• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আমরা কি এখনও ক্রীতদাস?

প্রকাশ:  ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০১:৪৭
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

একসময় মানুষ দাস হিসেবে অন্যের কাছে বিক্রি হতো এটাকে বলা হতো দাসপ্রথা | দাসত্বের চিহ্ন হিসেবে জ্বলন্ত লোহার দন্ড কপালে চেপে ধরা হত | একটা ভয়ংকর আত্মচিৎকারে কেঁপে উঠতো প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস | কিন্তু মানুষের নিরেট পাথরের মনকে তা কখন আবেগপ্রবণ করেনি | বরং এটা ছিল সভ্য মানুষদের অসভ্য উৎসব | কিন্তু এই দাসপ্রথা কি এখন বিলুপ্ত হয়েছে ? সময় বলছে মানুষ আরো সভ্য আর আধুনিক হয়েছে তেমনি কৌশলে নিজেদের মতো করে দাস বানানোর সুগভীর পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে | দাস প্রথা মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এটা প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে।

বিশেষত ১২ অক্টোবর ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর সেখানে কালক্রমে গড়ে ওঠে ভয়াবহ ক্রীতদাস প্রথা। ঊর্বর জমি আর সম্পদের লোভে ইউরোপীয়রা এই মহাদেশে তাদের অবস্থান সংহত করতে থাকে। তারা স্থানীয় আদিবাসীদের ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে তাদের জমি দখল করে নেয়। তারা এখানে ব্যাপকভাবে শুরু করে কৃষিকাজ। এই কাজে স্থানীয় আদিবাসীদের বাধ্য করতে তাদের ওপর নেমে আসে অকথ্য ও নির্মম অত্যাচার। কিন্তু ইউরোপে বিপুল পরিমাণ অনাবাদী ঊর্বর জমি পড়ে থাকা সত্ত্বেও জনবলের অভাবে সেখানে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি। এই সমস্যার সমাধান যে প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয়রা করেছিল তা মানবিক মূল্যবোধ ও উন্নত অর্থনৈতিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তারা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষকে এই ধরনের কাজ করানোর জন্য ধরে এনে ক্রীতদাসে পরিণত করে।

সম্পর্কিত খবর

    আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকায় দাস ধরে আনার এই ব্যবসাকে ইতিহাসে ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রথার শুরুর দিকে এই নিয়ন্ত্রণ পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের হাতে থাকলেও পরবর্তীতে তা ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের হাতে চলে যায়।

    ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে আফ্রিকার প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মত নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস প্রথায় নিয়োজিত করা হয়। ধারণা করা হয়, শিল্প বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনীতি দাস প্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে শিল্প বিপ্লবের পর ঊনবিংশ শতক থেকে দাসপ্রথা বিলোপের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হতে থাকে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটো ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে তাদের দর্শনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জারদের হাত থেকে ক্রীতদাস প্রথা মুক্ত হয়েছিল। লিও তলস্তয়, লেনিন, মাও সেতুং, মহাত্মা গান্ধী, স্পারটাকাস, নাট টারনার, হ্যারিয়েত তুবম্যান, সুজারনার টুথসহ অসংখ্য মানবতাবাদী মানুষ ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান দৃঢ় করেছিলেন।

    আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে বিজয়ী হন। এ ধরনের মানবিক অধিকার আন্দোলনের ফলে ১৮০৭ সালে ইংল্যান্ড রাষ্ট্রিয়ভাবে সর্বপ্রথম দাস প্রথা বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়। এরপর ইউরোপের অন্য দেশগুলো দাস প্রথা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। সর্বশেষ ১৮৩০ সালে ব্রাজিলে দাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে এই কলঙ্কজনক অমানবিক ইতিহাসের অবসান ঘটে। আমেরিকার বিখ্যাত লেখক অ্যালেক্স হ্যালি দাস প্রথার নির্মমতা ও দাসত্বের করুণ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে লিখেন, ‘রুটস : দি সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি’ উপন্যাসটি ।

    এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে টিভি সিরিয়াল ‘দ্য রুটস’ প্রচারিত হয়। এর মূল চরিত্র কোন্টাকিন্টের নির্মম জীবন ও সংগ্রামকে এর মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন্টাকিন্টের মতোই আরেক বিখ্যাত চরিত্র আংকল টম। আমেরিকার লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার ষ্টো তাঁর উপন্যাস ‘আংকেল টম’স কেবিনের’ কেন্দ্রীয় এই চরিত্রের মাধ্যমে কালো দাসদের উপর সাদা মানুষদের নির্মম অত্যাচার ও ক্রীতদাসের মর্মস্পর্শী জীবন আলোচনায় আনেন।সম্প্রতি আধুনিক দাসপ্রথার গবেষণার বিষয় ও ফলাফল আমাদের হাতে এসেছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংস্থা ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স-২০১৮-তে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আধুনিক দাসত্বের শিকারে পরিণত হচ্ছে।

    আধুনিক দাস প্রথায় কৌশলগতভাবে মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাদের আধুনিক ও সভ্য সমাজে এখনও নারীদের কেনাবেচা হয়। আধুনিক দাস প্রথায় কৌশলগতভাবে মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। যেমন- নামমাত্র মজুরিতে কর্মজীবী মানুষেরা তাদের শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কর্মঘণ্টা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম নীতিকে অনুসরণ করা হচ্ছে না। আবার অনেক সময় দালালদের খপ্পরে পড়ে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।

    বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে আধুনিক দাসে পরিণত করা হচ্ছে। সম্প্রতি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩২৪ জনেরও বেশি নারী গৃহশ্রমিক দেশে ফিরেছেন। অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করেন এমন একটি সংস্থা ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স ফর মাইগ্রেশনস রাইটস বাংলাদেশ মনে করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী নির্যাতন ব্যাপকহারে বেড়েছে। সেখানে একজন নারীকে শুধুমাত্র ঘরের কাজকর্মই করতে হয় না বরং তাকে গৃহকর্তাসহ ওই বাড়ির যত পুরুষ আছে তাদের যৌনদাসী হিসেবেও ব্যবহূত হতে হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রেও আধুনিক দাস প্রথা আমাদের অগোচরে জায়গা করে নিচ্ছে কিনা সেটি নিয়ে আমাদের ভাববার সময় এসেছে। বর্তমানে বিভিন্ন লীগে খেলোয়াড়দের নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। যা প্রাচীন দাস প্রথার নিলামের সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাহিত্য যেমন একটি সৃজনশীলতা, খেলাও তেমনি একটি সৃজনশীলতা।

    এই ধরনের সৃজনশীলতাগুলোকে কোনোভাবেই নিলামের মধ্যে এনে আধুনিক দাসত্বের আওতায় আনা ঠিক নয়। বরং বিকল্প মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সার্বজনীনতা নিয়ে এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা দরকার।তবে এ ধরনের দাসত্ব থেকে ভিন্ন এক ধরনের দাসত্ব সমাজে সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না কীভাবে আমরা নিজেদের অগোচরে অন্যের দাসে পরিণত হচ্ছি। জীব ও জড়- দুই ধরনের দাসত্বের শিকারে নিজেদের পরিণত করছে মানুষ। যেমন মাদক জড় পর্দাথ। কিন্তু এ জড় পদার্থও মানুষের মতো প্রাণীদের তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।

