• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

চোখের পর্দা তো সবারই থাকে

প্রকাশ:  ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৩
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

শুরু করতে চেয়েছিলাম ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধা জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শেরপুর, নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শ্যামগঞ্জে যে মতবিনিময় করেছি এবং ২৮ অক্টোবর ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছি তা নিয়ে। কিন্তু আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের সপ্তমী। দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে মহালয়ার মধ্য দিয়ে। তিন দিন পর বিজয়া দশমী। দুর্গাপূজা সারা ভারতে ব্যাপকভাবে না হলেও বাঙালি হিন্দুরা দুর্গাপূজাকে তাদের সবচেয়ে বড় এবং মাহাত্ম্যপূর্ণ মনে করে। অসুর বিনাশে দেবতাদের দ্বারা দেবী দুর্গার সৃষ্টি। ১০ হাতের দেবী দুর্গা আসলে ১০ হাতের নন। তার ১০ হাত মানে ১০ দিক, তার ১০ হাত মানে সমস্ত পৃথিবীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের শক্তি। সমস্ত অন্যায়-অত্যাচার বিনাশের প্রতীক দেবী দুর্গা। আমি তাদের এই আনন্দের দিনে দেশবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই।

লিখতে ইচ্ছা করে অনেক। কিন্তু কোনো কোনো সময় বাধো বাধো লাগে। কিছুটা চোখের পর্দা তো সবারই থাকে। আমরা গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ। আমাদের পর্দা না থাকলে কি চলে? চলে না। যারা সমাজের অনেক ওপরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও উঁচুতে তাদের সভ্যতা-ভব্যতা না মানলেও চলে, আমাদের চলে না।

আমাদের দেশে ফকির-মিসকিনের অভাব নেই। একবার এক মিসকিন সারা দিন এ মসজিদ ও মসজিদ এখানে-সেখানে এমনকি শেষ পর্যন্ত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দরজায়ও সময় কাটায়। কিন্তু তার ভিক্ষার পাত্রে তেমন কিছু জোটেনি। সারা দিনে আল্লাহর পবিত্র ঘরের সামনে কত আল্লাহ আল্লাহ করেছে, কান্নাকাটি করেছে কিন্তু দিন চলার পয়সা জোটেনি। শেষে হতাশ হয়ে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা ক্লাব গুলশান বা অন্যান্য ক্লাবের মতো কোনো এক ক্লাবের গেটে চুপচাপ বসে পড়ে। রাত গভীর হলে বেসামাল লোকজন মিসকিনের পাত্রে সব ফেলে হাত খালি করে টলতে টলতে বেরিয়ে যায়। মিসকিনের সামনে সম্পদের পাহাড় জমে যায়। সে গোনাগুনির মতো সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। সারা জীবন মসজিদ মসজিদে, বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে যা পেয়েছে তার শতগুণ ক্লাবের গেটে অর্ধেক রাতেই পেয়ে গেছে। টোপলা বেঁধে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ‘হে আল্লাহ! দয়াময়, হে পাক পরওয়ারদিগার, তোরে সারা জীবন খুঁজলাম কোথায় আর তুই আছস কোথায়।’

আমারও তেমনি মনে হয়। ৯ তারিখ হজরত শাহ সুফি সামান উল্যাহর ওফাতে অংশ নিতে তক্তারচালা গিয়েছিলাম। সেখান থেকে টাঙ্গাইল। মুরাদ সিদ্দিকীর নাগরিক কমিটির পক্ষে টাঙ্গাইল পৌর উদ্যানে সভা ছিল। ভোর ৬টা থেকেই মাঝে মাঝে মাইকের গর্জন শুনছিলাম। কারণ মিটিং ছিল সকাল ১০টায়। ১০টা-১১টা পর্যন্ত ৫০-৬০ জনের বেশি লোক ছিল। ১১ অক্টোবর আবহাওয়াও ছিল খুবই খারাপ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সভাপতি করা হয়েছিল আবদুস সবুর বীরবিক্রমকে। আবদুস সবুর বীরবিক্রমকে না পেলে আমি মুক্তিযুদ্ধে অত সফলতা পেতাম না। সভায় বেশ ভালো লোক হয়েছিল। আবহাওয়া ভালো থাকলে নিশ্চয়ই আরও লোক হতো। তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না। কিন্তু মানুষজন ছিল।

মুরাদের নাগরিক কমিটির শক্তিই মনে হলো সবুর খান বীরবিক্রম, ফজলুল হক বীরপ্রতীক। সবুর খান কাদের সিদ্দিকীর বৈরাম খাঁ মানে সম্রাট আকবরের মামা বৈরাম খাঁর মতো। কিন্তু ফজলুল হক বীরপ্রতীক, যার মুক্তিযুদ্ধে অবদান অপরিসীম। কিন্তু তার পরের ভূমিকা বা এখনকার ভূমিকা বিতর্কিত। মুরাদের জনসভা শুনে কেন যেন মনে হলো আমরা কতভাবে আমাদের শক্তি ক্ষয় করছি। আজ যারা টাঙ্গাইলের সবকিছু তারা সবাই একসময় ছিল আজাদ-মুরাদ-মিরনের চেলা।

