• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘আমি ওসমানী এটা কাউকে বলবেন না, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আছে...’

প্রকাশ:  ১৭ মার্চ ২০১৮, ২২:৫৯ | আপডেট : ১৭ মার্চ ২০১৮, ২৩:১৬
সৈয়দ রেজাউর রহমান

তখনকার সমাজে সংগঠিত অগ্রসর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত ছাত্রসমাজের মধ্যে আগে স্বাধীনতার মন্ত্র প্রচারণার কাজটা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর একই কাজে হাত দেন শ্রমিকদের মাঝে। ধীরে ধীরে ছাত্রলীগকে দিয়ে স্বাধীনতার দাবি প্রকাশ্যে আনা হয়। ছাত্রলীগের মাঝে স্বাধীনতার ধারণা প্রচার করতে ১৯৬৪ সালে নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রসমাজকে কাজে লাগিয়েছেন। বিভিন্ন নেতাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন। কোনো কাজ ফজলুল হক মনিকে দিয়ে, কোনোটা সিরাজুল আলম খানকে দিয়ে, কোনো কাজ আবদুর রাজ্জাক বা তোফায়েল আহমেদসহ অন্যদের দিয়ে করিয়েছেন। তবে সব কিছুর সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ এসেছে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। জয় বাংলা স্লোগান বলেন, জাতীয় সংগীত ঠিক করা বলেন, পতাকা উত্তোলন বা স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা বলেন, সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ এসেছে ৩২ নম্বর থেকে, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। সেসব বিষয় আবার ছাত্রলীগের কমিটিতে পাস হয়ে কার্যকর হয়েছে। কোনো কাজ আ স ম আবদুর রব করেছেন, কোনোটা শাজাহান সিরাজ বা অন্যরা করেছেন। বাস্তবতা হলো, সে সময়ে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে অন্তত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগে অন্য কারো ভিন্ন

সম্পর্কিত খবর

    রাজনৈতিক অস্থিত্ব ছিল না। পরবর্তী রাজনৈতিক ভিন্ন অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে কেউ পতাকার উত্তোলক, কেউবা ইশতেহার পাঠকের একক কৃতিত্ব দাবি করে বাস্তবে ইতিহাসের এসব শ্রষ্টা নিজেরাই ইতিহাস বিকৃতি ও বিভ্রান্তির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা সেদিন স্বাধীনতার জন্য এ কাজগুলো করেছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা অনেক বড়, অনেক সম্মানের। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, সিদ্ধান্ত-পরামর্শ ছাড়া একা কিছু করার ক্ষমতা কারোরই ছিল না। একাত্তরে আমি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। তৎকালীন ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই কথাটা বলছি। তবে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, সে সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমটির বৈঠকে দেখেছি, সিরাজুল আলম খানের কিছু অনুসারী অনেক সময় অতি বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতেন, প্রস্তাব দিতেন।

    ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। মমতাজ বেগমসহ আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ি। কসবা পৌঁছি এক দিন পর। কসবার নামকরা লোক আবদুল গনি ভুঁইয়া মমতাজ বেগমের বাবা। তাঁদের বাড়িটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা। ওপারে ত্রিপুরার দেবীপুর থানা। কসবা এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যারা পুলিশ, ইপিআর বা সেনাবাহিনী থেকে চলে এসেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করি। মমতাজ বেগম আওয়ামী লীগের এমএনএ—তাঁর কথা শুনে অনেকেই আসতে শুরু করেন। এ সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মেজর বাহার নামের এক বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনিসহ আরো সেনা কর্মকর্তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানলাম। মেজর বাহার বললেন, সেনা, ইপিআর, পুলিশ কেউ এলে ভারতে পাঠিয়ে দিতে।

