• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মুক্তির পণ

প্রকাশ:  ১৮ মার্চ ২০১৮, ১১:৫০
লাজ্বাতুল কাওনাইন

অরিন্দম ছাত্র হিসেবে অসাধারণ। আজীবন সরকারি বৃত্তি নিয়েই পড়ালেখা করে গেলো। বাবা মায়ের তো এটা বিরাট গর্বের একটা বিষয় ই তাই না! অনেক আদর করে করে এই ছেলেটাকে তারা মানুষ করেছেন।

আর অরিন্দমকে তারা আদর করে "অম" বলে ডাকেন। অম না একটু মেয়েলীও বটে। এটা সবাই বলে। ভোরে উঠে মায়ের পাশে কখনো রুটি বেলে আর কখনো বা রুটি সেঁকে। মা মানে তার জান কলিজার একটা অংশ। মাকে সে হাত ছাড়া করে না একটু সময়ের জন্য। মাঝেমাঝে ঘরে কেউ না থাকলে ঘর দোর পরিষ্কার করে ঝাড়ু দিতেও দেখা যেতো।

সম্পর্কিত খবর

    বিজ্ঞানের ছাত্র অরিন্দম ভাল স্কুল, কলেজ আর সরকারী মেডিকেল কলেজ পেরুলো খুব সাবলীলভাবেই। পিছনে বাবা মায়ের বিপুল অবদান। ওর আবদার গুলোও কিন্তু কম ছিলো না। ভীষণ ঘ্যানঘেনে স্বভাবের অরিন্দম প্রচন্ড যন্ত্রণা করতো অবশ্য কেবল মাত্র মাকেই বেশি! এই মা এটা কেন, না না ওইটা। একে তো সন্তানেরা মায়ের কাছে একদম বড় হয় না। তারপর এমন লক্ষ্মী বাচ্চাগুলোর কিছু অযুক্তিক আবদার মানতে তেমন বেগ পেতে হয় না বুঝি মায়েদের।

    অরিন্দমের বাজে একটা অভ্যাস ছিলো, খাবার শেষে হাতটা ধুয়ে মায়ের আঁচল খোঁজা অথবা সকালে হাতমুখ ধুয়ে আঁচলে দিয়ে মুছতে হবে। এই এক ব্যাপারে মায়ের আপত্তি।

    - আহা কতবার বলেছি তোকে আঁচল খুঁজবি না। মায়া কমে যায়। কিরে তোর তোয়ালে কোথায়!

    কে শুনছে কার কথা!

    অরিন্দমের খুব ভালো লাগে মায়ের গায়ের গন্ধ। এতো বড় ছেলে মাকে জড়িয়ে বলে,

    -মা আমি তোমার গায়ের গন্ধ চিনি জানো তো!

    -হাহা! বাহ রে, আমার বাচ্চা তুই, তো চিনবি না?

    -না মা! কোটি কোটি মানুষের মাঝে আমাকে চোখ বন্ধ করে দিয়ে দেখো, শুধু তোমার গায়ের গন্ধ নিয়েই আমি বলে দিবো এটা আমার মা!

    -আচ্ছা আচ্ছা! এবার যা তো, ছাড়।

    মা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই পড়েন কিনা। কান্না এসে পড়ে তার। এটা লুকানো দরকার। ছেলেপুলে বড় হলে এতো জ্বালা। এদের সামনে কান্নাকাটি করা যায় না। বড় লজ্জা লাগে। আসলেও চেপে অন্য কোথাও গিয়ে জলটুকু শ্রাদ্ধ করতে হয়।

    আবেগ চেপে রাখলে কেমন প্রচণ্ড বুকে ব্যথা হয়। তবু রাখতে হয়। প্রকৃতির অমোঘ কিছু নিয়ম। কত যত্নে বাচ্চাগুলোকে বড় করা, কত কষ্ট, কত নিজেকে উৎসর্গ, কত আবেগ, কত নিজেকে হারিয়ে শুধু তাকেই পাওয়া তবু একদিন এদের ছেড়ে চলে যেতে হবে আর সেটা হবেই। মা ও আজকাল ভাবেন। অম এতো যে তাকে ভালোবাসে। এতো যে তাকে ছাড়েই না। যখন তিনি অমকে ছেড়ে চলে যাবেন, কিভাবে থাকবে অম! আসলে অমূলক চিন্তা। কষ্ট বুকে নিয়ে ঠিকঠাক বেঁচে থাকবে তার অম। সবাই থাকে। চিরন্তনী রীতিগুলো মানবার আশ্চর্য রকম ক্ষমতা মানুষের আছে।

