• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ছাত্রলীগ আমার কাছে গর্বের, রক্তের

প্রকাশ:  ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ০৩:০৯ | আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ০৩:১৪
ডা: মামুন আল মাহতাব (স্বপ্লীল)

ছাত্রলীগের সাথে আমার যোগাযোগ সেই ১৯৮৮ সাল থেকে। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আড্ডা আর বন্ধুত্ব ছিল ছাত্রলীগের ছেলেদের সাথেই। যদিও তখনও মিটিং-মিছিলে ঝাপিয়ে পড়া ছাত্রলীগার ছিলাম না। পিঠে ছাত্রলীগের তকমা লাগলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ঢোকার পরে।

শহীদ রাইসুল হাসান নোমানের রক্তস্নাত এমএমসি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাথে সেই যে সন্ধি, আজো তা অটুট। এমএমসি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাইসুল হাসান নোমান খুন হয়েছিলেন প্রফেশনাল পরীক্ষার ভাইভা দিতে গিয়ে পরীক্ষার হলে ইন্টার্নাল-এক্সটার্নালদের সামনে।

সম্পর্কিত খবর

    ১৯৮৮’র ৫ অক্টোবর সকালের সেই স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়ায় আমার মত সেদিন এমএমসি ক্যাম্পাসে উপস্থিত অনেকেই। নোমান বিচার পাননি, কিন্তু রক্তের বন্ধনে বেঁধে গেছেন আমার মত অনেক ছাত্রলীগ কর্মীকেই। সেদিনের এমএমসি’র ছাত্রলীগাররা গ্রুপিং করতে পারে, করতে পারে লবিংও। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ছাত্রলীগের মূলনীতি আর শহীদ নোমানের রক্তের সাথে বেইমানী করতে পারে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।

    সময়ের বিবর্তনে আমি এখন লিভার বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তাই বলে ছাত্রলীগের সাথে মনস্তাত্বিক যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়নি কখনোই। তাই ছুতোয়-নাতায় সুযোগ পেলেই ছাত্রলীগ আর ছাত্রলীগারদের গল্প করার ফিকির খুঁজি। ছাত্রলীগ আমার কাছে গর্বের, রক্তের।

    ইদানিং প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে ন্যাসভ্যাক নামে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের একটি নতুন ওষুধের একাধিক সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করায় রিসার্চার হিসাবে আমার একটু নাম-ডাক হয়েছে। সাথে আছে লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসায় স্টেমসেল নিয়ে সাম্প্রতিক ঘাটাঘাটি। মাঝে-সাঝেই ডাক পড়ছে প্রিন্ট, অনলাইন আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। বিশেষ করে এদেশে ন্যাসভ্যাকের রেজিস্ট্রেশনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে।

    যারা একসময় ভাবতেন এদেশের চিকিৎসকদের জন্মই হয়েছে প্রেসক্রিপশনে কলম ঘষার জন্য, তারাও আমাদের নিয়ে একটু অন্যরকম করে ভাবছেন। ন্যাসভ্যাক নিয়ে যখনই মিডিয়ায় যাই, প্রতিবারই অনুরোধ করেছি দয়া করে লিখবেন আমি একজন সাবেক ছাত্রলীগকর্মী। মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী-ইকবালুর রহিম-মাহবুবুল হক শাকিল কমিটির সেন্ট্রাল মেম্বারও ছিলাম। কেউ আমার এই অনুরোধটা রাখেননি।

    অথচ আমি যদি কোনো রোগীর এটেনডেন্টের সাথে দুর্ব্যবহার করতাম কিংবা কটুক্তি করতাম কোনো রোগীকে, আমি নিশ্চিত মিডিয়াতে যে খবরটি আসত তাতে লেখা হত আমার ছাত্রলীগের পরিচয়টিও।

    ছাত্রলীগের সাবেক বা বর্তমান কর্মীদের সব খারাপের দায় সংগঠনের আর ভাল কোনো কিছুতে ছাত্রলীগ পরিচয়টা চট-জলদি লুকিয়ে ফেলার এই প্রবণতাটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ন্যাসভ্যাক কিংবা স্টেমসেল গবেষণায় কেউ যদি আমার ন্যূনতম অবদানও খুঁজে পান তাহলে তাকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে এসব শুধুই একজন চিকিৎসকের বিজ্ঞানমনস্কতার ফসল নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এর জন্য নিজের গণ্ডির বাইরে চিন্তা করার যোগ্যতা লাগে, নিজের রোগীর কল্যাণে প্রয়োজনে নিজের পোশাকে বাজিতে তোলার সাহস লাগে আর পাছে লোকে কিছু বললে তা হজম করে এগিয়ে যাবার শক্তি লাগে।

