• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ সংলাপ

প্রকাশ:  ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ০২:২৭
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ

আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি দেশ। একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, প্রশ্নমুক্ত করার দাবিটি শুধু বিরোধী রাজনৈতিক মহলেরই নয়; দেশ-বিদেশের নানা মহল থেকেও সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হচ্ছে বারবার। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি বলছে, সরকার এসব বিষয় আমলে না নিয়ে তারা তাদের মতো ভাবছে, এগোচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো এত বড় একটি বিষয় কখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুসম্পন্ন করা সম্ভব নয়, যদি এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের নিরসন করা না যায়; একই সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়। এ দেশের মানুষের প্রাণের দাবি সুষ্ঠু নির্বাচন। গণতন্ত্রের বিকাশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন তো বটেই; সরকারেরও সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা অত্যন্ত জরুরি।

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রতিবন্ধক এমন অনেক কিছু এখনও জিইয়ে আছে। বিদ্যমান সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই। তা না হলে এমতাবস্থায় অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা এখন পর্যন্ত দুরূহই মনে করি। ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা কবি জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) তার Endymion গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন-

সম্পর্কিত খবর

    'A thing of beauty is a joy for ever :/ Its loveliness increases; it will never/pass into nothingness.’ অর্থাৎ 'একটি চমৎকার জিনিস সব সময়ের জন্য আনন্দদায়ক।/ এর চমৎকারিত্ব বৃদ্ধি পেতেই থাকবে/ কোনোদিন তা অর্থহীন হয়ে উঠবে না।' কবি জন কিটসের এই লাইনগুলো ইংরেজিভাষীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং এর প্রথম পঙ্‌ক্তিটি লাখ লাখ ব্যক্তি উদ্ধৃত করেছেন; কারণে অথবা অকারণে।

    আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটানা দীর্ঘদিন ভালো থেকেছে- এমন নজির কম। এ জন্য কে বা কারা দায়ী, তা ভেবে মন খারাপ করার তো প্রয়োজন নেই। বাতি জ্বলে উঠলে অন্ধকার দূর হবেই। আবর্জনা-জঞ্জাল অপসারিত হলে পথ সুগম হবেই। কাদামাটির এ দেশে সূর্যের খরতাপ ও সঞ্জীবনী আলোই পারে চলার গতি দ্রুত করতে। তাই তো এত আবেগ ভরে আমরা চাই খরতাপ আর আলো। আমাদের জন্য এটি হলো সব শুভ চিন্তার সৌন্দর্য।

    একমাত্র গণতন্ত্রই সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। সবার জীবনকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। একবার এই চমৎকার বিষয়টির মূল সমাজ জীবনের গভীরে প্রবেশ করলে সব সময়ের জন্য এর চমৎকারিত্ব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং হিংসা-প্রতিহিংসার মতো রূঢ়, অমানবিক-অনাকাঙ্ক্ষিত চেতনা মাটির সঙ্গে মিশে গেলে সমগ্র জাতির জন্য অনাবিল আনন্দের আবহ সৃষ্টি করবে। সামাজিক ক্ষেত্রে এর রমণীয়তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করলে এবং এর গভীরতা জাতীয় মননের সঙ্গে মিশে গেলে কোনোদিন তা আলগা হয়ে ভেদবুদ্ধি বা বিভাজনের করাল গ্রাসে অর্থহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। এ জন্য চাই জাতীয় নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও সুস্পষ্ট এক ভিশন।

    দুই বা তিন যুগ পরে আমরা দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ব্যাধির মতো ব্যত্যয়ের ওপর কতটুকু বিজয় অর্জন করব বা সার্বিক অগ্রগতির পথে কতটুকু অগ্রসর হবো, এই দিকনির্দেশনার জন্য নেতৃত্বের সৃজনশীলতাই সেই খরতাপ। নেতৃত্বের দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ হয় তাহলে হিংসা-প্রতিহিংসা-আবর্জনা রাজনৈতিক জীবনকে আর কলঙ্কিত করবে না। আলো যদি উজ্জ্বল হয় তাহলে দুর্নীতির অভিশাপ অর্থনীতির গতি মন্থর করবে না। সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় সমাজ জীবনের মৌল সূত্রগুলো আর আচ্ছন্ন হবে না। অতীতমুখী প্রবণতা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নকে আর আবছা করতে পারবে না। সর্বোপরি সূর্যের খরতাপ ও আলো অর্থাৎ আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি সমাজের সর্বস্তরে কার্যকর করতে হয়, তাহলে নতুন জীবনীশক্তির পরশমণির পরশে জাতির চিৎশক্তিকে নতুনভাবে জাগ্রত করতে হবে।

