• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

শুভ জন্মাষ্টমী: জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রকাশ:  ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:১৪
ডা. সুব্রত ঘোষ

আজ শুভ জন্মাষ্টমী। সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময় একটি দিন। হিন্দু শাস্ত্রমতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মানব রূপে মর্তে আবির্ভাব ঘটে। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে এ দিনে এক বৈরী সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে নিরাকার ব্রহ্ম বাসুদেব ও দেবকীর সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে ওই সময়টাতে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিল। মথুরার রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে উৎখাত করে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেছিল। একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিল জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপালসহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ নাকি একাই ৮৬ জন যুব রাজাকে বলি দেয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিল। এছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দুর্যোধন-দুঃশাসন। মহাভারতে কাহিনীতে বর্ণিত দুঃশাসন কর্তৃক সভাসমক্ষে কুলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সৎ-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এভাবেই তখন পাপের রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদতো। এহেন অধর্ম-অবিচার নির্মূল করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্তেই শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবানের মর্তে আগমন। তাই শ্রীকৃষ্ণ মর্তে এসে একে একে কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও কৌরবদের দর্পচূর্ণ করে, তাদের পাপসৌধ ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপন করলেন।

ওই অত্যাচারী রাজাদের মধ্যে একজন কংসরাজের বোন দেবকীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। দেবকীর অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে এ দৈববাণী জেনে কংস দেবকী ও তার স্বামী বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করে। একে একে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তার হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে ও সন্তানদের হত্যা করে। সপ্তম সন্তানের বেলায় দেবকীর গর্ভ স্থানান্তরিত হয় রোহিনীর গর্ভে। আর অষ্টম সন্তানরূপে জন্ম হয় শ্রীকৃষ্ণের। তাকে কংসের হাতে না দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর কথামতো কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাতে ঝড়বৃষ্টিতে সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে রেখে আসেন আরেক সদ্যমাতা যশোদার পাশে আর তার কন্যাকে নিয়ে ফিরে আসেন কারাগারে। কংসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান না পেলেও হাল ছাড়ে না। কংসরাজ তখন ছয় মাস পর্যন্ত বয়সের সব শিশুকে হত্যা করার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠায়। পুতনা রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখিয়ে বিষমাখা স্তন্য পান করানোর ছলে শিশুদের হত্যা করে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে পুতনা রাক্ষসী মারতে পারে না, বরং স্তন্যপানকালে ঘাতক পুতনাই মারা যায়। শৈশব থেকেই মনুষ্যশিশু শ্রীকৃষ্ণ এরকম একের পর এক অতিমানবিক ঘটনা ঘটাতে থাকেন, যা লীলা হিসেবে আখ্যাত। লীলাবলে ও লীলাচ্ছলেই শ্রীকৃষ্ণ ধ্বংস করেন কংসসহ অত্যাচারী রাজাদের। মর্তে শ্রীকৃষ্ণের ১২৫ বছরব্যাপী মনুষ্যরূপী লীলাসমূহকে সময়ানুসারে বৃন্দাবনলীলা (১ থেকে ১১ বছর), মথুরালীলা (১১ থেকে ২৩ বছর), দ্বারকালীলা (২৩ থেকে ১২৫ বছর) এ ভাগে ভাগ করেছেন শাস্ত্রকাররা।

