• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নির্মম বেকার জীবন, কঠিন বাস্তবতা

প্রকাশ:  ০৬ মে ২০১৮, ১৫:২৩
এসএম নূরুন নবী

২০১৭ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর শাহবাগে পরীক্ষার তারিখ ও সময়সূচি ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারানো তিতুমীর সরকারি কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানকে চাকরি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডে টেলিফোন অপারেটর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর সিদ্দিকুর রহমান কর্মস্থলে যোগদান করেন।

সোহাগ (ছদ্মনাম) নামের এক চাকরিপ্রার্থী সিদ্দিকুরের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলেন, সিদ্দিকুরের চোখের আলো না থাকায় পৃথিবীর আলো দেখতে পায় না। আর আমার চোখে আলো আছে, কিন্তু আমার পৃথিবীটাও অন্ধকারে ঢাকা। সেখানে আছে হতাশা আর একরাশ গ্লানি। আমি চোখ থাকতেও সিদ্দিকুরের মতো অন্ধ হয়ে আছি কিংবা হাত-পা থাকা সত্ত্বেও পঙ্গু হয়ে আছি। সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। সিদ্দিকুর চোখ হারিয়ে হলেও কিছু পেয়েছেন। কিন্তু আমি সোহাগের...? গত দেড় বছর একটি অস্থায়ী চাকরি ছিল, গত মাস থেকে সেটিও নেই। আশা ছিল, চাকরিটি একসময় স্থায়ী হবে। এর মধ্যে কোথাও আরেকটি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারিনি। তারও আগে দুই বছরের মতো বেকার ছিলাম। সেই দিনগুলোয় বেশির ভাগ সময়ই না খেয়ে ছিলাম। এমনকি টানা দুদিনও উপোস ছিলাম। এখন আবার সেই দিনগুলোর মুখোমুখি হয়েছি। কতজনকে বলেছি একটি চাকরির কথা। দু-একজন চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু হয়নি। অনেকে টাকা দিয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সম্মানার্থে নিয়েছি। কিন্তু এটা ছিল আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। আমি ভিক্ষা নয়, কাজ বা চাকরি চাই। আজ কেউ যদি আমার চোখ বা হাতের বিনিময়ে একটি চাকরির কথা বলেন তাহলে তাকে আমি ফিরিয়ে দেব না কিংবা সরকারকে বলব, দরকার হলে আমারও চোখ নিয়ে নিন, হাত নিয়ে নিন। তবুও আমাকে একটি চাকরি দিন।

সম্পর্কিত খবর

    সাত মাস আগে আব্বা স্ট্রোক করেছেন। তার চিকিৎসার জন্য দৈনিক ৩০০ টাকার ওষুধ লাগে। কিন্তু আমি মাসেও ৩০০ টাকা দিতে পারিনি। সপ্তাহ খানেক থেকে মাও খুব অসুস্থ (বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগে আক্রান্ত তিনি)। বাধ্য হয়েই তাকে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করেছেন মেজো ভাই। চিকিৎসার জন্য টাকা দেয়া তো দূরের কথা, একটু দেখতে যাব সেই সামর্থ্যটুকুও নেই। কারণ কোনোভাবে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলেও আর ঢাকায় ফিরতে পারব না। ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারছি না, ‘মা এখন কেমন আছো? আমি আসতেছি, কী আনব তোমার জন্য? চিন্তা করো না, অসুখ ভালো হয়ে যাবে!’ মা কিছুই চাইবেন না। কারণ তিনি জানেন তার ছেলের অবস্থা। দুই মাস আগে আব্বা বলেছিলেন, ‘তোর ভাইর কাজ নাই, ঘরে চাল নাই, অ্যাঁর ওষুধ নাই। হাইল্লে কিছু টাকা দিছ বাবা।’ বলেছিলাম, এখন তো নাই, পরে দেব ইনশাল্লাহ। আব্বা বললেন, ‘সারা জীবন তো ইনশাল্লাহই বললি, টাকা তো আর দিলি না।’ এরপর আমি চুপ হয়ে যাই। সেই থেকে এখনো চুপ হয়েই আছি। আর এভাবেই হয় তো একদিন চিরতরে চুপ হয়ে যাব।

