• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জন্মদিনের অনুভূতিতে রবির বচন

প্রকাশ:  ০৭ মে ২০১৮, ০৩:৩১ | আপডেট : ০৭ মে ২০১৮, ১৯:১৩
রুদ্র মাহমুদ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মবার্ষিকী ২৫ বৈশাখ আজ। প্রতিবারের মতোই এবারও সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী। মজার ব্যাপার হলো অনাদরে বেড়ে ওঠা রবির জন্মদিন শৈশবে কখনো পালিত হয়নি। এমনকি কবির আশি বছরের জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর কোন জন্মদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়নি। জীবনের প্রথমদিকে জন্মদিন পালন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তেমন উৎসাহ ছিল না। তা্ই আর দশটা দিনের মতোই জন্মদিন কবে কখন এলো গেলো কবি নিজেও টের পেতেন।

মূলত চল্লিশ বছরের পর থেকেই কবির ভক্ত ও আপনজনের উৎসাহে বেশ আড়ম্বড়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন শুরু হয়। কবি নিজেও তার বিভিন্ন জন্মজয়ন্তীতে ভক্তদের উদ্দেশে অনেক কথা বলেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, অনেক কবিতা লিখেছেন। আসুন, জীবদ্দশায়া নানা সময় পালিত জন্মদিনে কবিগুরুর অনুভূতি সম্পর্কে জানি।

সম্পর্কিত খবর

    ১৩১৭ সালে বোলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংবর্ধনায় কবি প্রথম নিজের জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, জন্মদিন সম্বন্ধে এখনো তাঁর কোনো গভীর অনুভূতি নেই।"কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে নিজেকে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।"

    ৫০তম জন্মদিবসে কবি নিজেকে আলোক প্রভায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব পালন করছো তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব সার্থক। আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নতুনভাবে পেয়েছ, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লৰণ নেই। তাই আজ সকালে তোমাদের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে বসে আমার এই নবজন্মের নবীনতা অনন্তের বাইরে উপলব্ধি করছি।"

    কবির ৫৯তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেতন আশ্রমে। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন অথ্যাৎ ২৪শে বৈশাখ তিনি রচনা করেছিলেন, 'আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায়'।

    ১৩২৮ সালের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন জেনেভায়। সেখানে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও মাটির আকর্ষণে কবি ব্যাকুল হয়েছিলেন। তিনি এন্ড্রম্নজকে লিখেছিলেন, "আজিকার দিন যথার্থভাবে আমার জন্য নহে। যাহারা আমাকে ভালবাসে তাদেরই জন্য আনন্দের দিন। তোমাদের কাছ হইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে পুসত্মিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছি কিন্তু তাহা হইবার নাই।" এ দিন জার্মান জাতির পৰ থেকে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। কবির জন্য টমাসম্যান, অরকন, কাউন্ট কেইসার লিড প্রমুখকে নিয়ে গঠিত হয় সংবর্ধনা কমিটি। কবিকে উপহার দেয়া হয় জার্মান ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ।

    ১৩২১ সনে কবির ৬২তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শানত্মিনিকেতনে। কবি তখন শান্তিনিকেতনের ছায়ায় গ্রীষ্মের দিনগুলোর সঙ্গে গল্পমগ্ন ছিলেন। এই জন্মদিনে কবি উপহার দিয়েছিলেন 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতা;

    'রাত্রি হল ভোর

    আজি মোর

    জন্মের স্মরণ পূর্ণবানী,

    প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি

    হাতে করে আমি

    দ্বারে আসি দিল ডাক

    পঁচিশে বৈশাখ।

    ১৯৩১ সনে কবির ৬৪তম জন্মোৎসবে কবি ছিলেন চীনে। সাথে ছিলেন নন্দলাল বসু, এলমাহাস্ট, ৰিতিমোহন সেন প্রমুখ। অনেক দিন পর কবি চীনের সেই পঁচিশে বৈশাখের স্মরণে লিখেছিলেন,

    'একদা গিয়েছি চীনদেশে

    অচেনা যাহারা

    ললাটে দিয়েছে চিহ্ন, তুমি আমাদের চেনা বলে-

    যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।...'

