• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

সৃষ্টির আনন্দের চেয়ে বড় কিছু নেই

প্রকাশ:  ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ২২:৩১
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মানুষের শুভচিন্তা থেকে ইতিবাচক ধারণা তৈরী হয় | এই ইতিবাচক ধারণা যখন সৃষ্টির ধারণা দিতে পারে তখন উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে | ফলে এক সময় সেটি রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত হয়। এই উদ্ভাবনী শক্তির ভিত্তি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষায়িত মানুষ পর্যন্ত হতে পারে। যেমন রাষ্ট্রের যে বিভিন্ন সমস্যাগুলো বিদ্যমান আছে তা নিয়ে মানুষ যাতে ভাবতে পারে এই ধরনের পরিবেশ কেবল মাত্র উদ্ভাবনী চিন্তা শক্তির ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে সম্ভব। এ প্রসঙ্গে হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

ঝিনাইদহ উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে একজন সাধারণ কৃষক যে সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে পারেন এটি তার উদাহরণ। আবার ড. মাকসুদুল আলম ও তার গবেষক দল ২০১০ সালে পাটের জিনতত্ত্ব উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে আবিষ্কার করেন। যেটি পরবর্তীতে পাটের জিনোম সিয়েয়েন্স নামে পরিচিত হয়। এখানে একটি বিষয় বলা যেতে পারে উদ্ভাবনী শক্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক স্তর ও শ্রেণী বিন্যাসের প্রভাব মুখ্য নয়। এ ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক চিন্তা ধারারও তেমন একটা প্রভাব নেই। অন্য একটি বিষয় হলো শুধু পুঁথিগত শিক্ষা মানুষের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তা করার ক্ষেত্র তৈরি করে না, বরং জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান বিতরণ, জ্ঞান সৃষ্টি আর স্বশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, টমাস আলভা এডিশন, রাইট ব্রাদার্স- এদের শিক্ষার ভিত্তি না থাকলেও তাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ধারণা তাদেরকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে পরিগণিত করেছে। অন্যদিকে বিলগেটস হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি। কিন্তু ফরমাল শিক্ষার অবসান ঘটলেও তিনি তার উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গিকে গৌণ হিসেবে বিবেচনা করেননি। ফলে মাক্রোসফটের মতো ক্রিয়েটিভ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই তিনি থেমে যাননি, তার সৃষ্টিশীল চিন্তাশীলতা তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে যাতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায় আর ম্যালেরিয়া নির্মূলসহ সমাজ কল্যাণের সৃষ্টিশীল ধারণা বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন। ফলে ভিন্ন ভিন্নমুখী উদ্ভাবনী চিন্তাধারার বিস্তার ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে টমাস আলভা এডিসন তার প্রযুক্তিমুখী সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রচুর সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। ল্যারি এলিসন ওরাকল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনিও তার কলেজের ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তার উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি তার চিন্তাধারার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। যার প্রভাব মানব কল্যাণে প্রতিফলিত হয়েছে। শিক্ষার বিস্তার ও চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি তার অর্থ ব্যয় করে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরেছেন। তাহলো একজন উদ্ভাবনী শক্তিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিই উদ্ভাবনী চিন্তাধারার মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে পারেন। বাংলাদেশে উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটেছে কিন্তু এই বিকাশকে লালন পালন করে একটি ফলবান বৃক্ষে পরিণত করার তেমন একটা প্রচেষ্টা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে মেধার বিচারে যেখানে উন্নত রাষ্ট্রসমূহের বাংলাদেশের পিছনে থাকার সম্ভাবনা থাকলেও তার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন না করে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। শুধু রুটিন দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আরো কি কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয় সেটা চিন্তা করে সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্পর্কিত খবর

