র গড়ে না ওঠায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এ এলাকার মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে পারছে না। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার স্থানীয় কিছু সংগঠনের কারণে এ এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারাও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছেন না। জমির মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের অনেকে জমি কিনতে চাইলেও তা পারছেন না।

    বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন। তাদের মতে, শিল্পায়নের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় এখানকার মানুষের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগও সীমিত। পার্বত্য এলাকা নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের দেয়া তথ্যে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার অপরূপ পাহাড়গুলো ঘিরে যে শুধু পর্যটনশিল্পেরই বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন নয়, এসব পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকায় কৃষি ও শিল্প-কারখানা বিকাশেরও ক্ষেত্রে রয়েছে। তাদের মতে, পাহাড়ে কৃষি ক্ষেত্রে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। সেচের আওতায় আনতে পারলে প্রতি বছর আরও ৯ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমিতে আবাদ করার সম্ভাবনা আছে।

    আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেছেন, আদিবাসীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ নানাভাবে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ জন্য তিনি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসীদের ভূমি ও সংস্কৃতির অধিকার ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

    পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরণে পর্বত দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই দিবসটি পালনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি মানুষের বৈচিত্রপুর্ণ জীবনধারা, আশা-আকাঙ্খা, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। পাহাড়-পর্বত থেকে আমরা সুপেয় পানি ও আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে থাকি। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মানুষের অস্তিত্ব বর্তমানে বিপন্ন ও হুমকির সম্মুখীন। পাহাড়-পর্বতগুলো সুরার মাধ্যমেই আমাদেরকে এ হুমকি মোকাবেলা করতে হবে। পাহাড় আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। পাহাড় আমাদের জীবনের জন্যে। সেজন্যেই সম্মিলিতভাবে পাহাড়কে রক্ষা করতে হবে।

    ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার লক্ষ্যে পাহাড় পর্বতগুলো সংরণ করা আবশ্যক। পাশাপাশি পাহাড়বাসী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষকে কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া যায় সে বিষয়গুলোও ভেবে দেখতে হবে। আদিবাসী, পাহাড়ি, বাঙালি ভেদাভেদ না করে পাহাড়বাসী প্রান্তিক ও অনগ্রসর মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।

    বলা আবশ্যক যে, ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফের সহযোগিতায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ দিবসটি উদযাপন করে। আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসুচী বাস্তবায়ন করে চলেছে।

    লেখক: শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, সিনিয়র সাংবাদিক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close