• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কালজয়ী লেখকের সাড়া জাগানো বই

প্রকাশ:  ২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:০১
হাসান হামিদ

লেখা শুরুর আগে একটি ঘটনা বলি। দেশ পত্রিকার সম্পাদক তখন সাগরময় ঘোষ। তিনি একবার বেড়াতে গিয়ে নদীতে পড়ে গেলেন। তা দেখে সাথে সাথে এক যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার করল। কিছুদিন পর যুবকটি দেশ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা নিয়ে হাজির হল তার কাছে। কবিতাটি পড়ে সাগরময় ঘোষ যুবকটিকে বললেন, ‘তুমি বরং এক কাজ করো। আমাকে যেখান থেকে উদ্ধার করেছিলে সেখানে ফেলে দিয়ে আসো।’

আমাদের দেশের অনেক কালজয়ী কবি বা লেখকের অবস্থা ওই যুবকের চেয়ে ভালো নয়। এবারের একুশে বইমেলায় একটি প্রকাশনীর সামনে এক বড় পোস্টারে লেখা, ‘কালজয়ী লেখকের সাড়া জাগানো উপন্যাস’। আমি বুঝলাম না, যে উপন্যাস আজ বের হলো সেটি কীভাবে সাড়া জাগানো হতে পারে। আর লেখকের কথা কী আর বলবো, আজকের যুগে সবাই যেমনি রাজনীতিবিদ, তেমনি লেখক। আমার এক পরিচিত প্রকাশক আছেন, যিনি নিজের প্রকাশনী থেকে তার লেখা প্রায় শতেক বই ছাপিয়েছেন। তিনি বা এমন যারা, তারা কালজয়ী শুধু নয়, দিগ্বিজয়ীও।

সম্পর্কিত খবর

    সবাই কিন্তু লেখেন না, কেউ কেউ শুধু বলেই যান; আর অন্যে তা লেখে হয়ে যায় লেখক। কারও মুখের কথাই লেখা হয়ে যায়, যদি তাতে প্রাণ থাকে। “নেপোলিয়নের প্রতিটি কথা এবং তার লেখার প্রতিটি লাইন পড়ার মতো, কারণ তাতে আছে ফ্রান্সের প্রাণ”- এ কথা বলেছিলেন আমেরিকান প্রবন্ধকার র্যারল্ফ ওয়ালডো ইমারসন। এমন ব্যক্তিদেরকে মনে নিয়েই হয়তো বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, “হয় পড়ার মতো কিছু লেখো, নয়তো লেখার মতো কিছু করো।” আমাদের আসলে প্রথমত পড়তে হবে, তারপর পড়তে হবে, এবং শুধুই পড়তে হবে। সবশেষে আমরা কিছু পেলেও পেতে পারি।

    কিছু দিন আগে আমাদের দেশের এক নতুন কণ্ঠ শিল্পীর আবির্ভাব হয়েছিল। অবশ্য সবার অধিকার আছে নিজেকে প্রকাশ করার। কিন্তু সব কিছুর স্বাভাবিকতাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সেই নতুন মুখের শিল্পীর গানের জ্ঞান না নিয়ে যেমন নিজেকে প্রকাশ করা হাস্যকর ছিল, তেমনি আপনি যদি অন্য অনেকের লেখা না পড়ে লিখতে যান, আপনার অবস্থা তেমন হবে; এটাই ধরে নেয়া যায়। তবে লোকে পড়ে হাসবে, বা কী বলবে তা ভেবে লেখা বন্ধ করাও যাবে না। আপনি প্রকাশ হতে তাড়াহুড়া করবেন না, কিন্তু লিখতে থাকবেন। “লেখা বন্ধ করলেন তো লেখকের তালিকা থেকে বাদ পড়লেন”, রে ব্যাডবেরির এই কথা মনে রাখতে হবে।