    এই বেঁচে থাকা বড় বেশি বেদনাদায়ক। না পারছি বাঁচতে না পারছি মরতে। জীবনের ভার আর সইতে পারছি না। প্রত্যাশার ভারে ন্যুব্জ। চোখের জল চোখের কোনায় ধরে রাখি। লোকলজ্জায় প্রাণ খুলে কাঁদতেও পারি না। কিন্তু প্রতিনিয়ত হূদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বুকে পাথর চেপে আছি এই আশায় যে, সব অন্ধকার কেটে যাবে। ভোরের আলোয় যেমন অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত হয়, তেমনি একটি নতুন সকালের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেই সকালটি আর কখনো আসবে না! আমি যত জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাই, ততই জীবন আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। জীবনের গলিপথে শুধু একটি ‘ছায়া’ দেখতে পাই। কিন্তু আমি সেই ছায়া মাড়াতে চাই না। তবে নিরুপায় এই আমি হয় তো একদিন সেই ছায়াকেই আলিঙ্গন করে স্বপ্নের পথে পথ হাঁটব। তারপর ওই তারা হয়ে মা-বাবার খবর নেব। সেই দিন তাদেরকে বলব, কেন তাদের খবর নিতে পারিনি। কেন তাদের ফোন ধরিনি। কেন তাদের দেখতে যাইনি। মা, সারা জীবন তোমাদের কাছে শুধু চেয়েই গেছি। আজো চাচ্ছি, মা-বাবা তোমাদের এ অক্ষম ছেলেকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। চাকরিপ্রার্থী তরুণ সোহাগ এ লেখককে এভাবেই তার বেকারজীবনের করুণ গল্পটি বলেন। তার জন্য দুফোঁটা অশ্রু ছাড়া তাকে সান্ত্বনা দেয়ার আর কিছুই ছিল না।

    এ যাতনা শুধু তার একার নয়, তার মতো এ রকম আরো ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার যুবক-যুবতীরও। এ তরুণরা গভীর হতাশায় ভুগছেন। লেখাপড়া শেষ করার পরও তারা জানেন না, কোথায় যাবেন, কী করবেন। এই যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারা দেশের লাখ লাখ তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার পেছনেও ছিল ভয়াবহ বেকারত্ব। এ বেকার যুবক-যুবতীরা প্রাণ খুলে হাসতে পারছেন না, মন খুলে কথা বলতে পারছেন না। মধ্যবয়স পেরিয়ে গেলেও অনেকে সংসার শুরু করতে পারছেন না। এ তরুণরা এখন নতুন করে আর স্বপ্ন দেখেন না। জীবনের রুঢ বাস্তবতা তাদের সব স্বপ্ন-আশা কেড়ে নিয়েছে। বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট তাদের সোনালি ভবিষ্যৎ। শুধু একটি চাকরি তাদের জীবনকে আজ থামিয়ে দিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) তরুণদের নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এসব তরুণ মনে করেন না যে, নিজের দেশে তাদের ভবিষ্যৎ আছে। জরিপের ফলাফলটি প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা বাংলাদেশে তরুণদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করেছে, তার সঙ্গে যথেষ্টই সঙ্গতিপূর্ণ। জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পরিষ্কারভাবেই জানান দেয় যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম তেমন একটা ভালো নেই এ দেশে। তরুণরাই যখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, তখন তা আমাদের একটি বার্তা দেয়; আর তা হলো, দেশের জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাজনক একটি সময়।

    দেশে একটি পিয়ন পদে চাকরির জন্য আবেদন পড়ে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, এমনকি স্নাতকোত্তর পাস হাজার হাজার যুবকের। চাকরি নামে সোনার হরিণটি পাওয়ার জন্য অনেককে বছরের পর বছর অপেক্ষায় কাটিয়ে দিতে হয়। এছাড়া সর্ববৃহৎ চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় যেখানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কোটার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, সেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ না হয়ে উপায় কী মেধাবী তরুণদের!

    আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সংজ্ঞা মেনে বিবিএস দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার দেখিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিএস যে পদ্ধতিতে বেকারত্ব নির্ণয় করে, তা শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য। আইএলওর সংজ্ঞাটি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ বেকার ভাতা এবং আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বেকারত্বের সংজ্ঞা দাঁড় করায় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। জানা গেছে, বিবিএস প্রকাশিত এ জরিপে ১ ঘণ্টা কেউ কাজ করলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়নি। ১৫ বছরের বেশি বয়স কিন্তু সরাসরি শ্রমিক নন— এমন জনগোষ্ঠীকে আইএলও শ্রমিক বা বেকার কোনোটিই বলে না। অথচ এ দেশের বাস্তবতায় বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে বেকার বলে স্বীকার না করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

    দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ভালো নয়। চাকরির বাজার খুবই সীমিত। বিশেষত শিক্ষিত যুবক শ্রেণী কোনোমতে খেয়েপরে বাঁচার মতো একটি কাজ না পেয়ে তীব্র হতাশায় নিমজ্জিত, এমনকি চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যার নজিরও আছে। পরিসংখ্যান আর বাস্তবতার মাঝে সবসময়ই ফারাক থাকে। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশিই হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি, দেশের এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করুন।

    লেখক: সাংবাদিক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close