• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

অন্তিম অভিবাদন, শাহ আজিজ ভাই!

প্রকাশ:  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:২৯ | আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৩৩
ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন

৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক সময়।সিলেটের শারদা হলে সর্বদলীয় সভা বসেছে। তৎকালীন সিলেটের রাজনীতিতে অভিবাবক্তুল্য অনেকেই সভায় উপস্থিত। বসে আছেন দেওয়ান ফরিদ গাজী, আব্দুল হামিদ, আব্দুন নুর মাস্টার সহ অনেকেই। সভা শুরু হওয়ার আগে খুশ গল্প চলছে। এসে ঢুকলেন শাহ আজিজুর রহমান। কাউকে কিছু না বলে দেওয়ান ফরিদ গাজীর পা স্পর্শ করে সালাম করলেন।

আমরা তখন ভিন্ন দল করি। বয়সের কারণেই হোক আর সময়ের ক্ষুব্দধতায় হোক- ধরাকে সরা জ্ঞান করি। শাহ আজিজুর রহমান আমাদের কাছে অগ্রজ হিসেবে প্রবাদ পুরুষ ছিলেন।তাঁর এমন নতজানু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা আর দেওয়ান ফরিদ গাজীর সামনে একদম বিনয়ে আটকারা হওয়াটা আমার চোখে ধরা পড়লো। তখন দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামীলীগ করছেন নিজের মত করে। পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামীলীগের ভাঙচুরের সময় শাহ আজিজুর রহমান প্রয়াত জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল করছেন।

সম্পর্কিত খবর

    কিছুদিন পর এক ঈদের দিন বিকেলে দেওয়ান ফরিদ গাজীর বাসভবনে বসে আছি। সঙ্গে আমাদের অগ্রজ ম আ মুকতাদির। শাহ আজিজ আবার আসলেন। ঈদের সালাম করতে। আবারো নতজানু হয়ে, পা ছুঁয়ে দেওয়ান ফরিদ গাজীকে সালাম করলেন। আমি জানতে চাইলাম, শাহ আজিজ ভাই কি জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর জামাই কিসিমের কোন আত্মীয় কি না?

    বোকার মতো এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ম আ মুকতাদির আমাকে বেশ তিরস্কার করলেন। শাহ আজিজ ভাইকে বললেন , আমার উতস্যুক্যের কথা। হো হো করে হেসেই বড় বড় চোখ বিস্ফূরণ করে বললেন, এর মধ্যেই রাজনীতিতে আচার আচরণ পালটে যাচ্ছে। জানালেন, তাদের সময়ে রাজনৈতিক নেতারা কোন স্বার্থে নয়, এভাবেই সম্মান করতেন বড়দের, শ্রদ্ধেয়জনদের।

    বড় বড় চোখ আর বড় গোঁফের আড়ালে এক কোমল বিনয়ী মানুষ ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের আগেই যুবক শাহ আজিজ তাঁর সাহসিকতার জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সিলেটে পাক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে লক্ষ্য করে কে কে জুতা ছুড়েছিলেন, এ নিয়ে গল্প করতেন বেশ উচ্ছাসের সাথে। প্রয়াত সাংবাদিক খায়রুল আমীন লস্কর মঞ্জু সহ শাহ আজিজুর রহমানের কাছ থেকে ঐ দিনটার নানা বিবরণ আমরা শুনতাম।

    সত্তর আশী আর নব্বই দশকে সিলেট অঞ্চলে সব রাজনৈতিক আন্দোলনে শাহ আজিজুর রহমান অগ্রভাগে ছিলেন।দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছে শুনা যেত স্বাধীনতা পূর্ব আর স্বাধীনতা উত্তর সিলেট অঞ্চলের রাজনীতির নানা খবর।

    এরশাদ বিরোধি আন্দোলনে শাহ আজিজ গুরুত্বপূর্ণ আবদান রেখেছেন। অনেক বৈঠকি নাতাদের তখন মাঠে পাওয়া যেত না। অবধারিতভাবে তাঁর উপস্থিতি ছিলো। আমাদের মত অনুজদের ছায়ার মতো রেখেছেন।

    শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল বিরোধি আন্দোলন শুরু হলো।টানা আন্দলন। অনেক নেতাদেরই তখন কাছে পাওয়া যায়নি।সময়টা অনুকূল ছিল না। ছিলেন শাহ আজিজ। সিলেটে তেল গ্যাসের আন্দোলন, বিভাগ আন্দোলন সহ সদাই সক্রিয় ছিলেন তিনি।

    ষাটের দশকের অনেক নেতারা এর মধ্যে গত হয়েছেন। কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাদের গল্প করতেন শাহ আজিজ।

