• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ ও একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

প্রকাশ:  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:০১ | আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:০৫
মনজুর রশীদ

আমরা প্রায়ই একটা কথা বলি বা শুনি তা হল‘যতদোষ নন্দ ঘোষ’। অপরাধ না করেও যখন কাউকে জোর করে অপরাধী করা হয়, তখনই এই বহুল পরিচিত প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।একটা সময় ধারণা ছিল এই প্রবচনগুচ্ছের বিস্তৃতি এই ভারতীয় উপমহাদেশে যতটা প্রবল অন্যদেশে হয়ত ততটা নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই আমার ব্যক্তিগত এই ধারণাটি সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে শুরু করেছে বৈশ্বিক নানা ঘটনা প্রবাহ দেখে। বিশেষ করে চলতি মাসের শুরুতে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টাইমস এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে।হাইতিতে ২০১০ সালে ভূমিকম্প-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতা চালানোর সময় যুক্তরাজ্যের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার হাইতিতে নিয়োজিত তৎকালীন একজন পরিচালকের যৌন কেলেংকারী সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর সেই কলংকের তিলক যেন সকল উন্নয়নকর্মীদের মুখে কালিমা লেপন করেছে।

আট বছর আগের পুরানো ও বিচ্ছিন্ন একটি খবরকে ফ্রন্টলাইনে আনার পর থেকে ব্রিটেনসহ সারাবিশ্ব এমনকি আমাদের বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমসমূহও বেশ গুরুত্ব সহকারে সংবাদটি পরিবেশন করছে।একই সময়ে অনুসন্ধান করে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন সংস্থায়ও একই জাতীয় অভিযোগের সত্যতা খুজে পায় এবং এই অভিযোগে অভিযুক্তদের চাকুরীচ্যুতদের সংখ্যাও প্রকাশ করে। যেখানে অভিযুক্ত সংস্থা ক’টির হাজার হাজার উন্নয়নকর্মী দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি ও কয়েকটি ঘটনাকে উপজীব্য করে এসকল সংস্থার হাজার হাজার কর্মীকে মানসিকভাবে হেনস্তা করা যেন সেই নন্দ ঘোষের প্রবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

সম্পর্কিত খবর

    ফলে সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে এমন একটি ঘটনার পিছনে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব না থাকলে এমনতো হওয়ার কথা নয়। পত্রিকান্তরে জানা যায়, এই ঘটনার রেশ হিসাবে ব্রিটিশ সরকার ঐ সংস্থাটিকে প্রতিশ্রুত তহবিল প্রদানে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করেছে।সেই সূত্র ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠী তাদের নিয়মিত সহযোগিতা অব্যাহত রাখা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে।

    যেখানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের মাধ্যমে সরকারের সহযোগী হিসাবে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কেবল ত্রাণ ও পুণর্বাসনের কর্মকান্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না রেখে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য,পয়ঃনিস্কাশন, নারীর ক্ষমতায়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা পালন করছে; সমাজ ও জাতীয় জীবনে নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরিতে অবদান রাখছে; সাধারণ মানুষ তথা সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষমতা কাঠামোর অংশীদার অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; সকল ক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য এডভোকেসির মাধ্যমে জোরালো ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে; উন্নয়ন চাহিদা অনুযায়ী গ্রামীণ জনসাধারণ বিশেষ করে নারীদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে যুক্ত করছে; নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়তে বিভিন্ন উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে আশাতীত সাফল্য অর্জনে সরকারকে সহায়তা করছে; শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাসে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে; ডায়রিয়া ও অপুষ্টিজনিত শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করা, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা, যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও জনসক্ষমতা সৃষ্টি করা, ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যক্রম গ্রহণ ও জোরদার করা, খাস জমিতে প্রকৃত ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, বস্তিবাসীদের উন্নয়ন ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, আদিবাসী ও সমাজের অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে কাজ করা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা; নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন বন্ধ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশুর প্রতি সকল প্রকারযৌন হয়রানি বন্ধ করা, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলাসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে জোরালো ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে তখন কেবল গুটিকয়েক ব্যক্তির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে ঢালাও ভাবে সকলকে দোষারোপ করা এবং তাদের জীবন জীবিকায়নকে বাঁধাগ্রস্ত করা আরো বড় অনৈতিক প্রচেষ্টা বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত।

    উন্নয়নকর্মীদের উদ্বেগের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা বড় কারণ হচ্ছে, বৈদেশিক সাহায্য ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হলে তাতে চলমান দারিদ্র্য দূরীকরণসহ উল্লেখিত বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা অর্জনকারী উন্নয়নকর্মীদের দক্ষতা ও সেবা থেকে বঞ্চিত হবেবৈশ্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম।শিল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যরাও যদি কিছু মানুষের ভুলের কারণে একই নীতি অনুসরণ করা শুরু করে, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিসরে তৎপর বহুজাতিক এনজিওগুলো তহবিল সংকটের মুখে পড়তে পারে। এতে উন্নয়ন গতিশীলতায় বড় বাঁধার সাথে সাথে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে হাজার হাজার শিক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ সমাজ ও উন্নয়নকর্মী।

    আর এসবের নেতিবাচক প্রভাব আরো বেশী আঘাত আনবে আমাদের মত রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত ও অস্থিতিশীল দেশে। কারণ হিসাবে রম্য সাহিত্যিক ও টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেতের ভাষায় বলা যায় – “আমরা যখন যেখানে-যাকে-যেভাবে-যা বলে পারি দোষারোপ করি। আর সব দোষ গিয়ে পড়ে ওই অভাগা নন্দ বাবুর ওপর। আমরা জানি, কেউ ভোলে কেউ ভোলে না। তবুও যেটা ভোলা ভালো নয় সেটা ভুলেই আমরা ভুল করি। আবার কেউ কেউ আছেন, ভুলেও ভুল কাজটি নির্ভুলভাবে করতে ভোলেন না। তাই কথায় কথায় অনেকেই নন্দলালকে টেনে আনেন”।

    লেখকঃ গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close