জননেত্রী শেখ হাসিনা একবার টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন, ‘তোমরা দাবাইয়া রাখতে পারবা না’ জননেতা শামসুর রহমান খানের লেখা নাটক দেখতে। সে সময় মুরাদ সিদ্দিকীর কয়েকজন কর্মী নেত্রীর গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে রাস্তা অবরোধ করেছিল। তারা সবাই এখন নেত্রীর ডানে-বাঁয়ে। আমাকে কোরবানি করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ বলে নেত্রীও নাকি তাতে তাল দেন। যদিও আমার তেমন মনে হয় না। কারণ নিচু চিন্তা আমাকে স্পর্শ করে না, খারাপ লাগে। একদিকে লতিফ ভাই, আরেকদিকে মুরাদ ভাই, আরেক দিকে আজাদ ভাই, কেউ কেউ আবার লন্ডন-আমেরিকা থেকেও ভোটে দাঁড়ায়। অথচ কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এরা কেউ বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন বাজি রাখেনি। তার পরও এরা সবাই বীর, এরাই দেশপ্রেমিক।

সত্য বলতে কি, সাধারণ মানুষও এদের কথা বলে। আর আমাদের সৌভাগ্য খুব কম লোক আমাদের ত্যাগ করেছে, তারা কখনো বড় ভাই, কখনো ছোট ভাই, কখনো কাদের ভাই এদিক-ওদিক করে চলেছে। আমরাও বুঝি না যে, এতে আমাদের ক্ষতি হয়, সমর্থকরাও বোঝে না এতে রাজনীতির ক্ষতি হয়। তবে এটা সত্য, আওয়ামী লীগ সরকারি দল, গত কয়েক মাসে সুন্দর চমৎকার আবহাওয়ায় মন্ত্রী-উপদেষ্টা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়ে যেসব সভা-সমাবেশ করেছে তার চেয়ে দ্বিগুণ তিন গুণ লোক হয়েছে এবং বৃষ্টিতে ভিজে মিটিং শোনার রেওয়াজ এখন আর নেই, সেই রেওয়াজ ভেঙে বৃষ্টিতেও লোকজন কথা শুনেছে। তবে অবাক কা-, সেখানে যেমন আমার গামছার লোকজন অংশ নিয়েছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি সব দলের লোকজনকে কমবেশি দেখা গেছে। তবে এ কথা ঠিক, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের কথা বলতে গিয়ে সিদ্দিকী পরিবার সিদ্দিকী পরিবার বলতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে নেতা বা নেত্রী হিসেবে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।

যাক, গত সংখ্যায় ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের নিয়ে দু-চার কথা লিখেছিলাম। প্রায় ১০ দিন পেরিয়ে গেছে শেরপুর সার্কিট হাউসের ড্রয়িং রুমও না পাওয়ার ইতিবৃত্তান্ত জানতে এখন আর কোনো কিছু বাকি নেই। মাননীয় মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ওই জেলার মন্ত্রী বলে অন্য কেউ সার্কিট হাউস ব্যবহার করতে পারবে না, এটা যদি রীতি হয় মতিয়া চৌধুরীরও খুব বেশি সময় বাকি নেই। তারও বেশি দিন নৌকায় থাকা যাবে না। জননেত্রী হয়তো তাকে নৌকার মাঝি মনোনীত করতে পারেন। কিন্তু দেশের মানুষ মেনে নেবে না। ২০১৪ সালে যাই হোক এবার নকলা-নালিতাবাড়ীতে বেগম মতিয়া চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও ফেল করবেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করেও তাকে সংসদে আনতে পারবেন না। মিথ্যা সবই খারাপ। তারও নাকি একটা সীমা থাকে। উন্নয়ন মেলার জন্য সব ঘর বুক মানে সব ঘর বরাদ্দ এমন ডাহা মিথ্যা রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় চলে না। সন্ধ্যায় হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে গিয়েছিলাম। ভেঙেচুরে একাকার। মেরামত চলছে পুরোদমে। দু-তিনটি সাধারণ রুম ছিল। তারই সবচাইতে ভালোটা আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছিল। ধুলাবালি নোংরাতে ভরা। কিন্তু লোকজনের সেবাযত্নে হৃদয়-মন ভরে গিয়েছিল। শুধু রাতটাই ছিলাম সেখানে।