    অম সরকারি চিকিৎসক। চাকরীর প্রয়োজনে এই জেলা, সেইজেলা ঘুরঘুর করতেই হয়। কিন্তু মন যে পড়ে থাকে মায়ের দিকে। যেদিন প্রথম ঘর ছাড়লো, মা অনেক আদর আর প্রার্থনা করেছিলেন,

    -আহা! আমার বাচ্চাটা বড় ই হয়ে গেলো। আমাদের ছেড়ে একা থাকবে, চাকরী করবে, আমরা লাল টুকটুক একটা বেটার বউ খুঁজি কি বলিস! নাকি পছন্দ টছন্দ আছে রে?

    ওইদিন অরিন্দম ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলো। হয়তো অন্য ছেলেরা লজ্জা পেতো এমন কথা শুনে কিন্তু তার কান্না পাচ্ছিলো। আজব কথাবার্তা বলছে মা। সে কি বুঝতে পারছে না, তাকে ছেড়ে যেতে ওর কতটা কষ্ট হলো। জান বের হয়ে যাচ্ছে আর কি সব উল্টাপাল্টা কথা বিয়ে বউ...একটু অভিমান নিয়েই কেমন বের হয়ে গেলো সে। বারবার ছেলেমানুষি একটা আশা করছিলো কি সে। পিছন থেকে মা ডাক দিয়ে বললেন,

    -অম, বাদ দে। তোর সরকারি চাকুরী করতে হবে না। তুই আমার কাছেই থাক। কাছেপিঠে কোথাও প্রাইভেট চাকুরী নিলেই চলবে, তবু দিনশেষে আমার ঘ্রাণ টা তো নিতে পারবি। অম এর মনে হলো, ইসস! এইগুলো কি মেয়েমানুষি চিন্তাভাবনা। কেউ জানলে কি বলবে। তবু মন মানে না। মাকে যে ছাড়তেই মন চায় না। এতো কেনো সে মাকে ভালোবাসে। মা কেনো এতো ভালোবাসে। এতো আদর, যত্ন করে তার তেরোটা বাজিয়েছে। এখন জিদটাও যেনো মায়ের উপর। তবু জীবনের তাগিদে দূরেই থাকা হয়, আর গভীর রাতে মায়ের একটু ছোঁয়া পাবার জন্য হুহু করা মনটাকে ঝারি দিয়ে সান্ত্বনা পাওয়া।

    অরিন্দমের চাকরীর ন'মাসের মাথাতে মা ব্রেন স্ট্রোক করে বসলেন। অরিন্দমের আকাশপাতাল সব এক হয়ে গেলো। ভুলে গেলো তার নিজের অস্তিত্ব, নিজের জীবনের উন্নতির ভাবনাগুলো, ভুলে গেলো সমাজের প্রতি দায়িত্ব। হ্যা, বলা যেতে পারে এটা কি স্বাভাবিক! নাহ, তবে কিছু ভালবাসা, কিছু আবেগ কিন্তু সত্যি অস্থির,সত্যি অন্য রকম। চাকরি ছেড়ে অরিন্দম চলে এলো মায়ের কাছে।

    এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতাল কত দৌড়াদৌড়ি। কত ছুটে ছুটে মায়ের সেবা করার জন্য অস্থির অরিন্দম। কাউকেই যেনো বিশ্বাস নেই তার। মাকে ফিরাতে হবে যে। নিজের হাতে সব করতে চায় সে। জ্ঞান ফিরলেও, মা এর হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই। পুরোটাই বিছানাতে পড়ে গেলেন মা। সারাক্ষণ অরিন্দম মাকে নিয়ে ভাবে। মার যত্ম। মায়ের ওষুধ খাওয়ানো, তরল খাবারের পুষ্টিমান ঠিক করা। সময় মতো চার ঘন্টা পর পর খাওয়ানো। রাত জেগে নেবুলাইজ করা, নিজ হাতে মায়ের ডায়াপার পরিবর্তন করে দেওয়া। শুয়ে থাকতে থাকতে চামড়ার যে অংশগুলো মায়ের একটু লালচে, নরম হয়ে আসছে সেগুলোর যত্ন নেওয়া, বড় কারো সাহায্য নিয়ে সপ্তাহে এক বা দুইদিন নিজ হাতে সাবান গলে মাকে পরিষ্কার করা। ঠান্ডা যাতে লেগে না যায় তাই কি যত্ন করেই না মায়ের চুলগুলো মুছে দেয়।