    এ জন্য প্রয়োজন নির্বাচন ব্যবস্থা স্বচ্ছ, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের করা। রাজনীতিকে কল্যাণমুখী করা। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সুখদ গণতন্ত্রের আলোয় আলোকিত হয়ে হিংসা-প্রতিহিংসার পরিবর্তে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হবে নতুনভাবে প্রাণবন্ত। এসব সত্য এড়ানোর পথ নেই। আমাদের জ্ঞানী-গুণী রাজনীতিকরাও অবশ্যই এসব বোঝেন ও জানেন। কিন্তু অন্তর দিয়ে এসব বিষয় ক'জন অনুভব করেন- এ নিয়ে কথা উঠতেই পারে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় রাজনীতিকে সৃজনশীল ধারায় প্রবাহিত করতে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলীয় আনুগত্য পরিহার করে জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠবেন- এমনটাই কাম্য। অবশ্যই প্রত্যাশা করি, হাজারো শর্তে বিভক্ত জাতি আবারও ঐক্যবদ্ধ হবে। নিজেদের অধিকার উপভোগ করে জনগণ সার্বিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে। কিন্তু এ জন্য তো করণীয় রয়েছে অনেক কিছু, যা সংশ্নিষ্ট কারোরই অস্বীকারের পথ নেই।

    হ্যাঁ অবশ্যই সত্য যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই সব প্রত্যাশার পূর্ণতা দিতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তো আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার কোনো বিষয় নয়। এর জন্য সংশ্নিষ্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্রমেই এগিয়ে এলেও সরকারের তরফে এ ব্যাপারে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে সংকট প্রকট হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক চলছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আন্তরিক- দল এবং তার জোটের শীর্ষ নেতারা ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন। কিন্তু এই নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে-এ কথাও তারা বলেছেন। বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে এবং এই নির্বাচনটি যেন হয় অবাধ, স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত ও সর্বাংশে দৃষ্টান্তযোগ্য।

    এ জন্য ক্ষমতাসীন মহলের সদিচ্ছা-আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ দরকার। পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধাহীনতার বিষয়টি খুব অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পুষ্ট হয়ে উঠেছে। একটা কথা নিশ্চয় ক্ষমতাসীন মহলের নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করবেন বলে আশা করি, সমঝোতা ও বিভিন্ন মতাদর্শীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানবোধ ছাড়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু ঘাটতি রয়েছে, এর নিরসন প্রয়োজন। এটি যেন কোনোভাবেই পুষ্ট না হয়, তাও নিশ্চিত করা জরুরি। এ জন্য দরকার সংলাপ। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে ক্ষমতাসীন মহলকে। আলোচনার টেবিলে বসে যত বিতর্কই হোক, এর মধ্য দিয়েই বের হয়ে আসুক সমাধান। সংলাপে বসা প্রয়োজন বিদ্যমান সংকট নিরসনের প্রয়োজনে। আর এ সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প পথ নেই।

    এখন এমন সময় উপস্থিত, কোনো কিছু গোপন রাখা খুব দুরূহ। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে কিংবা বিকাশে মানুষ খুব সহজেই ইচ্ছামতো যে কোনো বিষয় জেনে নিতে পারে। এর ফলে খুব দ্রুততম সময়ে জনমতও সংগঠিত হচ্ছে এবং এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই রয়েছে। সরকার বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভুল-ভ্রান্তি কিংবা অন্যায় কোনো কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আগে সাধারণ মানুষ তেমন কিছুই জানতে পারত না। এখন তা নয়। সাধারণ মানুষও এখন অনেক কিছু সহজে জানতে পারছে। এমতাবস্থায় পরস্পরকে দোষারোপ করে সত্য আড়াল করা কিংবা সত্যকে মিথ্যায় কিংবা মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরের অবকাশ নেই। সুষ্ঠু, অবাধ, প্রশ্নমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতকরণের পথ সুগম করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশ-জাতির সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতির জন্য কতটা অপরিহার্য, এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। খুব দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এমন কিছু উপসর্গ রয়েছে, যেগুলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে খুব প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধকতার প্রেক্ষাপট সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা।

    ভিন্নমতাবলম্বীদের মুক্ত বিচরণ, মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ করার মতো পরিস্থিতি যাতে বিদ্যমান থাকে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এসব বিষয়ে এ যাবৎ যা পরিলক্ষিত হয়েছে, সেসবই খুব উদ্বেগজনক। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। অধিকারের ভূমি সমতল নয়। আবারও বলতে হচ্ছে যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই সব প্রত্যাশার পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এটিই মূল বিষয়। আবারও ফিরে যেতে হয় প্রথিতযশা কবি জন কিটসের কবিতার পঙ্‌ক্তির কাছে। সত্যিই তো, একটি চমৎকার জিনিসই সব সময়ের জন্য আনন্দদায়ক। ইতিমধ্যে জনপ্রত্যাশা বহুবার হোঁচট খেয়েছে। আর যেন এমনটি না ঘটে, রাজনীতিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে তা-ই নিশ্চিত হোক। বিরোধীপক্ষ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে যেভাবে বাধার মুখোমুখি হয়েছে কিংবা হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন জাগে- এভাবে কি গণতন্ত্রের বিকাশ কিংবা এর পথ মসৃণ করা সম্ভব?

    অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    এমাজউদ্দীন আহমেদ
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close