• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘যৌনতা শুধু গর্ভবতী হওয়ার জন্যই প্রয়োজনীয় মনে করা হতো’

প্রকাশ:  ১৬ মে ২০১৮, ১৮:০২
তসলিমা নাসরিন

এমন ধর্ম কমই আছে, যে ধর্ম মেয়েদের ঋতুস্রাবকে অপবিত্র বলেনি, আর ঋতুস্রাবের কারণে মেয়েদের অশুচি বলেনি। হিন্দুরা তো রজঃস্রাবের সময় বাড়ি থেকে বের করে দিত মেয়েদের। বাড়ির বাইরেই থাকতে হতো সাত দিন। কাউকে স্পর্শ করার অধিকার তাদের ছিল না। যাকে স্পর্শ করবে, তারই নাকি অমঙ্গল হবে। অচ্ছ্যুতের মতো জীবন তাদের যাপন করতে হতো। মুখ লুকিয়ে রাখতে হতো পাপীর মতো, অপরাধীর মতো।

খ্রিস্টানরাও রজঃস্রাব হলে মেয়েদের অপবিত্র বলতো। বলতো, যে লোক স্পর্শ করবে রজঃস্রাবরত মেয়েকে, স্পর্শ করবে সেই মেয়ের বিছানা বালিশ—সে নিশ্চিতই অপবিত্র করবে নিজেকে। অষ্টম দিনের দিন ঋতুস্রাব শেষ হলে দুটো পায়রা নিয়ে মেয়েদের যেতে হতো ধর্মযাজকের কাছে, পায়রা দুটোকে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করলেই তবে মেয়েদের নোংরা, অশুদ্ধা, অপবিত্র অবস্থা ঘুচতো। এরকমই বিশ্বাস ছিল মানুষের।

খ্রিস্টানরা একসময় এও বলতো, ইভ স্বর্গে বসে ঈশ্বরের বারণ সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন, ঈশ্বর সে কারণে ইভকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি সন্তান বহনের যন্ত্রণা দেব, তোমাকে দেব অবর্ণনীয় প্রসবযন্ত্রণা’। বাইবেলের বুক অব জেনেসিসের তিন নম্বর অধ্যায়ে লেখা আছে এই অভিশাপের কথা। যেহেতু প্রজননের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ঋতুস্রাব জড়িত। সে কারণে ঋতুস্রাবকেও অভিশপ্ত বলে বিশ্বাস করতো অনেক খ্রিস্টান। যেন এক ইভের পাপের বা ভুলের ফল ভোগ করতে হবে জগতের সকল নারীকে!

ধীরে ধীরে যত সভ্য হয়েছে ক্যাথলিক সমাজ, ঋতুস্রাবরত মেয়েদের ওপর থেকে গির্জাগুলো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ঋতুস্রাবকে এখন আর ঈশ্বরের অভিশাপ বলে মনে করা হয় না। তবে পৃথিবী তো পুরোটাই সভ্য হয়ে যায়নি। এখনও এখানে ওখানে কুসংস্কার পালন করতে দেখা যায়। এখনও নারীবিরোধী কট্টরপন্থাকে জিইয়ে রেখেছে কেউ কেউ। রাশিয়ার অর্থডক্স গির্জায় মেয়েদের আসায় বারণ নেই, তবে যীশুর মূর্তিতে চুম্বন করায়, আর ধর্মযাজকের সঙ্গে কথোপকথনে বারণ আছে। আশা করি এই অনাচার একদিন ঘুচবে।

ঋতুস্রাবের সময় ইহুদি মেয়েদের যৌন সম্পর্ক করা নিষেধ ছিল। শুধু যৌন সম্পর্ক নয়, স্বামীকে স্পর্শ করা, আলিঙ্গন করা, চুম্বন করা সবই ছিল নিষিদ্ধ। ঋতুস্রাবের পাঁচ দিন পর্যন্ত তো ছিলই, ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার পর সাত দিন পর্যন্তও সবকিছু নিষিদ্ধ ছিল। এই সব নিষেধাজ্ঞার পর প্রাকৃতিক জল রাখা কোনও চৌবাচ্চায়, যার নাম মিকভা, নিজেকে ডোবাতে হতো, তবেই শুদ্ধ হতো মেয়েরা। শুদ্ধ হওয়ার পর আবার স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যেতে পারতো। তখন গর্ভবতী হওয়ার জন্য মোক্ষম সময়। যৌনতাকে শুধু গর্ভবতী হওয়ার জন্যই প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হতো।

