• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

১৫ আগস্ট আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা

প্রকাশ:  ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪১
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বাঙালি জাতির জন্য কলঙ্কিত মাস আগস্ট। মাসের তো কোনো দোষ নেই। এটিকে কলঙ্কিত করেছে এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার, বিশ্বাসঘাতক। আবার এর বিপরীতে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বর, এ তিনটি মাস আমাদের জন্য গৌরবের। এ গৌরব যারা বয়ে এনেছেন তারা আমাদের গর্ব ও অহংকার। আর ওরা হচ্ছে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য। কী উদ্দেশ্যে এবং কারা এ মাসটিকে কলঙ্কিত করেছে তা এখন সবাই কমবেশি জানেন। তবে আজ বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে উন্নত শিরে বলতে পারি ওই বিশ্বাসঘাতকদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তারা শুধু ব্যর্থ নয়, চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীগত একটা শক্তি আছে, যেটি তারা তৈরি করতে পেরেছে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে।

রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব সেক্টরে যেমন, সুশীল সমাজ, মিডিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিক্ষাঙ্গন, সর্বত্রই তাদের পক্ষে প্রবল শক্তিশালী একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে। এসব সুবিধাভোগী বহুমুখী ছদ্মবেশে তাদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রাখতে চায় যারা এ আগস্ট মাসটিকে কলঙ্কিত করেছে। খেয়াল করলে দেখবেন, কিছু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাহ্যিকভাবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যথেষ্ট সম্মান দেখায়, বিরূপ কোনো মন্তব্য করে না। কিন্তু এদের সব কার্যকলাপ ও কথাবার্তা সবই ওই গোষ্ঠীর পক্ষে যায়, যারা বা যে গোষ্ঠীর পূর্বসূরিরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। এদের মধ্যে দুয়েকজন, যারা বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ ও অনুগ্রহ না পেলে আজকে যেখানে এসেছেন সেখানে আসতে পারতেন না, তারা বা তিনিও এখন বঙ্গবন্ধুর খুনির উত্তরসূরিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে দ্বিধা করছেন না। একেই বলে স্বার্থান্ধতা, প্রতিহিংসা, ব্যক্তিবিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতার চরম উদাহরণ।

সম্পর্কিত খবর

    এটা তো এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং দালিলিকভাবে প্রমাণিত, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তারা শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি বা সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। তারা বাংলাদেশকেই হত্যা করার চেষ্টা করেছে, যে বাংলাদেশ আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রাম করে এবং একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এন্থনি মাসকারেহ্যাসের লেখা, বাংলাদেশ এ লেগেসি ব্লাড গ্রন্থ এবং বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি কর্নেল রশীদের সাক্ষাৎকারের বক্তব্য থেকে জানা যায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার কথা বহু আগে থেকেই জানতেন।

    লেখকের ছবিছবি: লেখক

    জিয়াউর রহমান সরাসরি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেননি। কিন্তু তিনি তখন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে এতবড় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের কথা জানা সত্ত্বেও তা প্রতিহত করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাটাই তো প্রমাণ করে তিনি হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ও সমর্থক। ২০০৯ সালের শেষের দিকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের ফাঁসির দণ্ড যখন আপিল বিভাগ নিশ্চিত করে দেয় এবং দণ্ড জেলের ভিতরে কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় তখন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গোপনে ধারণকৃত পলাতক আসামি কর্নেল রশিদের সাক্ষাতের ধারাবাহিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সাক্ষাৎকারের একটি পর্ব প্রচারের পর মানুষের প্রতিবাদের মুখে চ্যানেলটি তখন সাক্ষাৎকারের বাকি পর্বগুলো আর প্রচার করতে পারেনি। আলোচ্য সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও তা প্রচারের পেছনে ওই চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কী উদ্দেশ্য ছিল সেটি জানা না গেলেও ওই মুহূর্তে যখন অন্য খুনিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় তখন আত্মস্বীকৃত একজন খুনিকে নিজের সাফাই এবং কৃতকর্মের সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। উল্লিখিত চ্যানেলটি এখন সরকারের অশেষ কৃপাদৃষ্টিতে আছে।

