• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বসন্তকালীন মিটিং ও কিছু অম্লমধুর স্মৃতি

প্রকাশ:  ২২ মে ২০১৮, ০১:৫৭
শামীমা দোলা

১৮ এপ্রিল ২০১৮ সকাল পৌনে নটা! এমিরেটস এর বিমানে চড়ে ওয়াশিংটন ডিসির ডালাস এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। মার্কিন মুল্লুকে এটি আমার তৃতীয় সফর। এর আগে দু’বার ২০১৫ আর ২০১৬-তে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলাম। আর এবারে এসেছি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে সাংবাদিক সফর সঙ্গী হয়ে আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বসন্তকালীন মিটিং-এ। টানা ১৮ ঘন্টার জার্নি, ক্লান্তি জমে আছে শরীরে, মনে। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাইরে এসে দেখলাম বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি থেকে আমাদের রিসিভ করতে চার/পাঁচটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। আমাদের সাথে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স মিনিস্ট্রির অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব সহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন। নির্ধারিত গাড়িতে চেপে চলে গেলেন তারা তাদের গন্তব্যে। আমি আর ‘দেশ টিভি’র প্রতিবেদক ঝর্ণা আরেকটি গাড়িতে করে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যে। মোটামুটি ঝকঝকে আকাশ, কিন্তু বাতাস বেশ কিছুটা ঠান্ডাই ছিল।

গাড়ির জানালা দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির মনোরম প্রকৃতি দেখছিলাম। যেন চারদিকের গাছ পালা, পথ ঘাট কিছুক্ষণ আগেই ধোয়া মোছা করা হয়েছে। পথের ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। একটু পর পর চোখে পরছিল চেরি ফুল ফুটে থাকা গাছ গুলো। জানলাম সপ্তাহ খানের আগেই চেরী ব্লুজম উৎসব হয়েছে ওয়াশিংটন ডিসিতে।

সম্পর্কিত খবর

    মনে মনে আফসোস হল আহা কি মিস করলাম, এক সপ্তাহ আগেই যদি আসতাম! যেতে যেতেই চোখে পরল প্যান্টাগন টাওয়ার। নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল, হায়, মানুষ চাইলে কত সহজেই দিয়াশলাই বাক্সের মত দুমড়ে, মুচড়ে ভেঙ্গে দিতে পারে সব। কত গর্দভ আবার এসব ধংসাত্বক কার্যকলাপ নিয়ে গর্বও করে!

    ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ছিল আমাদের ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রদুতের বাসায় নৈশভোজের নিমন্ত্রণ। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী মহোদয় সস্ত্রীক যোগ দিলেন। রাষ্ট্রদুত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমদ আর তার স্ত্রীর আন্তরিক আপ্যায়ন, অমায়িক ব্যবহারে আমি যারপর নাই মুগ্ধ। খুব সাবলীল আর আন্তরিক ছিলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী, তার স্ত্রী আর মেয়ে।

    রাষ্ট্রদুতের স্ত্রী খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। এই মানুষটি কি কারণে যেন খুব পছন্দ করে ফেলেছেন আমাকে!! দারুন মমতায় কাছে বসিয়ে গল্প করেন, খোঁজ নেন এটা, সেটা!! কি দরকার, কোন সমস্যা আছে কি না! কিছু দরকার হলে যেন বলি! আবার যদি আসি ডিসিতে তাকে যেন ফোন করি, গাড়ি লাগলে যেন বলি!!

    ১৯ এপ্রিল সকালে আমি আর ঝর্না ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে গিয়ে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড করে নিলাম। তারপর যোগ দিলাম ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রেসিডেন্ট এর প্রেস ব্রিফিং এ। জানালেন বিশ্ব অর্থনীতির নানা দিক, আর তাদের পরিকল্পনার কথা। চলতি বছরে তিন ছাড়িয়ে যাবার কথা জানালেন। সেই নিউজ এডিট করে, স্ক্রিপ্ট লিখে ভয়েজ দিয়ে কাজ শেষ হতে রাত দুইটা, আড়াইটা! সকালে উঠেই গেলাম বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের কার্যালয়ে। সেখানে আমাদের অর্থমন্ত্রী একের পর এক বৈঠক করছেন। আমাদের অন্যান্য সহকর্মী চ্যানেল আই টিভি-এর বিশেষ প্রতিনিধি রিজভী নেওয়াজ, টুয়েন্টি ফোর টিভি-এর প্রতিনিধি মজুমদার বাবুসহ দৈনিক সমকালের আবু কাওসার ভাই ছিলেন। রিজভী ভাই আর বাবু’র সহযোগিতার কথা না বললেই না। সবাই মিলে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেছি।

    রাত জেগে নিউজ দিয়ে আবার ভোরে ছুট। অর্থমন্ত্রী দাতা সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সাথে একাধিক বৈঠক করে আবার আমাদের ব্রিফ করেছেন। বললেন আগামী এক, দুই বছরেই আমাদের ঋণ পেতে বেশি সুদ গুনতে হবে। কারণ আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হবার পথে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, আমাদের ইমেজ বাড়ছে, সে সাথে আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে আমাদের উপর। বসন্তকালীন বৈঠকের একটি বড় অর্জন সুইডেন, ডেনমার্কসহ ১০ টি দেশ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে অর্থ সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি। অর্থমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যু তাদের সামনে তুলে ধরেছেন, স্থায়ী সমাধানে মায়ানমারকে চাপ দেবার কথা বলেছেন। তার প্রেক্ষিতে এই সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সুইডেন ১৭ মিলিয়ন ডলার দেবার কথা বললেও অন্য দেশগুলো সহায়তার পরিমান ঘোষণা দেন নি। তবে অর্থমন্ত্রী আমাদের কাছে ব্যক্তিগত ধারনায় বলেন, রোহিঙ্গাদের আর তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া হবে না। যতদিন মায়ানমারে সামরিক জান্তা থাকবে। এরই মাঝে কি কারণে আমার স্টমাক আপসেট। সকালে কাজ রাতে ইকোনোমিক মিনিস্টার, বিকল্প ইডি মোশাররফ স্যারের বাসায় ডিনার। এই করেই ২২ এপ্রিল পর্যন্ত পার করেছি।

