• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

তরুণরাই আমাদের স্বপ্ন আমাদের বিজয়

প্রকাশ:  ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৩৫
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

তরুণরা আমাদের প্রাণ শক্তি| তরুণদের মধ্যে রয়েছে অমিত শক্তির এক অসীম ভান্ডার| সেই পুঞ্জিভূত শক্তির নির্যাস বের করে এনে তরুদের সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত করতে হবে| তরুণরা আবেগপ্রবণ না বাস্তববাদী এটা নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক থাকলেও তরুণরাই অচলাতন ভেঙে নতুন দিনের সূচনা করতে পারে| দেশকে তাদের চিন্তাশীলতা দিয়ে বদলে দিতে পারে| এখন সময় এসেছে তরুণদের নিয়ে ভাবার|

বর্তমান সময়ে ফেসবুক, এসএমএস, ই-মেইল, টুইটার, লিঙ্কডিনের মাধ্যমে খুব দ্রুততম সময়ে মানুষের যোগাযোগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার এর সঙ্গে ভাইবার, স্কাইপি, ম্যাসেঞ্জারের মতো মাধ্যমগুলো দিয়ে সরাসরি কথা বলার ও একে অপরকে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, আগের তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের সঙ্গী ছিল প্রকৃতি; কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রকৃতির জায়গায় প্রযুক্তি হয়েছে তার প্রাত্যহিক সঙ্গী। এটাকে নেতিবাচক হিসেবে না দেখে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হবে। যদিও এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক হবে, সেটি নির্ভর করে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনাচরণের ওপর। আর ইতিবাচক বিষয়কে ধারণ করে তার চর্চার বিষয়টি নির্ভর করে পরিবার, পরিবেশ, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের সামগ্রিক অবস্থার ওপর। এর সঙ্গে উদার ও উন্নত চিন্তার মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য হার্ডকপি পোস্ট করে পাঠাতে হতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপককে। এতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিষয়টিতে দীর্ঘ সময় লাগত। আবার অনেক সময় একজন মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার আশা ছেড়ে দিয়ে হতাশায় ভুগত। তবে আগে যারা বিদেশে পড়তে যেত, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বিষয়টি বেশি কাজ করত। অর্জিত জ্ঞানকে দেশের কাজে লাগানোর বিষয়কে প্রাধান্য দিত। আবার পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ ও নিজের সংস্কৃতির দায়বদ্ধতা তাদের দেশমুখী করতে অনুপ্রাণিত করত।

সম্পর্কিত খবর

    বিশিষ্ট-প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামকে এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি একাধারে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান ভৌত বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ইত্যাদি। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও প্রফেসর আবদুস সালামের গবেষণার সূত্র ধরে তিনি আরও সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। বেশ কিছু গাণিতিক সূত্র এবং জটিল গাণিতিক তত্ত্বের সহজ পন্থার উদ্ভাবক ড. জামাল নজরুল ইসলাম মহাকাশের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। তার লেখা বেশ কিছু বই অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিদেশি প্রভু দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনে বারবার এ দেশকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। মাতৃভূমির প্রতিও অসীম ভালোবাসা ছিল তার। তাই তিনি উন্নত জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন দেশে।বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও অর্থনীতি আর সমাজ সংস্কারের বিষয়টিকেও শেষ জীবনে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশ্বাস করতেন পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের মুক্তি নেই। উন্নত বিশ্বের প্রতি তার একটাই অনুরোধ ছিল- 'তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালো-মন্দ আমাদের ভাবতে দাও।' আর বিশ্বাস করতেন, নতুন প্রজন্ম ঠিকই পথ বের করে ফেলবে। সে কারণে নতুনদের প্রায় সবটাতেই তার সমর্থন থাকত। তবে সেটি তরুণরা পারবে কি-না এটি নির্ভর করছে তাদের গঠনমূলক ভূমিকার ওপর। যার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তি যুক্ত আছে। বর্তমান সময়ে ই-মেইল, ভাইবার, স্কাইপি, মেসেঞ্জারের মতো মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী খুব স্বল্প সময়ে তার উচ্চশিক্ষার বিষয়টি যেমন নিশ্চিত করছে, তেমনি স্কলারশিপের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে। আবার একই সময় অনেক দেশে তার উচ্চশিক্ষার বিষয়টিতে যোগাযোগ করে অনেক বিকল্প সৃষ্টি করতে সমর্থ হচ্ছে। ফলে এ ধরনের বিকল্প তাকে সবচেয়ে ভালো বিষয়টি বেছে নিতে সাহায্য করছে, যেটিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা বলা হয়ে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে দেশপ্রেমের বিষয়টি গৌণ হয়ে নিজের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে আহরিত জ্ঞানকে রাষ্ট্র উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করার কথা থাকলেও অনেকে এ ক্ষেত্রে অর্থ ও জীবনযাপনের বিলাসিতাকে প্রাধান্য দেওয়াই দেশমুখী হওয়ার প্রবণতা কমছে। এটাকে মেধা পাচার বলা হলেও আসলে বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। তরুণদের এ ধরনের দেশ-বিমুখী প্রবণতা দেশের প্রতি আনুগত্যের অভাবের কারণে ঘটছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে প্রচার-বিমুখতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজের সৃজনশীলতা অনেকে প্রকাশ করলেও, অনেক তরুণের প্রতিভা ও মেধাশক্তি থাকলেও তা প্রকাশের ক্ষেত্রে একধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে বিষয়টি সত্য নয়। তারপরও নিজেকে প্রকাশের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থাকলেও কেন তরুণরা এই বিষয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে না তার সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্নেষণ ও গবেষণা দরকার। যেমন সাম্প্রতিককালে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো, যন্ত্রমানব সোফিয়াকে আনার মাধ্যমে একটা ইতিবাচক ঘটনা ঘটে গেছে, তা হয়তো অনেকের অগোচরে থেকে গেছে। সোফিয়াকে আনার পর আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের মেধাবী তরুণরা ডিজিটাল বাংলাদেশের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে অনেক আগে প্রায় একই ধরনের রোবট তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এটা হয়তো আড়ালেই থেকে যেত, যদি সোফিয়াকে বাংলাদেশে না আনা হতো। আরেকটি গর্বিত হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, আমাদের মেধাবী তরুণরা দেশি কাঁচামাল দিয়ে খুব কম মূল্যে এ ধরনের রোবট তৈরি করেছে। এর ফলে আমাদের তরুণরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে আর বাংলাদেশের রোবোটিক্স গবেষণা নিভৃত জায়গা থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে। সোফিয়াকে বাংলাদেশে আনতে সরকারের কোনো খরচ না হলেও একটি শক্তি অপপ্রচার চালিয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। সেটিও ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফলে যেখানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মানুষের ইতিবাচক ভাব আদান-প্রদানের উপাদান হওয়ার কথা ছিল, তা না হয়ে অনেকক্ষেত্রে নেতিবাচক শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। যেসব তরুণ রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে, তাদের আমরা সেভাবে সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দিতে পারছি কি-না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