    ১৩৩২-এর পঁচিশে বৈশাখে বিপুল উদ্দীপনায় কবির ৬৫তম জন্মোৎসব পালন করা হলো শান্তিনিকেতনে। এতোদিন যে জন্মদিন শুধু ঘরের মানুষের কাছে ছিল। এবার তা বিশ্বসভার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কবি এ সময় ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠি চিঠিতে লিখেছিলেন, "এমন একদিন ছিল যখন আমার জন্মদিনের সার্থকতা তোদের কাছে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। ক্রমে এখন এক সময়ে আমার জীবনের ৰেত্র বহু বিসত্মীর্ণ হয়ে পড়লো সেটা যেন আমার জন্মানত্মরের মতো। সেই আমার নবজন্মের জন্মদিন এতদিন চলে এসেছে। যেটাকে আমার জন্মানত্মর বলস্নুম তাকে আমার পরলোকও বলা চলে। অর্থাৎ যারা পর ছিল তাদের মধ্যেই একদিন আমার অভ্যর্থনা শুরু হয়েছিলো। তোদের লোক থেকে লোকানত্মরগতকে তোরা হয়তো সুষ্ঠু করে দেখতে পাসনি। যে ঘাট থেকে জীবনযাত্রা প্রথম শুরু করেছিলাম আমার কাছেও মাঝে মাঝে তা ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু এটা হলো মধ্যাহ্ন কালের কথা। এখন অপরাহ্নের মুলতানী সুর হাওয়ায় বেজে উঠেছে।"

    কবির ৬৬তম জন্মদিবসও পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। এই জন্মদিনটি দেশী-বিদেশীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। জন্মদিনে কবি উপহার দিলেন, 'নটির পূজা' ও 'পরিশেষ' কাব্যের 'দিনাবসান' কবিতা-

    'বাঁশি যখন থামবে ঘরে

    নিভবে দীপের শিখা।

    এই জনমের লীলার পরে

    পড়বে যবনিকা

    সেদিন যেন কবির তরে

    ভিড় না জমে সবার ঘরে

    হয় না যেন উচ্চ স্বরে

    শোকের সমারোহ।'

    এই অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দিয়েছিলেন, 'জন্মদিন' নাম দিয়ে তা প্রবাসীতে (জ্যৈষ্ঠ-১৩৩৩ সংখ্যা) প্রকাশিত হয়। "এই শ্যামল ধরণী, এই নদী, প্রান্তর, অরণ্যের মধ্যে আমার বিধাতা আমাকে অন্তরঙ্গতার অধিকার দিয়েছেন, এর মধ্যে নগ্ন শিশু হয়ে এসেছিলুম। আজও যখন দৈববীণা অনাহূত সুরে আকাশে বাজে তখন সেদিনকার সেই শিশু জেগে ওঠে, বলতে চায় কিছু, সব কথা বলে উঠতে পারে না। আজ আমার জন্মদিন সেই কবির জন্মদিন, প্রবীণের না।"

    ১৩৩৬ সালে জাপানের পথেই হয় কবির জন্মোৎসব। জাহাজের কাপ্তান ও যাত্রীরা কবিকে সম্বর্ধনা জানান।

    ১৩৩৭ সালে কবির ৬৯তম জন্মজয়ন্তী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জন্মদিনে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রশিল্পীরূপে। প্যারিসের দুই মহিলার উদ্যোগে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়। ফ্রান্স থেকেই কবি ইন্দিরা দেবীকে লেখেন, "ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখে অবতীর্ণ হয়েছেন তার কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছ্ন্ন, তিনি এখন চিত্রকররূপে প্রকাশমান।... এই বার আমার চৈতালি বর্ষ শেষের ফসল সমুদ্রপারের ঘাটে সংগ্রহ হলো।