    এ কথাটি এখানে উল্লেখ করলাম যে কারণে তাহলো, সাক্ষাৎকারের সব পর্ব পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করলে জানা যাবে ওই গোপন সাক্ষাৎকার কোথায় বসে ধারণ করা হয়েছে এবং তার পেছনে ওই চ্যানেলের উদ্দেশ্য কী ছিল। একই সঙ্গে ছদ্মবেশ ধারণকারী কিছু ব্যক্তির মুখোশ উন্মোচিত হবে। যে চ্যানেলটি গোপনে পলাতক খুনির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং অন্য খুনিদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করার আগ মুহূর্তে তা প্রচার করার চেষ্টা করে সেই চ্যানেলেটি কী করে আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কৃপাধন্য হতে পারে। ষড়যন্ত্র যে কত দিক থেকে হতে পারে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পথ ধরে স্বল্প দিনের মাথায় রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি এক সময়ে একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাপ্রধান হলেন। লেখার শুরুতে যে কথাটি বলেছি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে হত্যা করা। নামে নয়, একটা রাষ্ট্রের পরিচয় পাওয়া যায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা পাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে। সেটাই আসল বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলনসংবলিত সব শব্দ, বাক্য ও অনুচ্ছেদ সামরিক আইনের ঘোষণার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে বাতিল করে দিলেন।

    বাহাত্তরের মূল সংবিধান আর পরবর্তীতে পঞ্চম সংশোধনীর পর ছাপা হওয়া সংবিধানের কপি পাশাপাশি রেখে পৃষ্ঠা ধরে ধরে মিলিয়ে দেখলে যে কেউ উপরোক্ত কথার সত্যতা পাবেন। ১৯৭৫ সালের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যে বাংলাদেশ পেলাম সেটিকে আর যা-ই হোক আসল বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলা চলে না। পাকিস্তানের সঙ্গে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। সুতরাং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশকে হত্যা প্রচেষ্টার মাস। সেই থেকে আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য কলঙ্কিত মাস হয়ে আছে। কিন্তু এতবড় কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ বসে থাকতে পারে না, বসে নেই। ১৯৮১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আসল বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলছে। কিন্তু সেই পথেও প্রবল বাধা আসছে একের পর এক। এক আগস্ট মাসে আবার সব শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত পুলিশের সামনে একটা জনসমাবেশে আওয়ামী লীগের সব সিনিয়র নেতাসহ শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড আক্রমণ চালানো হয়। তাতে নিহত হলেন ২৪ জন। আগস্ট মাস আবার কলঙ্কিত হলো। এবারের এ কলঙ্কের কাজটি কারা করলেন। এ বিষয়ের ওপর মামলাটি বিচারাধীন বিধায় চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

    তবে অকাট্য প্রমাণাদিসহ অভিযুক্ত হয়েছেন ওই সময়ে ক্ষমতায় থাকা জামায়াত-বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীসহ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তখন এটিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জজ মিয়া নাটক কেন সাজিয়েছিলেন তার কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় তাদের প্রতি মানুষের সন্দেহ প্রবল। ২১ আগস্ট যেভাবে গ্রেনেড আক্রমণটি হয়, যে পরিস্থিতিতে হয় এবং ঘটনার অব্যবহিত পর তখনকার ক্ষমতায় থাকা জামায়াত-বিএনপি সরকারের কার্যকলাপগুলো নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, ঠিক একই উদ্দেশ্যে সেদিন হত্যা করার চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। সুতরাং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা।

    ২০১৮ সালে এসে এই আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আরেকটি ষড়যন্ত্রের স্বরূপ আমরা দেখলাম। সারা বিশ্বজুড়েই দেখা যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভিতরে বহুমুখী শক্তিশালী পক্ষের সৃষ্টি হয়, যারা কখনো কখনো নিজেদের শ্রেণিগত হীন স্বার্থকে রক্ষার জন্য বৃহত্তর জনকল্যাণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকারকেও চ্যালেঞ্জ করে বসে। এদের বলা হয় রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র। তাদের চাপে সরকার অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় জনগণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ওইরকম জনকল্যাণমূলক ইস্যুর পক্ষে বিশাল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে সরকারের জন্য অনেক সুবিধা হয়। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কোমলমতি স্কুলের ছাত্ররা সড়ক পরিবহন খাতে বহুদিনের পুঞ্জীভূত সীমাহীন বিশৃঙ্খলা দূরীকরণের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিল। এতদিন পরিবহন খাতের স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর চাপে বিগত দিনসহ কোনো সরকারের পক্ষেই একা আলোচ্য বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সে কারণেই আমরা দেখলাম সরকার প্রধানসহ সবাই ছাত্রদের এই আন্দোলন ও দাবির প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রদান করেন। কিন্তু দেখা গেল পঁচাত্তর ও ২০০৪ সালের আগস্টে যে রাজনৈতিক অপশক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তারাই এই সুযোগে সরকার উত্খাতের মিশন নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ফেলার চেষ্টায় নেমে পড়ল। সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরির জন্য সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যাচার ছড়িয়ে গুজব রটনা করে উসকানি প্রদান করতে থাকল। কোমলমতি ছাত্রদের মহৎ উদ্দেশ্যকে এ ষড়যন্ত্রকারীরা পিছন থেকে ছুরি মেরে কলঙ্কিত করল। আগস্ট মাসটি আরও একবার কলঙ্কিত হলো। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

    [email protected]

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close