    মানুষ মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অন্যের দাসত্ব গ্রহণ করছে। ১৯৯৭ সালে ‘মাদকের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা মডেল’ এর একটি ব্যাখ্যা দেন গুডি, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- মাদকাসক্তরা মাদক সেবনের ফলে মাদকের দাস হয়ে যান এবং তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তারা মাদকের পেছনে এত বেশি পরিমাণ অর্থ খরচ করেন যে, সাধারণ বৈধ পেশা দ্বারা তাদের মাদক সেবনের অভ্যাস বজায় রাখতে অর্থায়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফলস্বরূপ তাদের অবশ্যই অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে হবে। আমেরিকান ঔপন্যাসিক ফিলিপ কে ডিকের বর্ণনায়, ‘মাদকের অপব্যবহার কোনো রোগ নয়, এটা একটা সিদ্ধান্ত। এটা একটা চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো। এটাকে আপনি রোগ বলতে পারেন না, বলতে পারেন চরম একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের দাসত্বের ঘটনাগুলো ঘটছে।

    প্রযুক্তির দাসত্ব নিজের অগোচরে করে যাচ্ছে অনেক মানুষ। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকটি মানুষকে প্রভাবিত না করে এর আসক্তির দিকটি প্রভাবিত করছে। বর্তমানে ইন্টারনেট দুনিয়ার এক ভয়ংকর নাম ‘ব্লু-হোয়েল’। এ সুইসাইড গেম বা মরণ নেশার ফাঁদে পড়ে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না। কী আছে এই গেমের মধ্যে? ফিলিপ বুদেকিন কেনই বা তৈরি করলেন এ গেম, তাই এখন আলোচনার অন্যতম ইস্যু। কে এ ফিলিপ বুদেকিন? ফিলিপ বুদেকিন রাশিয়ার নাগরিক। তার ডাকনাম ফিলিপ ফক্স। তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে দেখা যায়নি।

    ফিলিপ ১৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালে প্রথমে ব্লু-হোয়েল নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি সামাজিক মাধ্যমে ‘এফ-৫৭’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ৫ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করেন। ৫ বছরের মধ্যে যেসব মানুষ সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় (তার মতে) তাদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ফিলিপ যখন এ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন তিনি রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়াশোনার পর ব্লু-হোয়েলের বিষয়টি প্রকাশ হলে ২০১৬ সালে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

    ওই সময়ে তাকে গ্রেফতার করে রাশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফিলিপ কিশোর বয়সে তার মা ও বড় ভাইয়ের হাতে প্রচুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন। তবে সে নিজেও মানসিকভাবে অসুস্থ বলে তদন্তকারীরা সংবাদমাধ্যমকে জানান। ফিলিপ ও তার সঙ্গীরা প্রথমে রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ‘ভিকে’ ব্যবহার করেন। সেখানে তারা একটি গ্রুপ করেন। ভয়ের ভিডিও গ্রুপে ছড়ানোর মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। ভয়ের ভিডিও ছড়ানোর ফলে ওই গ্রুপে প্রচুর তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়। সেখান থেকে বুদেকিনের সঙ্গীরা মিলে এমন সব তরুণ-তরুণীকে বাছাই করতে থাকেন, যাদের সহজে ঘায়েল করা সম্ভব হবে।

    সেন্ট পিটার্সবার্গ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ বলেন, ‘যেখানে মানুষ আছে সেখানে কিছু জীবন্ত বর্জ্যও (মানুষ) আছে। সমাজে ওইসব মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা হয় নিজেরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, না হয় তারা সমাজের ক্ষতির কারণ। আমি সমাজের ওইসব বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাই।’

    তবে তিনি সরাসরি আত্মহত্যার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি আত্মহত্যার জন্য অনুপ্রাণিত করিনি। কিন্তু গেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা নিজেরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত মে মাসে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফিলিপকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। এখানে দুটো বিষয় বিশ্লেষণ করা যায় । একটি হল- তার ওপর পরিবারের নিপীড়ন। যেটি তার মানসিকতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। সে পরিবারের অশুভ চিন্তার দাসে পরিণত হয়েছে। আরেকটি বিষয় হল, একটা নেতিবাচক সৃষ্টির মাধ্যমে বুদেকিন অসংখ্য মানুষকে তার সৃষ্টির দাসে পরিণত করেছে। এর মাধ্যমে অশুভ চিন্তার মাধ্যমে মানুষ মানুষের কাছে ও তার সৃষ্টির কাছে বিক্রি হয়েছে। মানুষ অনেক সময় দুর্নীতির দাসে পরিণত হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যের দাসে পরিণত হচ্ছে। যেমন- কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে, তবে নৈতিকভাবে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার অবস্থান অনুযায়ী যে

    ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। প্রথমত, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় পরিবারের সদস্যদের কাছে তার দুর্নীতির বিষয়টি পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায়। ফলে পারিবারিকভাবে তার যে মর্যাদা ও সম্মান পাওয়ার কথা সেটি পাওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া সমাজের মানুষের মধ্যেও তার সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠে। যে অফিসের প্রধানের দায়িত্ব সে পালন করছে, সে অফিসের অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর তার কর্তৃত্ব থাকে না।

    আবার তার দুর্নীতির দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত হওয়ায় তাদের মধ্যেও দুর্নীতি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানে যে তাদের অফিসপ্রধান ঘুষ খায়, বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত আছে, তখন আইন অনুযায়ী অফিসপ্রধানের যে শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার কথা, সেটি আর পায় না। এখানে উল্লেখ্য, মানুষ শুধু আইনের দ্বারাই মর্যাদাবান হয় না, বরং মানুষের স্বচ্ছ ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়ে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ, সততা, মহত্ব ও কাজের ক্ষেত্রে অবদানের মাধ্যমেও সম্মানিত হন। এর আরেকটি নেতিবাচক দিক আছে সেটি হল যখন অফিসের সবাই জানতে পারে যে, তার অফিসপ্রধান বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক দাবি নিয়ে অফিস প্রধানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।

    যেমন- কোনো একজন নিুপদের কর্মচারী তার অফিসপ্রধানকে চাপ দিয়ে বলতে পারে আমার আত্মীয়কে আপনার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে। যদি অফিসপ্রধান নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তবে সে নিম্ন পদধারী কর্মচারী তার দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রকাশ করবে বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার সাহস অর্জন করে। অফিসপ্রধান যেহেতু নিজেই নৈতিকভাবে দুর্বল সে কারণে তার আইনগতভাবে কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ করতে পারে না; বরং নিু পদধারী কর্মচারীর অনৈতিক দাবি মেনে নিতে হয়।

    এভাবে অফিসপ্রধান তার অধস্তনের দাসে পরিণত হয়, প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা হাতের পুতুল বলি। এ কারণে অফিসপ্রধানের মাধ্যমে একটি অফিসের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি বাড়তে থাকে। যার প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে মানুষ তার বিশুদ্ধ বিবেক হারিয়ে অন্য মানুষের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

    ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এ অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা, সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’

    এই আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে দুর্নীতি দমন করতে হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি আমাদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের ইনক্লুসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে অগ্রসরমান কয়েকটি অর্থনীতির কথা বলেছে, যারা দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এ দেশগুলো হচ্ছে : নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। কিন্তু ফিনল্যান্ডের আজকের যে দুর্নীতিমুক্ত অবস্থান, তা কিন্তু ৫০ বছর আগেও ছিল না।

    বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার নিজেকে বিক্রি করার তথা পরিণত হওয়ার মানসিকতা পরিহার করে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করা।আমাদের অগোচরেই আমরা টুইটার, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ভিডিও গেম ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে এগুলোর দাস হয়ে পড়ছি কি না সেটি নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রয়োজন। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ফোরামে আধুনিক দাসত্বের বিষয়টিকে বিবেচনায় এনে এটিকে প্রতিরোধ করার বিশ্বজনীন নীতি গ্রহণ করা যায়। এর সাথে দরকার নিজেদের স্বকীয়তাকে ধরে রেখে আধুনিক দাসত্বের হাত থেকে নিজেকে ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করা।

    লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

    ওএফ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close