    সরকারি চাকরি যে একটা রুটিন চাকরি, আসলাম বেতন নিলাম চলে গেলাম সেটা নয়, নিজের ভেতরে উদ্ভাবনী শক্তি কি আছে সেটাও কাজে লাগাতে হবে। নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। যেখানে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাকে সেখানে ভাবতে হবে এটা আমার নিজের দায়িত্ব, কারণ এই দেশটা আমার। দেশের মানুষগুলো আমার। কাজেই দেশের মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। এখানে উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আবার দেশপ্রেমের সঙ্গে উদ্ভাবনী চিন্তাধারার যে যোগসূত্র রয়েছে তাকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিজ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, খুলনার জেলা প্রশাসন কল্যাণমুখী উদ্ভাবনী ধারণার প্রণোদনা প্রয়োগ করে সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশ প্রশাসনের একদিনের বেতন দিয়ে ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য একটি ফান্ড গঠন করেছেন। এই অর্থ ব্যবহার করে ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিটি মানুষকে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে উদ্ভাবনী শক্তির চর্চা ও প্রয়োগ করে সকল পর্যায়ে সৃজনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এটি একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের চিন্তাধারাকে ইতিবাচক মানদণ্ডে বিচার করা সম্ভব হবে। মনস্তাত্ত্বিকতার গবেষণায় বলা হচ্ছে ইতিবাচক আবেগ সৃজনশীলতার জন্য উপযোগী কারণ এটি মনকে ও চিন্তা শক্তিকে প্রসারিত করে। কিন্তু নেতিবাচক আবেগ সৃজনশীলতার জন্য ক্ষতিকর কারণ তা ইতিবাচক আবেগের বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তবে এটি সব সময়ের জন্য সত্য নয়। রজার বেয়াটির নেতৃত্বে একটি সাম্প্রতিক স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় বলা হয়েছে সৃষ্টিশীল মানুষের মস্তিষ্কের দুটি অঞ্চলের মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে কেন্দ্রমুখী এবং মনোযোগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংযুক্ত অঞ্চলের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক। আরেকটি হচ্ছে কল্পনা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা সম্পর্কিত অঞ্চলে মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক। তবে এর সঙ্গে নতুন উদ্ভাবনী ধারা তৈরির জন্য যে পরিবেশ দরকার তার সঙ্গে ব্যক্তির খাপ খাওয়ানো ও তাকে সেই পরিবেশের সঙ্গে কার্যক্ষম করে গড়ে তোলার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে হবে। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিজ্ঞানী ক্রিস্টিনা ফং ‘ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগ কিভাবে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ‘মানসিক দ্বন্দ্ব’ তৈরি করে তার প্রভাবগুলোর অনুসন্ধান করেছেন। এই গবেষণায় বলা হচ্ছে যখন অনেক ধরনের আবেগ একসঙ্গে কাজ করে তখন সেখানে একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ একটি অস্বাভাবিক সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে। যা অসাধারণ সংবেদনশীলতার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে উদ্ভাবনী ধারণা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে টমাস আলভা এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতির ফিলামেন্ট আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যখন দুই হাজারের বেশি ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে পর্যাপ্ত আলো সেখান থেকে বের করা সম্ভব হলো না, তখন টমাসের সহযোগীর মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। তিনি টমাসকে হতাশার সুরে বললেন আমাদের গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু টমাস বললেন অন্য কথা। তিনি বললেন আমাদের গবেষণা সফল হয়েছে কারণ আমরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি এই দুই হাজার ম্যাটেরিয়াল ফিলামেন্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না। এর ফলে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা এই ম্যাটেরিয়ালগুলো বাদ দিয়ে নতুন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে চিন্তা করবে যা বেশি আলো সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। বরং সেক্ষেত্রে বলা যায় আমরা উদ্ভাবনী ধারণাকে সম্প্রসারিত করেছি। তবে আমাদের দেশে কিভাবে উদ্ভাবনী শক্তি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে উন্নত রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে তার কোনো ধরনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা হচ্ছে না। এর জন্য যেমন উদ্ভাবনী চিন্তাধারার কর্মকৌশল তৈরির জন্য জাতীয় নীতিমালা প্রয়োজন তেমনি উদ্ভাবনী গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা দরকার।

    যেখানে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনীর বিষয়টি থাকবে না বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, মূল্যবোধ তৈরি, উন্নত চিন্তাধারা, দেশপ্রেম, লেখার বৈচিত্র্যতা, শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা, শিল্প, নাট্যকলা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ধরনের উদ্ভাবনীর বিষয়টি সম্পৃক্ত হবে। ড. কুদরাত-এ-খুদার গবেষণার হাতেখড়ি স্টেরিও রসায়ন নিয়ে হলেও পরবর্তীতে তার গবেষণার বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়ে বনৌষধি, গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, লবণ, কাঠকয়লা, মৃত্তিকা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ সংক্রান্ত দেশজ গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়। বিজ্ঞানী হিসেবে তার ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৯টি পাটসংক্রান্ত। যেগুলোর মধ্যে পাট ও পাটকাঠি থেকে রেয়ন, পাটকাঠি থেকে কাগজ এবং রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য। ডাক্তার শাহ এম ফারুক, ড. আনিসুর রাহমান, ড. জামালউদ্দিন, মেঘনাদ সাহা, আজম আলী, আবেদ চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার খান, পি সি রায়, ড. মাকসুদুল আলম, ড. আতাউল করিম, অধ্যাপক আবুল হুসসাম, রেজাউল করিম, ড. মো. আব্দুল আহাদ, শুভ রায়, ড. মুশফিক আহমদ, ড. অধ্যাপক ওসমান গনি তালুকদার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু সহ বিজ্ঞানীরা দেশ বিদেশে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বাঙালিরা উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রয়োগ করে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। উদ্ভাবনী ধারণাকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে | জন্ম থেকেই মানুষকে কিভাবে উদ্ভাবনমুখী করে গড়ে তোলা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে | উদ্ভাবন হোক আনন্দের, মনের ও কল্যাণের | কারণ উদ্ভাবন থেকেই আসে সৃষ্টির আনন্দ আর সৃষ্টির আনন্দের চেয়ে বড় কিছুই হতে পারেনা |

    এখন প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে উদ্ভাবনী চিন্তাধারা প্রয়োগ করে সকলকে একসঙ্গে বাস্তবে কাজ করা। তবেই উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমের আবেগকে কাজে লাগানো।

    লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close