    আর এতসবকিছু কখনোই একদিনে হয় না। আরও অনেক কিছুর মতই এর জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা আর একটি সামগ্রিকতা যা আপনাকে আপনার ভিতরের আপনাকে চিনতে শেখাবে। এরজন্য প্রয়োজন হবে ছাত্রলীগের মত সংগঠনে সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা যা আপনাকে আলোকিত করবে একাত্তরের চেতনায়, উদ্বেলিত করবে শহীদ নোমানের আত্মত্যাগে আর বলিষ্ঠ করবে শাকিল ভাই বা উত্তম দা’র মত বড় ভাইদের সংগঠনের প্রতি শর্তহীন একাগ্রতায়।

    ভাবছেন বিজ্ঞানের নাম ভাঙ্গিয়ে ছাত্রলীগের ঢোল বাজানোর চেষ্টা করছি। হয়তোবা তাই! প্রয়াত শাকিল ভাই বলতেন, ‘নিজের ঢোল নিজে না বাজালে অন্যে তা বাজাবে কেন?’ আমি সম্প্রতি প্রিনিসপ্যাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে আর একটি ওষুধের ফেজ-১ ট্রায়াল শেষ করেছি। একদল সুস্থ ভলান্টিয়ারের দেহে ওষুধটি ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে। এই ট্রায়ালে মোট ৩৬ জন তরুণ স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, বুঝে-শুনে, সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করে অংশ নেন।

    ট্রায়াল চলাকালীন সময়ে তারা হাসপাতালে প্রায় তিন দিন ভর্তি ছিলেন। এসময় তাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকবার পরীক্ষার জন্য রক্ত নেয়া হয়েছে। তারা হাসপাতালে থেকেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, ফেসবুক ব্রাউজ করেছেন, অনেকে আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগও দিয়েছেন। তবে তারা কেউ হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজকর্মে ন্যূনতম ব্যাঘাত ঘটাননি। হাসপাতালের রোগীদের চিকিৎসায় কোনো ব্যতয় ঘটেনি। কর্মরত ডাক্তার বা নার্সরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও করেননি।

    গুড ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের বেড়াজালে আটকে থেকে তারা গুডবয়ের মত ট্রায়াল শেষ করে তারা যার যার ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন। এরা ঢাকার একাধিক নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের অনার্স পড়ুয়া ছাত্র। আর এতটা ভনিতা করার উদ্দেশ্য এরা প্রত্যেকে ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। অনেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতাও বটে।

    ট্রায়াল চলাকালীন সময়ে তাদের কাছ থেকে যত দেখেছি, ততই অবাক হয়েছি। অবাক হয়েছি তাদের নিষ্ঠায় আর নিয়মানুবর্তিতায়। আমাদের দেশের ওষুধ শিল্পগুলো তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো মূলতঃ করিয়ে আনে ভারত আর মালয়েশিয়া থেকে। শুধুমাত্র ভারতই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করে যা আমাদের ওষুধ শিল্পের বার্ষিক টার্নওভারের বহুগুণ বেশি আর ভারতের এই ১০ বিলিয়নে আমাদের ওষুধ শিল্পের অবদানও যথেষ্টই।

    অথচ আমাদের দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে আয় প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুধুমাত্র ব্যাঙ্গালুরু শহরেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য রেজিস্টার্ড হেলদি ভলান্টিয়ারের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। আমার ট্রায়ালের ওই ৩৬ জন হেলদি ভলান্টিয়ারের দেখানো পথে যদি ছাত্রলীগের আরো নেতা-কর্মী এগিয়ে আসে আমি নিশ্চিত, দেশীয় ওষুধ শিল্পের সহায়তায়, জননেত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে আমরা আর একটু হলেও এগিয়ে যাব।

    প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল লিখেছিলেন, ‘আপনি সুশীল, আমি ছাত্রলীগ’। একথা আগেও লিখেছি, আবারো লিখতে দ্বিধা নেই আমরা বর্তমান আর সাবেক ছাত্রলীগাররা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থেকে আমাদের কাজ করে যাব। কখনো আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভলান্টিয়ার হব, কখনো ছুটে যাব বানভাসি মানুষের পাশে আর কখনো বা রক্ত দেব অকাতরে একাত্তরে, নব্বই-এ। আমাদের পূর্বসূরীরা আমাদের তা-ই শিখিয়ে গেছেন। এটাই আমাদের কাজ। সুশীলরা বরাবরের মতই শুধুই আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলোই তুলে ধরবেন। এটাই তাদের কাজ। আমাদের কাজ আমরা করেই যাব আর টাকডুম-টাকডুম বাজিয়ে যাব ছাত্রলীগের ঢোল। কারণ আমাদের ঢোল যদি আমরা না বাজাই, তাহলে বাজাবেটা কে?

    লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

    সূত্র: পরিবর্তন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close