ইহুদিরা আজকাল ঋতুস্রাবের কুসংস্কার আর পালন করে না। তারা মিকভা ব্যবহার করে অন্য কাজে। এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাওয়ার সন্ধিক্ষণে। যেমন, ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে যাওয়ার সময়। প্রাচীনকালে হিন্দুরাও একসময় দুধের চৌবাচ্চায় স্নান করে ঋতুস্রাব হওয়া শরীরের ‘অপবিত্রতা’ দূর করতো।

আইভরি কোস্টে এব্রি নামে এক সম্প্রদায় আছে, ওরা বিশ্বাস করতো পাপ করলে ছেলেদের উত্থানরহিত হয়, আর মেয়েদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়। ঋতুস্রাবের পক্ষে আইভরি কোস্টেই আছে খানিকটা ইতিবাচক ব্যাখ্যা। শাস্তি হিসেবে মেয়েরা ঋতুস্রাব পাচ্ছে না, বরং ঋতুস্রাব হারাচ্ছে।

ঋতুস্রাব নিয়ে আগেকার সেই কুসংস্কার সব সমাজেই দূর হয়েছে। এখন ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দুরা ঋতুস্রাবকে অপবিত্র, অশুচি, অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক, অলৌকিক, কদাকার, কুিসত, কুকর্মের-ফল হিসেবে দেখে না। অধিকাংশ মানুষই দিন দিন সভ্য এবং আধুনিক হচ্ছে, তারা জানে ঋতুস্রাব স্বাভাবিক একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। এটি কোনও অসুখ বিসুখ নয়। কিন্তু তারপরও কেন ঋতুস্রাবের কথা গোপন রাখে মেয়েরা? কেন আড্ডায় আলোচনায় ঋতুস্রাব প্রসংগে কথা বলতে মেয়েরা লজ্জা বোধ করে? তবে কি ঋতুস্রাবের সঙ্গে অশুদ্ধতাকে যে জড়ানো হয়েছিল দীর্ঘকাল, সেটির রেশ এখনও রয়ে গেছে বলেই দ্বিধা? মেয়েদের না হয়ে পুরুষের যদি ঋতুস্রাব হতো, তাহলে তো পুরুষেরা তাদের ঋতুস্রাবের দিনগুলো মহাসমারোহে পালন করতো! তারা তো নিজেদের প্রাকৃতিক ঘটনায় লজ্জাবোধ করতো না, বরং গর্ববোধ করতো! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম কানুন তো পুরুষেরই তৈরি।

ঋতুস্রাব এতই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া যে পশ্চিম দুনিয়ার বেশ কিছু মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কোনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবে না, কোনও ট্যাম্পন ব্যবহার করবে না। তারা ঋতুস্রাবের রক্তকে মুক্ত করে দেবে, রক্তপাত ঘটতে দেবে, পাজামা প্যান্টালুনকে রঙিন হতে দেবে। ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়াকে নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাওয়া অনেক হয়েছে, আর নয়। ঋতুস্রাবের রক্তপাতকে অসুন্দর নয়, বরং মেয়েরা বলছে সুন্দর। সুন্দর বলেই এটিকে আর লুকোনো নয়, এটিকে প্রকাশিত হতে দিতে চাইছে তারা। হারভার্ডে পড়া মেয়ে কিরণ গান্ধী তাঁর পিরিয়ডের সময় লন্ডন-ম্যারাথনে দৌড়েছেন কোনও প্যাড ব্যবহার না করে।

কেউ কেউ বলছে, রক্তকে বইতে দিলে অস্বস্তি হয়, ঊরুসন্ধি ভেজা ভেজা ঠেকে, তারা প্যাডের বদলে একধরনের কাপ ব্যবহার করছে, যেখানে স্রাবের রক্ত জমা হয়। তবে অনেকেই বাজারের প্যাড ব্যবহার করছে না, কারণ ওসব প্যাড পরিবেশের ক্ষতি করে, যেহেতু ওসব মাটির সঙ্গে মেশে না।