বৈষ্ণব দর্শন বলে, রাধিকাসহ ব্রজগোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা আর জীবাত্মার মধ্যকার সম্পর্ক প্রতিভাত। প্রেমরূপের বিপরীতে গীতায় আমরা পাই কর্মযোগের উপদেশক শ্রীকৃষ্ণ। যার মুখে নিষ্কাম কর্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানে জীবসেবার বাণী। মহাভারতের আখ্যানে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের সারথী, রাজনীতির মন্ত্রক। শ্রীকৃষ্ণ একাধারে দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, অনাথের নাথ ও অগতির গতি। নররূপী নারায়ণ ও মঙ্গলময় ঈশ্বর। সমস্ত গুণের আধার। প্রতিটি লীলাই তার ভিন্ন ভিন্ন গুণের প্রকাশ। ভিন্ন ভিন্ন কর্মের ও লক্ষ্যের বাস্তবায়ন। লীলাচ্ছলেই শ্রীকৃষ্ণ সৎ ধর্মের, সৎ কর্মের, সদাচারের, সর্বোপরি প্রেমের বাণী প্রকাশ করেছেন। যা লোকশিক্ষা হিসেবে সর্বস্থানে সর্বকালেই প্রাসঙ্গিক। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের এ দিনটি- শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উদযাপন এবং এর মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কর্মের তাৎপর্য অনুধাবন তাই তাৎপর্যপূর্ণ।

অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশ্বাস করেন এ দিনে শুধু উপাবাসেও সপ্ত জন্মকৃত পাপ বিনষ্ট হয়। আর তাই এ দিনটিতে তারা উপবাস করে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে কালের স্রোতে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় মিছিল ও শোভাযাত্রা। ক্রমেই জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় মিছিল ও শোভাযাত্রা। এক সময় জন্মাষ্টমীর মিছিল ঢাকা শহরের ঐতিহ্যেরই অংশ ছিল তবে পাকিস্তান আমল থেকে সুদীর্ঘকাল এই মিছিল বন্ধ ছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে ছেদ পড়েছিল, সুখের বিষয় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আবার সেই ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। ধর্মীয় উৎসব হিসেবে জন্মাষ্টমী খুবই সাড়ম্বরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে হাজার প্রতিক‚লতার পরও। নিঃসন্দেহে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। জন্মাষ্টমীতে জাতীয় ছুটি পালনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে অনুক‚ল রাষ্ট্রীয় বাতাবরণেরই পরিচয় দেয়। এটা সত্যি যে, সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী উৎসব আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং বর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর থেকেই পিতার ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী উৎসব আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনে বিশেষ দৃষ্টি ও আনুক‚ল্য প্রদান করে যাচ্ছেন যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই অসাম্প্রদায়িক স্বপ্ন সাধের সোনার বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম, অর্পিত সম্পত্তি, শত্রু সম্পত্তি আইনের মতো কালাকানুনসহ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো বর্তমান। কথায় কথায় ঠুনকো অজুহাতে সারাদেশে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ও উপাসনালয়ের জমি দখল, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ধর্ষষ, পুরোহিত হত্যা ও জীবননাশের হুমকি প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম। আবার অজপাড়াগাঁয়ের কোনো মন্দির বা প্রতিমা ভাঙচুর এবং সংখালঘু গরিব কিশোরী মেয়েটার নির্যাতনের ঘটনা হয়তোবা জানতে পারেন না কেউই, থেকে যায় অন্তরালে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মানসিক, শারীরিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়তই নীরবে-নিভৃতে বা প্রকাশ্যেই। এগুলো দূর করতে সরকারের বিশেষ এবং আন্তরিক উদ্যোগ দরকার। আমরা আশা করব, আমাদের সব আশা-ভরসা আর নির্ভরতার প্রতীক এই রাষ্ট্র ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অধিকার সংরক্ষণে সর্বদা সজাগ ও আন্তরিক থাকবে। কলুষতা-হানাহানিমুক্ত, নির্লোভ, বীর্যময় মহাজীবন গঠনের যে শুভ সংবাদ নিয়ে জন্মাষ্টমী আমাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে, সর্বজনীনভাবে তাকে মননে, চিন্তায় ধারণ করে কর্মে প্রতিফলিত করতে পারার মধ্যেই রয়েছে এ দিনটি উদযাপনের সার্থকতা।

লেখকঃ ডা. সুব্রত ঘোষ : চিকিৎসক এবং সংগঠক।

জন্মাষ্টমী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close