    আমাদের দেশের তরুণরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, তেমনি এর মাধ্যমে দেশমাতৃকার সেবা করে চলেছে। বিষয়টি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এমন একটি সময়ে, যখন বিশ্বে অনলাইনে শ্রমদাতা (আউটসোর্সিং) দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় বলে জানিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও পাঠদান বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়টির 'অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই)'-এর একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারত অন্য সব দেশের চেয়ে এগিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অনলাইনে শ্রমদান বা অনলাইনে কাজের ক্ষেত্রে ভারত ২৪ শতাংশ অধিকার করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৬ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্র ১২ শতাংশ অধিকার করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, রাশিয়া, ইতালি ও স্পেন বাংলাদেশের পেছনে অবস্থান করছে। এটি তরুণদের অর্জন আর আমাদের গর্বের বিষয়। ইউটিউবের মাধ্যমে প্রযুক্তি ও শিক্ষাতাত্ত্বিক থেকে ব্যবহারিক পর্যায়ে চলে এসেছে। গুগল, ইয়াহুর মাধ্যমে তথ্যের নানা দিক আজ তরুণদের কাছে উন্মুক্ত হয়েছে। তবে উল্টো পিঠে তরুণদের আরেকটি দল এগুলোকে নেতিবাচক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে জঙ্গিবাদ, রক্ষণশীল মনোভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে, যা কখনোই রাষ্ট্রের জন্য শুভকর নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্ম দুটি ভিন্ন সত্তা নিয়ে গড়ে উঠছে। যদি তাই হয় তবে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কারও জন্য কল্যাণকর হবে না। এ জন্য দরকার নেতিবাচক ধারণায় গড়ে ওঠা তরুণদের ইতিবাচক ধারণায় গড়ে তোলা। আর কীভাবে প্রযুক্তি ও প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় করে তরুণদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা যায়, দরকার সে বিষয় গভীর বিশ্নেষণ ও গবেষণা। স্টিভ জবস ও বিল গেটস নিজ সন্তানদের প্রযুক্তির ব্যবহারে রক্ষণশীল ছিলেন। এটিকে রক্ষণশীলতা না বলে তাদের দায়বদ্ধতা বললে যৌক্তিক হবে। এ প্রসঙ্গে বিল গেটস বলেছেন, আমরা প্রায় আমাদের সন্তানদের একটি সময় বেঁধে দিতাম। এই সময়ের পর তাদের এই জাতীয় ডিভাইসগুলো বন্ধ রাখতে হতো। এর ফলে তারা সময়মতো ঘুমাত এবং তাদের পর্যাপ্ত ঘুম হতো।

    কাজেই আজ ও আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণদের মধ্যে এর ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। যেখানে নেতিবাচক বিষয়গুলো হবে নির্বাসিত। কারণ প্রযুক্তিকে উপেক্ষা করে তরুণদের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না।


    লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close