    ১৩৩৮ সনে কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তিতে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সভাপতির ভাষণে শরৎচন্দ্র কবিকে মানবাত্মার কবি হিসেবে অভিহিত করেন। জন্মদিনের ভাষণে কবি বলেন- "একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, যে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই। আমি তত্ত্বজ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞানী, গুরু বা নেতা নই-কদিন আমি বলেছিলাম 'আমি চাইনে হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক- সে কথা সত্য বলেছিলাম।... এই ধূলো মাটি ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম, বনস্পতি, ঔষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটির হাতে মানুষ, যারা মাটিতেই হাঁটিতে আরম্ভ করে, শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, আমি তাদের সকলের বন্ধু-আমি কবি।... "

    কবি ৭১তম জন্মদিনে ছিলেন ইরানে। সেখানে তিনি রচনা করেছিলেন,

    'ইরান, তোমার সম্মান মালে

    নব গৌরব বহি নিজ ভালে

    সার্থক হলো কবির জন্মদিন।'

    ১৩৪২ সালে কবির ৭৪তম জন্মদিবস পালিত হয়। এ দিবসে পাওয়া যায় তাঁর নতুন উপলব্ধিজীবন ও জগৎ এবং মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি । কবি রচনা করেন 'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে।' কবিতাটি উৎসর্গ করেন, অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে-

    'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে

    জন্মদিনের ধারাকে বহন করে

    মৃতু্য দিনের দিকে।

    সেই চলতি আসনের উপর বসে

    কোন কারিগর গাঁথছে মালা

    ছোটো ছোটো জন্ম মৃতু্যর সীমানায়

    নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।'

    ১৩৪৪ সালে কবির ৭৭তম জন্মদিবস পালিত হয় আলমোড়ায়। জন্মদিনের তিনদিন আগেই কবি 'জন্মদিন' নামে কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৩৪৫ সনে কবির ৭৮ তম জন্মজয়নত্মিতে তাঁর কবিতা যুদ্ধবিরোধী চেতনায় মুখর হয়েছিলো। একদিকে কি অমানুষিক স্পর্ধা আর একদিকে কি অমানুষিক কাপুরম্নষতা। তিনি কালিম্পং থেকে বেতারে পড়ে শোনান সেঁজুতির 'জন্মদিন' কবিতাটি-

    'আজ মম জন্মদিন।

    জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোহে বসিয়াছে,

    দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবন প্রান্তে মম,

    ... হে মানুষ, হে ধরণী-

    তোমার আশ্রয় ছেড়ে যাবে যবে, নিও তুমি গনি

    কবির ৭৯তম জন্মোৎসব পালিত হয় পুরীতে। সেখানে সরকারীভাবে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দেন, কবিতা পাঠ করেন। তিনি রচনা করেন, 'নবজাতকের' 'জন্মদিন' কবিতা- 'তোমরা যাকে রবীন্দ্রনাথ বলে জানো সে আমি নই'।

    ১৩৪৭ সালের ২৫শে বৈশাখে কবি মংপুতে ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর অতিথি হিসেবে।কবির আশিতম জন্মজয়ন্তিতে তিনে লিখেন, 'জন্মদিনে' কাব্য-

    'সেদিন আমার জন্মদিন।

    প্রভাতের প্রণাম লইয়া

    উদয় দিগন্ত পানে মেলিলাম আঁখি।'

    এ জন্মোৎসব যেমন কবির জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব, তেমনি সভ্যতার সংকটও কবির শেষ অভিভাষণ। পহেলা বৈশাখ শানত্মিনিকেতনে জন্মদিনের উৎসবে লেখা। ভাষণের শেষদিকে কবি বলেছিলেন, 'আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যতা লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববানী নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে বসে শোনাবে এই পূর্বদিগনত্ম থেকে। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি, পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো। আশা করবো, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অত্মহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।'

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close