    মা তো কথা বলতে পারে না আর। বড় বড় চোখ করে শুধু তাকিয়ে থাকে অরিন্দমের দিকে। আর চোখ গলে জল পড়ে বালিশ ভিজে। এখন আর মায়ের জল লুকাবার ক্ষমতা নেই। অদ্ভুত কষ্টে বার বার নিমজ্জিত হয়ে যায় অরিন্দম। অনেক সময় মাকে পরিষ্কার করতে দেরি হয়। অরিন্দম তো মানুষ। দিন রাত মায়ের পিছনে থেকে সেও মাঝেমাঝে খুব ক্লান্তি বোধ করে। অন্য মানুষেরা নাকে কাপড় চেপে তখন ঘরে ঢুকে। খুব্ব কষ্ট বাড়ে তখন অরিন্দমের। আহা কি মানুষ। এই মা সবাইকে কত আদর, ভালোবাসতো কত রান্না করে খাওয়াতো ডেকে ডেকে। বাসা ভর্তি মানুষের ঝাঁক শুধু মায়ের তাদের আল্লাদের কারণে ছিলো, আজ কত অচ্ছুৎ তার মা। কত ঘৃণিত। মাকে আসে দেখতে নাকে রুমাল চেপে। অরিন্দম সহ্য করতে পারে না। তাই মানুষের আজকাল লোক দেখানো রুগী দেখতে আসাটা একদম সহ্য করতে পারে না অরিন্দম। বাজে ব্যবহার করে দেয় কিছুটা ভুল বুঝে আস্তে আস্তে সবাই দূরে সরে যায়। আর এটা আসলে হতোই। অসুস্থ, রোগীর পাশে কে বা কারাই বা থাকতে চায়। শুধু মা সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, জড়িয়ে রাখে অরিন্দম। সেই বারবার বলে,

    -মা তুমি সুস্থ হবে না, মা জানো তোমার গায়ের গন্ধ এখনো সেই এক রকম আছে। মা, তুমি আবার আমাকে একটু রেঁধে নিয়ে রাগ হয়ে ডাকবে না, বাচ্চা আয় কখন খাবি? মা, তুমি ভয় পেয়ো না আমি আছি তোমার সাথে।

    মা খুব ভয় পান একা রাতে ঘুমাতে। মাঝেমাঝে বিকট চিৎকার করেন যন্ত্রণা। ভয়াবহ গোঙানির মতো আওয়াজ। কি কষ্ট কি কষ্ট! কথা বলতে পারেন না, কথা বুঝতে, বুঝাতে পারেন না। কিন্তু চিৎকার করে ইশ্বরকে ডাকেন। আহা রে, সে কি চায় এই ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! কিন্তু অরিন্দম তো তাকে মরতে দিতে চায় না। সে চিকিৎসক হওয়াতে কি আরো কষ্ট কি বেড়েছে মা এর। এতো যত্ন করে করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। পরিবারের অন্য সব সদস্যরাও দারুণ বিরক্ত। আর সেটা স্বাভাবিক। একে তো অরিন্দমের মাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আর অন্যদেরও তো কিছুটা দৈনন্দিন এর কাজের ব্যঘাত হয় এমন একটা বিছানা রুগী বাড়িতে থাকলে। হয়তো প্রকাশ্যে বা আড়ালে কেউ কেউ বলেই ফেলেন, ইশ্বর বেচারাকে মুক্তি দিন। এটা কোন মুক্তি। জীবন মুক্তি না মরণ মুক্তি! অবুঝ অরিন্দম কেবল জানে মায়ের জীবন মুক্তি। এমনি ভাবে দিন আসে যায়। হতাশা, অস্থিরতা আর বাজে কিছু ঘটনা দিয়ে। আবারও এর ভিতরই রোগের প্রকোপ বাড়ে কমে মায়ের। সারা শরীর জুড়ে বাইরে ভিতরে অসুখের ছড়াছড়ি, সাথে ডায়াপার, ক্যাথেটারের যন্ত্রণা পাগল প্রায় মা। আর মাঝেমধ্যে অরিন্দম কেমন পাগল পাগল আচরণ করে, চিৎকার করে কান্না করে বলে, মা তুমি মরে যাও, মরে যাও আমি তোমার অভিশাপ। কিন্তু পরক্ষণেই কি এক অজানা আশংকাতে আবার জড়িয়ে নেয় শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে যাওয়া মা টিকে। এমন সময়টাতে যে কেউ ঘরে প্রবেশ করলে বুঝতে পারতো, এ যেনো পিতা পরম মমতায় তার সন্তানকে অসম্ভব মমতা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টাতে অসহায় আর ক্রন্দনরত সময় পার করছে।

    দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হবার পর মা একেবারেই কোমাতে চলে গেলেন। এবার তো আর হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই অরিন্দমের। চিকিৎসক বলে নিবিড় পরিচর্যা ঘরটির যেটাতে মাকে রাখা সে অনায়াসে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে গিয়েছে। কত কি তার, যন্ত্র দিয়ে কৃত্রিম ভাবে মাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। খুব খেয়াল করে অরিন্দম প্রতিটা যন্ত্র, প্রতিটা তার, প্রতিটা মায়ের হৃদস্পন্দন খেয়াল করে,বেঁচে আছে তো, কোথাও কোনো ভুলের কারণে না আবার মায়ের শ্বাসটা বন্ধ হয়ে যায়।

    তারপরও একদিন ঠিকঠিক অদ্ভুত কষ্ট শুরু হলো মায়ের। ছটফট করে বড় বড় করে তাকালেন অরিন্দমের দিকে, অরিন্দমের খুব ইচ্ছে করছিলো সব তার টেনে হিঁচড়ে খুলে মাকে বুকে জাপ্টে নিতে। তারগুলোকে তার একমাত্র শত্রু মনে হচ্ছিলো। কিন্তু নিয়মের বাইরে অনেক আবেগকে স্থান দেওয়া যায় না। মন অস্থির করে সে দাঁড়িয়ে রইলো। সেইদিন রাতেই হঠাৎ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বললেন, মায়ের আর কোনো আশা নেই। মাকে বাঁচিয়ে রাখা কৃত্রিম সকল যন্ত্রপাতি খুলে দেবার অনুমতি চাইলো তারা অরিন্দমের কাছে।

    এবার সাংঘাতিক শান্ত হয়ে গেলো অরিন্দম। শুধু জিজ্ঞাসা করলো,

    -ঠিক কখন?

    আসলে ঠিক তখনি খোলা হবে মায়ের বেঁচে থাকবার সব মানুষের তৈরি বেকার উপকরণ, যখন ইশ্বর সেটা নির্ধারণ করে রেখেছেন। হাজার চেষ্টাতেও সেটা আটকানো যাবে না। মেনে নিলো অরিন্দম। শুধু অনুমতি নিয়ে রাখলো সেই সময়টাতে সে সামনেই থাকবে আর নিজ হাতেই সব খুলে দিবে। খুব অস্বাভাবিক লাগে নাই এই ব্যাপারটা অন্য চিকিৎসকদের। তারা অনুমতি দিলেন।

    মায়ের যন্ত্রপাতি খোলবার আগে, মায়ের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো অরিন্দম। কপালে ঠোঁট ছুঁয়েই রাখলো খানিকক্ষণ। এরপর আস্তে আস্তে সব যন্ত্রপাতি খুলে নিতে থাকলো। একমনে। অন্য চিকিৎসক, সেবিকারা তাকিয়ে আছে, তাদের কেনো জানি আজ খুব কষ্ট লাগছে। এই কাজটা তারা করে আর অহরহ দেখে কিন্তু এটা তাদের দেখা হয়নি যে নিজের হাতে সন্তান তার মায়ের বেঁচে থাকবার কৃত্রিমতাকে থেকে মুক্তি দিচ্ছে। তাও এমন সন্তান যে মাকে এতোটাই ভালোবাসে সেটা তো বাকিদের অজানাই থেকেই গেলো। শুধু শেষ মুহুর্তে অদ্ভুত অবস্থা সৃষ্টি হলো।

    সব খুলে দেবার পর মায়ের হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। সাথে বড় বড় চোখ আর জল দিয়ে ভরা সেই চোখ! অরিন্দম অস্থির হয়ে চিৎকার আর ছুটাছুটি শুরু করলো,

    -নেবুলাইজার নেবুলাইজার...এই হিট মেশন টা দাও....মায়ের চোখের জল মুছাবো টিস্যু দাও,,চোখের ড্রপ দাও....কই কই কই...

    সবাই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নড়লো না, মা শান্ত হয়ে গিয়েছেন কিছু মুহুর্তে আগে, সেটা অরিন্দম একেবারেই খেয়াল করছে না....

    /পি.এস

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close