আমি নিজেই তো দেখেছি, যাদের গোপালগঞ্জ বাড়ি, টুঙ্গিপাড়া হলে তো কথাই নেই, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের থেকেও তাদের পাওয়ার বেশি। আবার এও তো দেখেছি কদিন আগে সাব-ইন্সপেক্টর উত্তম মারা গেছে সে আমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার এক দিন পর গোপালগঞ্জের দুই সাধারণ পুলিশ এসেছিল। তাদের কথা, ‘স্যার, আপনার কথা কত শুনি। গাজীপুর নির্বাচনে যা হয়েছে তা বলার মতো না। আমরা আর চাকরি করব না। এ সরকারের বদল হলে গোপালগঞ্জের পুলিশকে পুলিশরাই মেরে ফেলবে।’ এ তো আমার নিজ কানে শোনা কথা। গ্রামগঞ্জে রাত-দিন ঘুরি, কত উচ্চ পদে হিন্দুরা। কিন্তু গ্রামের নিরীহ হিন্দুদের কথা কে শোনে? তারা এখন পাকিস্তান আমলের চেয়েও বেশি নির্যাতিত-নিপীড়িত। তাই সবকিছু একদিক থেকে বিচার করলে চলে না। বিচার অন্য দিক থেকেও করতে হয়। ১২ তারিখ ছিল আমার ময়মনসিংহ চুরখাইয়ের কর্মী নোবেলের ছোট ভাইয়ের বিয়ে। আমার সুবিধার জন্য ১৫-২০ দিন এদিক-ওদিক করে বিয়ের দিন-তারিখ করেছিল। বিয়ের জুটি আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে।

ঢাকার অনেক বিয়েতে যাই, কাচ্ছি বিরিয়ানি, রোস্ট, রেজালা, বোরহানি এই আর কি। আমি মাংস খাই না, শাক-সবজি ছোট মাছ আর ভর্তা হচ্ছে আমার খাদ্য। বড়লোকের বিয়ে-শাদিতে গিয়ে ওসব পাওয়া যায় না। দু-এক জায়গায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি, তবু হাসিমুখে চলে আসি। কিন্তু নাগরপুরের মেয়ে টাঙ্গাইলে বিয়ে। তারা কিন্তু আমার জন্য আলু ভর্তা, ভাজি, কচুর লতি ও অন্য অনেক কিছুর ব্যবস্থা করেছিল। ডায়াবেটিস আছে বলে সামান্য খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জন্য ব্যবস্থাপনা দেখে নোবেলের প্রতি ভালোবাসায় মন-প্রাণ কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল।

বিয়ের আসর থেকে ফেরার পরই দীপ-কুঁড়ি-কুশির মার ফোন পেয়েছিলাম। শুনছ, ‘প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে চিঠি এসেছে।’ ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামী জাতীয় মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মিলনমেলা সম্পর্কে চিঠি দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল তারই কোনো জবাব-টবাব হবে। বেগমকে খামটি খুলতে বলেছিলাম। খোলার পর শুনলাম ‘সেতু বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন।’ পত্রটি একজন নয় তিনজন সচিবের। ১. মো. মোফাজ্জেল হোসেন, ২. নজরুল ইসলাম, ৩. সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। চিঠিটিতে লেখা, ‘সুধী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ আশ্বিন ১৪২৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখ শনিবার সকাল ১১টায় সেতু বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন ও পরিদর্শন করবেন। অনুষ্ঠানে আপনি সাদরে আমন্ত্রিত।’

কিন্তু অনুষ্ঠান শনিবার নয়, ছিল রবিবার। আগেই বলেছি, মসজিদে মসজিদে দিনের পর দিন আল্লাহ আল্লাহ কান্নাকাটি করে মিসকিন সারা জীবনে যা পায়নি এক দিন ক্লাবের সামনে পড়ে থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি ধনবান হয়ে বলেছিল, ‘আল্লাহ তোরে খুঁজছি কোথায় তুই আছস কোথায়।’ এই দাওয়াতপত্র দেখে আমার তেমনি মনে হয়েছে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার গাড়িতে লাগানোর স্টিকার নেই। শুভ উদ্বোধন এবং পরিদর্শনের কথা ছিল শনিবার ২৮ আশ্বিন, ১৩ অক্টোবর ২০১৮। কিন্তু হয়েছে ১৪ অক্টোবর রবিবার। ১৩ তারিখ ঘাটপাড়ে গিয়ে আমি কী করতাম! আর আমি তো সরকারি দলের কেউ না। সরকারের বাইরের দলগুলোকে দেশের উন্নয়নের কাজে আমন্ত্রণ জানানোর যদি রেওয়াজ থাকত তাহলে তো ওরকম হওয়ার কথা নয়। কাকে এর জন্য প্রশ্ন করব? সভ্য দেশ হলে সঠিকভাবে সরকার চললে তিন ভদ্রলোকেরই চাকরি থাকার কথা নয়। কিন্তু তাদের কিছু হবে না। বরং প্রমোশন হবে। রবিবারের অনুষ্ঠানের শনিবারের দাওয়াত করে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলেন দাওয়াতি কিছুই জানলেন না। এই হলো সরকারি কর্মচারীদের কাজের নমুনা!

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close