    নিজেকে কোনদিন বৈষয়িক হতে দেখিনি।কোথায় থাকেন, কেমন চলেন ? - এমন প্রশ্নও করা হয়নি। আমরা জানতাম অনেক নির্মোহ জীবন যাপনে অভ্যস্থ এ জননেতা। নিজের জন্য কখনো কিছু ভাবেননি। এই শাহ আজিজ ভাইদের আশে পাশে ঘুর ঘুর করে অনেকে জমি দখল করেছে, বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। একবার এমন এক রাজনৈতিক সালিশে বসেছেন শাহ আজিজ। বিলেছিলাম, রাজনীতি করলে যদি সাধারন মানুষের জমি দখল করা যায়। তাহলে শাহ আজিজ, আখতার আহমেদ, সদর উদ্দিনরা তো পুরো জেলা দখল করে নিতে পারতেন।

    সুযোগ পাননি এমন নয়। জনগনের ভালোবাসায়, নিজে কোন অর্থ ব্যয় না করে উপজেলা চেয়ারম্যান হলেন। দলের মননোয়ন পেয়ে এম পি হলেন। যখন জাতীয় সংসদের এম পি শাহ আজিজ। ঢাকা থেকে একদিন ফোন করলেন, সিলেটের কতোয়ালী থানার ওসিকে একটি তদবিরের জন্য যেন ফোন করি।তাঁর এলাকার একজনের উপকারের জন্য এমন একটি ফোন কলের জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করছেন। আমার কান্না পেয়েছিলো সেদিনই। বললাম, শাহ আজিজ ভাই- আপনি এম পি, আপনার দল ক্ষমতায়। আপনি ফোন করলে ওসি কেন, আই জি শুনবেন। কথা শুনে শাহ আজিজ হো হো করে আসলেন। ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে ডি সি এসপি’র কাছে তদবির করা মানায় না!

    না , এ কোন পশ্চিমা রাজনীতির নিবেদিত জনপ্রতিনিধির জীবনের চালচিত্রের বিবরণ নয়। এ আমাদের পশ্চাদপদ সমাজ বাস্তবতায়, গ্রাম বাংলা থেকে উঠে আসা এক শাহ আজিজের গল্প। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন, দল ক্ষমতায় গেছে, নিজে উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, নিজে সংসদ সদস্য হয়েছেন- তারপরও এ মানুষটি বিত্ত বৈভব করেননি।অনেকটা অসচ্ছ্বল অবস্থায় জীবনের শেষ সময় পার করেছেন।

    লেখক : ইব্রাহিম চৌধুরী

    আমারা দূরবীন দিয়ে ভালো মানুষ খুঁজি। অভিযোগ করি , দেশে রাজনীতিবিদরা পচে গেছেন , নষ্ট হয়ে গেছেন। ঢালাও ভাবে বলি, রানীতিবিদরা লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় জমায়। আমরা ভুলে যাই, এসব লুটেরাদের মধ্যে একজন শাহ আজিজের উপাখ্যান সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে জনগনের কথা ভেবেছেন। নিজের পরিবার পরিজনের কথা ভাবেননি। এ দেশ বিনির্মানের শপথ নিয়ে যৌবনে অস্ত্র ধরেছিলেন। জীবনে নানা ঝড় ঝাণ্ডা গেছে। খেয়ে , না খেয়ে দিন কেটেছে। দেশ ও মাটির সাথে ভালোবাসার সে শপথ থেকে একচুল নড়েননি।

    ১৬ সেপ্টেম্বর দূর দেশে বসে খবর পেলাম শাহ আজিজ চলে গেছেন। আমাদের যৌবনের আরেক নায়কের প্রস্থান বিষাদের। যন্ত্রণাটা বড় তীব্র। একে এক নিভিছে দেউটি!সিলেট অঞ্চলের চার দশকের রাজনীতিতে সংলগ্ন ছিলেন শাহ আজিজ। এ স ময়ের রাজনীতির মানুষগুলোর আপনজন ছিলেন। জানি , সবাই এ মহতপ্রাণ মানুষটিকে বড্ড মিস করবেন ! চিন চিনে বুকে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন!

    কতো মিছিল, কতো সভা , কতো বৈঠক ! সবখানেই নিজের বিনয় দিয়ে, সততা দিয়ে ঋদ্ধ করে গেছেন আমাদের। একজন শাহ আজিজ আমাদের উর্বর জমিতেও নিত্যদিন আসেন না। জীবন একটাই , এ জীবনে অপ্রাপ্তি ছিলো। কষ্ট ছিলো। বলেননি কখনো। অর্জন ছিলো । শাহ আজিজ ভাই , বীরের অর্জন নিয়ে উর্বর মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। এ দেশ, দেশের মাটি কখনো নীরবে, কখনো সরব উচ্চারণে উর্বর মাটির এসব খাঁটি সন্তানের বন্ধনা করে যাবে।

    অগুনতি ভক্ত অনুরাগীর পক্ষ থেকে অন্তিম অভিবাদন, শাহ আজিজ ভাই ! বাংলার আকাশে উজ্জ্বল তাঁরার মধ্যে দিকহার মানুষরা আপনাদের খুঁজে তাকিয়ে থাকবে।

    লেখক : সাংবাদিক

    (লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)

    -একে

    শাহ আজিজুর রহমান
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close