    অবশ্য কেউ কেউ আছেন, যারা লেখার আগেই ছাপানোর জন্য অস্তির হয়ে যান। এমন একজন একদিন আমাকে খুব করে ধরলেন, আমি যেন তার লেখাটা কাউকে বলে ছাপিয়ে দিই কোনো পত্রিকায়। সোজা বাংলায় তদবির। কিন্তু কথা হলো আপনার লেখা আজই কেনো ছাপতে হবে; সত্যিকারের কবি বা লেখক যারা, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তারা আড়ালে ছিলেন। এমনকি মৃত্যুর পর তাদেরকে মূল্যায়ণ করা হয়েছে। আর ভালো লেখার রহস্য সেটা তো নিজেই এক রহস্য। এ নিয়ে আরেকটি গল্প।

    এক অধ্যাপক জিজ্ঞেস করলেন তার ছাত্রকে, ভালো লেখার তিনটি গোপন রহস্য আছে, তুমি তা জানো? ছাত্র তো নির্বাক। ভাবছে স্যারের মনের কথা বলার জন্যই ভূমিকা করছেন। তাই ছাত্র অপেক্ষার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো স্যারের দিকে। শেষে জিজ্ঞেসই করতে হলো, স্যার আপনি কি তা জানেন? অন্য দিকে উদাসীন দৃষ্টি দিয়ে স্যার বললেন, নাহ, আমিও জানি না। কৌতুকটি সমারসেট মমের মজার কথাটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, উপন্যাস লেখার তিনটি কৌশল আছে। দুর্ভাগ্যবশত কেউই তা জানে না! এই হলো ভালো লেখার রহস্য; যা কেউ জানে না। অথচ কৌশল নিয়ে আমরা কত সময় নষ্ট করি। অনেকে লেখাই বন্ধ করে দেই!

    তাই লিখে যেতে হবে। যা মন চায়; তবে প্রকাশের ধান্দাটি আগে নয়। আর লেখতে লেখতে শুধু লেখাই হয় না, পড়তে পড়তে শুধু পড়াই হয় না; আবিষ্কারও করা যায়। বেকনের ভাষায়, পড়া মানুষকে পরিপূর্ণ করে, সংলাপ মানুষকে প্রস্তুত করে আর লেখায় মানুষকে শুদ্ধ করে। কীভাবে একটি কবিতা শেষ হবে এই ভেবে রবার্ট ফ্রস্ট কখনো কবিতা লিখতে শুরু করেননি। লেখতে লেখতে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজেকে।

    সবাই কিন্তু রবীন্দনাথ বা জীবনানন্দ নন, কেউ কেউ মৃত্যুর পূর্বেও লেখক হয়ে বিদায় নেন, আর তা হয় কালোত্তীর্ণ। আপনার জীবনের গন্তব্য কী? এরকম প্রশ্নের জবাবে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক সফল সরকারি কর্মকর্তা বলেছিলেন, “আমি এখন লেখালেখিতেই জীবন শেষ করতে চাই।” পাঠক থাকুক আর না-ই থাকুক, হিসেব করলে দেখবো যে, আমরা অনেকেই লেখক। তবে লেখক হবার স্বপ্ন বা ইচ্ছা অনেকেরই হয়। সম্ভবত লেখকরা সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকেন পৃথিবীতে। শেক্সপীয়ারের মৃত্যুর চারশো বছর পরও সারা পৃথিবীতে তিনি কত প্রাসঙ্গিক; ভাবা যায়? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও এককালের সংবাদকর্মী স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতি বা রাজনীতিবিদ নিয়ে আমি আর কিছুই করছি না। এই যুদ্ধ শেষ হলে সম্পূর্ণভাবে আমি লেখা আর আঁকায় মনোনিবেশ করতে চাই’’। চার্চিলের মতো সফল রাষ্ট্রনায়কের জীবনের গন্তব্য ছিলো লেখক হওয়া, তাহলে লেখক হতে চাওয়া বালক-বালিকাদের দোষ কী? আসলে কোনো দোষ নেই, তবে একেবারে না পড়ে লেখক হতে চাওয়াটা পাপ।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close