শিক্ষিত সভ্য মানুষের মধ্যে রজঃস্রাব কোনও লুকোনো ব্যাপার নয়। রজঃস্রাব নিয়ে লজ্জা পাওয়ার দিন শেষ। কারণ রজঃস্রাব, বিজ্ঞান যারা সামান্য জানে, জানে যে এটি শ্বাস প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক। শ্বাস প্রশ্বাস আমরা কি গোপন করি? মেয়ে বলেই নানা রকম মেয়ে-বিরোধী কুসংস্কার এনে এতকাল অপদস্থ করা হয়েছে মেয়েদের।

আমরা মহাশূন্যে যান পাঠিয়েছি। মঙ্গলগ্রহে নেমেছে মানুষ নির্মিত যন্ত্র। মানুষ একদিন অন্য কোনও সৌরজগতে, অন্য কোনও গ্রহে পাড়ি দেবে। এই সময় আমাদের কি এত হাজার বছর পেছনে পড়ে থাকা মানায়?

কিছু মেয়ে আজকাল বলছে তাদের কেন ঋতুস্রাবের সময় ধর্ম পালন করার অধিকার থাকবে না? দুনিয়ার সব ডাক্তার বৈদ্য ঘোষণা করে দিয়েছে ঋতুস্রাব কোনও ব্যাধি নয়, সংক্রামক কিছু নয়, এ নিতান্তই প্রজননের জন্য জরুরি শারীরিক প্রক্রিয়া। তাহলে আজও এই বিজ্ঞানের যুগে, এই তথ্য এবং প্রযুক্তির যুগে, এই একবিংশ শতাব্দীতে রজঃস্রাব হচ্ছে বলে একটি মেয়েকে সকল শুভকাজ থেকে সরে থাকতে বলা হয়। এটা নিশ্চয়ই অন্যায় কাজ! আমি নিশ্চিত, পুরুষের যদি রজঃস্রাব হতো, তাহলে তাদের সব শুভকাজ থেকে বা ধর্মীয় আচারাদি থেকে সরিয়ে রাখা হতো না। তখন রজঃস্রাবের অর্থ করা হতো কল্যাণকর। মেয়েদের হয় বলেই রজঃস্রাবকে অকল্যাণকর ভাবছে নিতান্তই নারীবিরোধী একটি গোষ্ঠী।

খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, শিনতো ধর্ম, জরোয়াস্ত্রীয় ধর্ম ঋতুস্রাবের সময় মেয়েদের ধর্ম কর্ম থেকে দূরে থাকতে বলেছে। কিন্তু এও ঠিক, পৃথিবী থেকে পুরনো ধারণা এবং বিশ্বাস বিদেয় হচ্ছে। তবে আজও কোনও কোনও সমাজে রজঃস্রাব নিয়ে ভুল বিশ্বাসকে আঁকড়ে রাখা হচ্ছে? মেয়েরা যদি চায় রজঃস্রাবের সময় ধর্মীয় আচারাদি পালনে আপত্তি করা উচিত নয়। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন সব ধর্মেই হয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম সমাজে তিন তালাক নেই, চার বিয়ের রেওয়াজ নেই, ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা নেই, চুরি করলে হাত কেটে ফেলা নেই, অপরাধ করলে জনসমক্ষে শিরশ্ছেদের ঘটনা নেই, ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে চার পুরুষ-সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়ার অধিকার আছে, লেখাপড়া শেখার, চাকরি বাকরি করার অধিকার আছে, নেত্রী হওয়ার অধিকার আছে, কোথাও কোথাও মসজিদে যাওয়ার, এমনকী জানাজা পড়ার, এমনকী কোথাও কোথাও নামাজের ইমামতি করারও অধিকার আছে, বোরখা হিজাব না পরে চলাফেরার অধিকার আছে, একা একা ভ্রমণ করার অধিকার আছে। ধীরে হলেও সমাজ বদলাচ্ছে। ধর্ম-বিশ্বাস অক্ষত রেখেও সমাজকে আধুনিক করা যায়।

মেয়েদের প্রাকৃতিক শারীরিক অবস্থার জন্য ধর্ম কর্ম করার অধিকার হারাবে তা মানা যায় না। পেচ্ছাব পায়খানার পর, বায়ু নির্গত হওয়ার পর পরিচ্ছন্ন হয়েই যদি উপাসনা করা যায়, তবে মেয়েদের জন্য কেন রজঃস্রাবের সময় কোনও উপায় থাকবে না ধর্ম কর্ম করার? এখনও কি সময় হয়নি নারীবিরোধী কুসংস্কারগুলোকে বিদেয় করে মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার?

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

-একে

যৌনতা,তসলিমা নাসরিন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close