হাসপাতাল নয়, কসাইখানা
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ঔষুধসহ দেলোয়ার নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব এবং ধৃতব্যক্তির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর চারটি নামি হাসপাতালে অভিযান চালায়। দেলোয়ার র্যাবকে জানায়, ওই চারটি হাসপাতালে সে ওইসব প্রাণঘাতী ওষুধ নিয়মিত সরবরাহ করত। দেলোয়ারের কথা সত্যি হলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন রসাতলের শেষ ধাপে। আটককৃতর কথার ভিত্তিতে হাসপাতাল চারটিতে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান চালিয়ে কী তথ্য উদ্ধার করেছে দূরে থাক, অভিযানের খবরটাই মানুষকে দেয়নি দেশের অনেক গণমাধ্যম। র্যাবের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি দমন কমিশনও হানা দেয় হাসপাতালগুলোয়। সেই খবরও ততটা প্রচার পায়নি, যতটা পাওয়া উচিত ছিল। অথচ এই হাসপাতালগুলোর কুকীর্তি ধারাবাহিক প্রতিবেদন হওয়ার দাবি রাখে। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো এইসব জনগুরুত্বপূর্ণ খবর চেপে যায়। চেপে যাওয়ার কারণ অনুমান করার জ্ঞানবুদ্ধি পাঠকের আছে। গণমাধ্যম নয়; এগুলো ‘গণধোলাইমাধ্যম’। অগণন সাধারণের নয়, কতিপয় বিত্তবান ও ক্ষমতাবানের পাহারাদার এগুলো। পাহারার বিনিময়ে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে সুবিধাও আদায় করে।
সম্পর্কিত খবর
কিছুদিন আগে স্কয়ার হাসপাতালে বাবার করুণ মৃত্যু নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীর। প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ । শিউড়ে ওঠার মতো লেখা। ওই লেখার সূত্রে প্রাবন্ধিক-ভাষাচিত্রী মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছিলেন একটি বস্তুনিষ্ঠ গদ্য। সেই গদ্যে লেখক হাসপাতাল নামের এই কসাইখানাগুলোর মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন ক্ষুরধার কলমে। তিনি বলেছিলেন—
“প্রয়োজন থাক বা না থাক, হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা রোগীকে প্রথম সুযোগেই তারা আইসিইউতে নিয়ে যায়, তারপর সেখান থেকে লাইফ সাপোর্টে। মৃত ব্যক্তিকেও লাইফ সাপোর্টে রাখার নাম করে তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে নেয় এরা। রোগীর নিকটজনদেরও কিছু জানার বা বুঝে ওঠার সুযোগ দেয় না। ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীকেও দুদিন বা তিনদিন লাইফ সাপোর্টে রেখে বেডসোর ঘটিয়ে তারপর ছাড়ে। রোগীর পারিবারিক অবস্থা বুঝে তাদের এই শকুনি-তৎপরতা শুরু হয়। আর রোগীর মৃত্যুর পরও তা চলতে থাকে। ভুক্তভোগী অনেকের কাছ থেকেই বছরের পর বছর আমরা এমন অভিযোগ শুনে আসছি।”
শুনেও আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করি বলে সিংহভাগ মানুষ আজ কতিপয় গণশত্রুর কাছে জিম্মি। কতটা জিম্মি হলে মানুষ অর্থ দিয়ে মৃত্যু কেনে, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাদের প্রশ্রয়ে হাসপাতাল নামের কসাইখানাগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার স্পর্ধা পায়, সেই সত্যও নির্মেদ ভাষায় তুলে ধরে মোরশেদ শফিউল হাসান তার গদ্যের শেষে একটি অমোঘ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন আমাদের সবার উদ্দেশে—
“তারা দেশের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ক্লাসিকাল ও ফোক ফেস্টিভালসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন বা তার স্পন্সর হওয়ার পাশাপাশি গুণীজনদের সংবর্ধনা এবং পুরস্কার-সম্মাননা ইত্যাদি প্রদান করেন। ফলে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যারা দেশ ও জনগণের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামান, রোজদিন সভা-সেমিনার-টিভি টকশোতে কথা বলেন, পত্রিকায় কলাম লেখেন, তারাও এদের এই দৌরাত্ম সম্পর্কে নীরব। সবকিছু জেনেও যেন না জানার ভান করেন। কিন্তু এভাবে কতদিন? যারা ভুক্তভোগী তাদের তরফে কিছু হাসপাতালের চিকিৎসার নামে এই মৃত্যু-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার— জোরালো প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় কি এখনও আসেনি?”
তখন ওই হাসপাতালগুলোয় কর্মরত ডাক্তার, কর্মকর্তা কর্মচারীদের একাংশ? মাসশেষে কিছু টাকা পাওয়ার বিনিময়ে চিকিৎসাপ্রার্থী অগণন অসহায় মানুষকে দানবের মুখের আহার বানাতে সদাতৎপর থাকে। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করতে ওদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না। একবারও ভাবে না— চিকিৎসাপ্রার্থী ওই অসহায় মানুষগুলো কারও না কারও মা, কারও বাবা, কারও প্রাণপ্রিয় সন্তান। ওদিকে বিপদে পড়লে দানবরা ক্ষমতা ও প্রশাসনের উচ্চপদে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের দ্বারস্থ হয়। অথবা, অর্থগুণে খণ্ডকালীন পরমাত্মীয় বানিয়ে নেয় প্রয়োজনীয় কিছু অর্থগৃধ্নু মানুষকে। দানবদের বিপদ কাটতে বেশি সময় নেয় না। আর, সাধারণ মানুষের আসে দিন যায় দিনের চেয়ে খারাপ হতে থাকে। সব দেখেশুনে মোরশেদ শফিউল হাসান যে-প্রশ্নটি আমাদের সবার উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছিলেন, তার উত্তরে শুধু এতটুকুই বলা যায়— প্রতিরোধ গড়ার সময় অনেক আগেই এসে গেছে। হাজার মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা ওইসব রক্তচোষার বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ডিনামাইট হয়েই আছে। অপেক্ষা শুধু বিস্ফোরণের।
লেখক: কবি, চিন্তক ও সংবাদব্যক্তিত্ব