    এপ্রিলের ৭ কিংবা ৮ তারিখ হবে। আমরা কসবায় মমতাজ বেগমের বাড়িতে বসে আছি। আজিজুর রহমান নামের স্থানীয় এক ছাত্রনেতা আমার কাছে একজন লোককে নিয়ে এলেন। তিনি ভারতে যেতে চান। লোকটির মাথা ন্যাড়া, পরনে অতি সাধারণ পাঞ্জাবি-পায়জামা। ভালো বাংলা বলতে পারেন বলে মনে হলো না। কথার মাঝে ইংরেজি এসে যায়। পরিচয় দিলেন তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। হালকা-পাতলা গড়ন। গোঁফ চিকন করে ছাটা। বগলে একটি চামড়ার সুটকেস। সন্দেহ হলো। ভাবলাম নন-বেঙ্গলি কোনো এজেন্ট কি না? তাঁকে মমতাজ বেগমদের একটি ঘরে আটকে রাখলাম। কজন ইপিআর সদস্যকে দেখালাম। তাঁরাও চেনেন না। একপর্যায়ে জোরে জোরে বলতে থাকলাম, ব্যাটাকে টর্চার করলে সব বলে দেবে। তেমন প্রস্তুতিও নিলাম। কেন যেন কণ্ঠটা আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। তিনি সব কিছু দেখছেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সেমিনারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়বৈষম্য নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অস্বীকার করলেন। ওই বক্তৃতা করেছিলেন ওসমানী সাহেব।

    একপর্যায়ে আমাকে কাছে ডেকে ঘরের বাইরে পুকুরপারে নিয়ে গেলেন একা। চামড়ার সুটকেসটা খুলে ছোট একখানা কোরআন শরিফ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি ওসমানী। তবে প্রতিজ্ঞা করুন, আমি যে ওসমানী এটা কাউকে বলতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আছে দ্রুত ভারতে গিয়ে খবর পৌঁছাতে হবে, পার করার ব্যবস্থা করুন। আমরা মেজর বাহারকে খবর দিলাম। তিনি এসে সামরিক কায়দায় স্যালুট জানিয়ে জিপে করে ওসমানীকে নিয়ে গেলেন। জেনারেল ওসমানী চেহারাটা এমন বানিয়েছিলেন, আমরা চিনতে পারিনি। যাওয়ার সময় তিনি বলে গেলেন, এরই মধ্যে আমার আসার খবর ওরা হয়তো পেয়ে গেছে, আপনারা এখানে থাকবেন না। ভারতে চলে আসুন। এ ঘটনার তিন দিন পর আমরা ভারতে চলে যাই।

    আমি চলে যাই সোনামোড়া সীমান্তে। ক্যাম্প করি। কুমিল্লার বেশির ভাগ এসে ওঠে এখানে। পাশের বিশাল গড়ে ক্যাম্পে দেখা হয় ফজলুল হক মনির সঙ্গে। তিনি থাকতেন আগরতলার শ্রীধর ভিলায়। মনি ভাই আমাকে সোনামোড়া ও বিশালগড় ক্যাম্পের দায়িত্ব দেন। মে মাসের দিকে আমাদের বেইজ ক্যাম্প হয় আগরতলার নিমতলীতে। মুজিব বাহিনীর কাজ ছিল গেরিলা যুদ্ধ। মুজিব বাহিনীর সবারই প্রশিক্ষণ দেরাদুনে হয়েছে তা নয়। সীমান্তের ক্যাম্পে ক্যাম্পেও প্রশিক্ষণ হয়েছে। অস্ত্র ইস্যু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ হয়েছে। নেতারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে বক্তৃতা করেছেন। মনে আছে, ফজলুল হক মনি একদিন ক্যাম্পে বক্তৃতার সময় বলছিলেন, আমাদের যুদ্ধ যদি বিপ্লব হয়, তাহলে প্রতিবিপ্লবও হতে পারে, আবার ভেতর থেকেও প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত হতে পারে। সে জন্য রাজনৈতিক প্রশিক্ষিত যোদ্ধার প্রয়োজনে শিক্ষিত ছাত্র-তরুণদের নিয়ে মুজিব বাহিনী করা হয়েছে।

    মুজিব বাহিনী জেনারেল ওসমানীর কমান্ডে ছিল না। মুজিব বাহিনী চলত চার নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের কমান্ডে। অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের উৎসও ছিল ভিন্ন।

    ১৯৬৪ সালে গঠিত বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) যার যুদ্ধকালীন নাম মুজিব বাহিনী—একে আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়ার বঙ্গবন্ধুর একটি বার্তা ডিপি ধরের মাধ্যমে আগেই ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছেছিল। সে কারণে ইন্দিরা গান্ধী মুজিব বাহিনীকে আলাদা প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হন।

    লেখক : ১৯৭১ সালের ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। মুজিব বাহিনী কুমিল্লা জেলা প্রধান। বর্তমানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার প্রধান প্রসিকিউটর।

    অনুলিখন : লায়েকুজ্জামান সূত্র: কালের কণ্ঠ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close