    ২২ এপ্রিলের পর আমি একদম বিছানায় পরে গেলাম। অর্থমন্ত্রী ফিরে গেলেন নিউইয়র্কে। আমরা রয়ে গেলাম ডিসিতে। এদিকে ঝর্নার ফিরে যাবার তাড়া। তার শপিং, বেড়ানো সব কিছু বাকি। আর আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। প্রেস মিনিস্টার, আমাদের ঢাকার এক সময়ের জাদরেল সাংবাদিক প্রিয় বড় ভাই শামীম ভাই ওষুধ পথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন। আমি কিছুটা সুস্থ্য হলাম। শামীম ভাই-এর সহযোগিতা না পেলে আমাদের দু’জনের জন্যে বেশ কঠিন হতো ডিসিতে থাকা, কাজ করা। পুরোটা সময় খোঁজ নিয়েছেন। তার গাড়ি দিয়ে রেখেছেন। আমরা ২৫ এপ্রিল ফিরলাম নিউইয়র্কে। ঝর্না ফিরে গেল ঢাকায়। আমি আরো কয়েক দিন থেকে গেলাম।

    নিউইয়র্কের কুইন্স ভিলেজে সোহেল ভাই, শান্তা আপার বাসায় তিনটি দিন দারুন সময়গুলো কিভাবে যে ফুরুত করে শেষ হয়ে গেল। তাদের ভীষণ ব্যস্ত সময় থেকেও আমার বাড়তি অত্যাচার তারা আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছেন। নিউইয়র্কের বাই ল্যাঙ্গয়েল টিভি টাইম টেলিভিশনে কেটেছে দারুন কিছু সময়। এরই এক ফাঁকে টাইম টেলিভিশনের সংবাদ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘প্রেস ভিউ’-তেও অংশ নেয়ার সুযোগ হলো।

    পাদটিকায় বলি, আমি যতবার আমেরিকায় আসি, নতুন নতুন ভাবে প্রেমে পরি!! আমরা সব সময় বলি আমেরিকানরা খুব ইনডিভিজুয়াল, সেলফিশ! কিন্তু আমার মনে হয় আমরাই বেশি সেলফিশ আর ইনডিভিজুয়াল। নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শপিং-এ গিয়ে তাল গোল পাচ্ছিলাম না, কিচ্ছু বুঝতেছিলাম না, গায়ানার অচেনা এক মেয়ে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেনাকাটায় হেল্প করল! স্বভাবসুলভ ভুলোমনা আমি আমার ব্লেজার একটি দোকানে ফেলে চলে আসছিলাম, ওই মেয়ে দৌড়ে এসে ব্লেজার দিয়ে গেল! যাবার সময় কথা দিয়ে গেল পরের দিন আমাকে জেসিপেনিতে নিয়ে যাবে।

    বাসায় ফেরার জন্যে বাসে উঠলাম, কিন্তু সাথে টিকেট নেই। গায়ানার আরেক ভদ্রলোক ভাড়া দিয়ে দিলো! শুধু তাই না, বাসের ড্রাইভারকে বার বার বলে গেল আমাকে যেন ঠিকঠাক নামিয়ে দেয়! বাস থেকে নেমে বাসা খুজে পাচ্ছি না, এক ইন্ডিয়ান শিখ বলল, তোমার বাসাটা বেশ দূরে, হেঁটে যেতে সময় লাগবে! চলো আমার বাসার সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে আসি, তোমাকে নামিয়ে দিব। আমিতো ভয়ে ভদ্রতার মাথা খেয়ে বললাম, লাগবে না! পরে আবার উঠলাম, লোকটা ড্রাইভ করে পৌছে দিল! এই সময়টুকু ভয়েতো আমার দম বন্ধ! আমেরিকানদের আরেকটা বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছে, ওরা প্রশংসা করতে খুব অকপট! আমি লং স্কার্ট পরে ডিসিতে একটা মলে হাটছি, এক মহিলা আমাকে খুব ডাকছে, ফিরে তাকাতেই হেসে বলল, ইউ লুক সো বিউটিফুল, ইওর স্কার্ট ইজ সো নাইস, আই লাইক ইট!! তার আগে আরেকদিন সাদা জামা পরে অ্যাম্বাসাডারের বাসায় দাওয়াত খেয়ে ফিরছি। লিফটে দুই ভদ্রমহিলা সবার সামনেই বলল- ‘ওয়াও, ইউ লুক সো বিউটিফুল!’ আমরাও অকপট, সেটা অন্যকে ডাউন করতে! অম্ল, মধুর সব অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে তৃতীয়বারের মার্কিন মুল্লুক ভ্রমণ শেষ করে ফিরতে হচ্ছে নিজ ভুমিতে। প্রিয় মাতৃভুমিতে, যেখানে আমার ফিরে যাবার পথ চেয়ে আছেন আমার মা, আমার স্বজনেরা। বিদায় নিউইয়র্ক, বিদায় যুক্তরাষ্ট্র।

    (লেখিকা :একাত্তুর টিভি’র সিনিয়র রিপোর্টর)

    ওয়ার্ল্ড ব্যাংক
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close